সিপিআর (CPR) কি? কখন, কাকে আর কিভাবে দিতে হয়:

শীতকাল শেষ। আর কিছুদিন পরেই চলে আসবে গ্রীষ্মকাল। গরমের সময় মাঝে মাঝেই দেখা যায় বাজারে, মাঠে ময়দানেসহ বিভিন্ন জায়গায় হঠাৎ করেই কেউ একজন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।

বিদেশে এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই কোথাও থেকে ছুটে এসে কিছু মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া লোকের বুকের উপর চাপাচাপি করছে এবং কিছুক্ষণ পরেই অজ্ঞান হয়ে যাওয়া লোকটি জ্ঞান ফিরে পেয়েছে এমনটা ইউটিউব বা বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ায় দেখা যায়। কি এমন করে তারা যে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মানুষ মুহূর্তেই জ্ঞান ফিরে পায়? আর কখন আর কিভাবে এই চিকিৎসা দিতে হবে সেই বিষয়েই আজকের এই পোস্ট।

যারা এভাবে ছুটে এসে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মানুষদের প্রাণ বাঁচায় বিদেশে তাদের হিরো বলে ট্রিট করা হয়। কারণ তাদের এই প্রচেষ্টা একটি মানুষকে শুধুমাত্র জ্ঞান ফেরায় এমনটা নয়। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের এই প্রচেষ্টা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মানুষের প্রাণ বাঁচাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তাদের শুধু হিরো নয়, বলা হয় ‘সিপিআর হিরো’। আর এগিয়ে আসা মানুষগুলো ডাক্তার বা নার্স এমনটা নয়। এসব মানুষের অধিকাংশই কিন্তু স্ট্রেঞ্জার। অর্থাৎ আমাদের মতই সাধারণ মানুষ। বিদেশে স্কুল, কলেজ বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাধারণ মানুষকে ফ্রি-তে দেওয়া হয় এই সিপিআর ট্রেনিং। আমাদের দেশেও কয়েকটি সংগঠন এই CPR পদ্ধতিসহ প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ক ট্রেনিং দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এই প্রাথমিক চিকিৎসার ট্রেনিং-এ সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা রয়েছে৷ প্রাথমিক চিকিৎসা হচ্ছে জীবন বাঁচানোর বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানোর প্রথম এবং উত্তম চিকিৎসা।

হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মানুষের জ্ঞান ফেরাতে যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় তাকে বলা হয় Cardiopulmonary Resuscitation (CPR).

এই পদ্ধতিটি জানা থাকলে আমাদের আশেপাশে হার্ট অ্যাটাক, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া, হিটস্ট্রোক, পানিতে পড়ে যাওয়া মানুষের জীবন বাঁচাতে বিশেষ অবদান রাখা যেতে পারে।
মানুষের হার্ট কাজ করা বন্ধ হয়ে গেলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন ও রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সিপিআর দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে হার্ট পাম্প বা হার্টের উপর বারবার চাপ প্রয়োগ করে হার্টকে একপ্রকার রিস্টার্ট করা। আর এই পদ্ধতি প্রয়োগে হার্ট তার কাজ শুরু করার পাশাপাশি আমাদের ব্রেনে অক্সিজেন সরবরাহ শুরু করতে পারে।

আমাদের দেশে প্রায় সব জায়গায়ই দেখা যায় কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বা অজ্ঞান হয়ে গেলে মানুষের ভীড় জমে যায়। আর ভীড় এতটাই বেড়ে যায় মুহূর্তেই চারপাশ ঘিরে ফেলে। এই উৎসুক জনতার কারণে আসুস্থ মানুষটি পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। এতে দ্রুতই ব্যক্তিটি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে বা মুহুর্তেই অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়। সুতরাং, কোথায় হঠাৎ কোন ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়লে বা অজ্ঞান হয়ে গেলে আশেপাশে ভীড় করতে দেওয়া যাবে না। যেভাবেই হোক অতি দ্রুত ভীড় সরিয়ে দিতে হবে। এতে করে রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া বা অক্সিজেন পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

সিপিআর দেওয়ার সময় কি কি পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে এবং কিভাবে সিপিয়ার দিতে হবে পর্যায়ক্রমে আপনাদের জানানোর চেষ্টা করছি।

★ সিপিআর শুরু করার আগে যেসব বিষয় দেখে নিতে হবেঃ

১. প্রথমেই দেখে নিন আশেপাশের পরিবেশ নিরাপদ কি না!
আশেপাশে আপনাকে সহায়তা করতে পারবে এমন মানুষ আছে কি না দ্রুত খুঁজে নিন। কারণ একজনের পক্ষে সঠিকভাবে সিপিআর দেওয়া সম্ভব নয়। অজ্ঞান হওয়া লোকটির কাঁধে একটি চাপড় দিন বা হালকা ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করুন ‘ Are You Okay ‘ বা আপনি ঠিক আছেন? এই কথাটি জিজ্ঞেস করার কারণ লোকটি ঠিক আছে কি না বা লোকটির আসলেই সাহায্য লাগবে কিনা সেই বিষয়ে আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন। যদি সে আপনার কথার রিপ্লাই দেয় বা ইশারা দেয় তাহলে বুঝে নিতে হবে তার সিপিআর ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন নেই। আর যদি ব্যক্তিটি সাহায্য চাওয়া বা আপনার কথার উত্তর বা ইশারা দিতে না পারে তাহলে এক মুহূর্ত দেরি না করে সহায়তা শুরু করুন।

২। আশেপাশের কোন হাসপাতালের এম্বুলেন্স নাম্বার থাকলে বা ৯৯৯ এ কল দিয়ে লোকেশন ও রোগীর বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে দ্রুত এম্বুলেন্স টেন্স নিয়ে আসার আহ্বান জানান।

৩। আমাদের দেশে কেউ পড়ে যাওয়া মাত্রই আশেপাশের লোকজন ভিড় করে মজা দেখতে শুরু করে বা নানা কথা বলা শুরু করে। অনেকে মাথায় পানি দেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করে দেয়। এসব উৎসুক মানুষকে দ্রুত দূরে সরিয়ে দেন। এতে করে রোগী নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাবে। সিপিয়ার এর মূল উদ্দেশ্যেই হচ্ছে রোগীকে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে বা অসুস্থ অনুভব করলে কখনও প্রথমে মাথায় পানি ঢালবেন না। কারণ মাথায় পানি দেওয়া মাত্রই মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এতে মস্তিষ্কে ব্লাড প্রেসার বেড়ে গিয়ে মুহুর্তেই রোগীর ব্রেন স্ট্রোক এবং মস্তিষ্কের শিরা ফেটে রক্তক্ষরণ হতে পারে। ভীড় সরিয়ে দিয়ে রোগীকে দ্রুত চিৎ করে শুইয়ে দিবেন। রোগীর পড়নে থাকা শার্ট দ্রুত খুলে ফেলবেন। গেঞ্জি বা মেয়েদের ক্ষেত্রে পোশাক খোলার প্রয়োজন নেই।

৪. জ্ঞান না থাকলে অজ্ঞান ব্যক্তিটির শ্বাস নেওয়ার পথ অর্থাৎ নাক, মুখ ও গলার ভিতরের অংশ পরিষ্কার আছে কি না দেখে নিন। যদি থুথু, কফ, রক্ত বা অন্য কিছু জমে থাকে তাহলে দ্রুত বের করে ফেলতে হবে। এবং ব্যক্তির মাথা পেছনের দিকে টেনে থুঁতনি ওপরের দিকে তুলে শ্বাসনালী খুলে দিতে হবে। শ্বাসনালী খুলে দেওয়ার পরেই সিপিআর প্রয়োগ করতে হবে।

★ সিপিআর কিভাবে দিবেনঃ

১. প্রথমেই আপনার হাত অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ব্যক্তিটির একপাশে বুক বরাবর বসবেন। এরপর আপনার হাত ব্যক্তির বুকের মাঝ বরাবর রাখবেন। এবার মাঝখান থেকে সামান্য বামে সরিয়ে নিন। আপনি ডানহাতি হলে প্রথমে বাম হাত এবং তার উপরে ডান হাত রাখুন। আর বাহাতি হলে প্রথমে ডান হাত এবং তার উপরে বাম হাত রাখুন৷ আপনার সুবিধামত রিভার্সও করতে পারেন। এক হাত কিভাবে অপর হাতের উপরে রাখতে হবে তা ছবি থেকে বুঝে নিতে পারবেন।

সিপিআরের সময় তালু ও কনুইয়ের পজিশন।

ছবির নির্দেশনা মত মাঝখান থেকে সামান্য বামে হাত রেখে শরীরের ওজন দিয়ে ব্যক্তির বুকে জোরে জোরে চাপ দিতে থাকুন৷ চাপ দেওয়ার সময় মায়া না করে জোরে চাপ দিতে হবে। এতটা জোরে চাপ দিতে হবে যেন আক্রান্ত ব্যক্তির বুকের হাড় কমপক্ষে ২ ইঞ্চি পরিমাণ ডেবে যায়। প্রতি মিনিটে এভাবে ১০০-১২০ বার চাপ দিতে হবে। অর্থাৎ খুব দ্রুত এবং শক্তির সাথে কাজটি করতে হবে।
যদি একা সিপিআর দেন তাহলে অজ্ঞান ব্যক্তির চেষ্ট কম্প্রেশন আর রেসপিরেশনের রেশিও হবে ৩০ঃ২। অর্থাৎ ৩০ বার বুকে চাপ দেওয়ার পরে ভিকটিমের মুখে ফু দিয়ে শ্বাস দিতে হবে। শ্বাস দেওয়ার সময় ভিকটিমের নাক বন্ধ করে মুখ খুলে আপনার ফুসফুসে বাতাস নিয়ে অর্থাৎ শ্বাস টেনে সবটুকু বাতাস জোরে ফু দিয়ে রোগীর ফুসফুসে প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। প্রতি ৩০ বার চাপের পরে ২ বার এমন করতে হবে। এভাবে ততক্ষণ পর্যন্ত করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত রোগীর হার্টবিট সচল হয় বা রোগীর শ্বাস স্বাভাবিক হয়। ক্ষেত্রবিশেষে মেডিকেল হেল্প না আসা পর্যন্তও এমনটা চালিয়ে যেতে হতে পারে। এই প্রসেসটি ৩০-৪০ মিনিট পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হতে পারে। যা একার পক্ষে করা সম্ভব না বা খুবই কষ্টকর। এজন্য পর্যায়ক্রমে ২-৩ জন মিলে এই প্রক্রিয়াটি চালিয়ে যেতে হয়।

সিপিআর সার্কেল।

ভিকটিমের ফুসফুসে শ্বাস প্রবেশ করানোর পদ্ধতিটাকে বলা হয় রেসকিউ ব্রেথ। এসময় ভিকটিমের মুখ হা করিয়ে মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে জোরে ফু দিতে হয়। সরাসরি দেওয়াটা ভালো। তবে অনেকে এমনটা করতে অস্বস্তিবোধ করে। এক্ষেত্রে পাতলা রুমাল বা পাতলা গামছা ব্যবহার করতে পারেন। ফু দেওয়ার পরে সাথে সাথে পুনরায় আবার ভিকটিমের বুকে চাপ দেওয়া শুরু করতে হবে। রেস্ট নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। আর চাপ দেওয়ার সময় হাতের কনুই যেন ভাঁজ না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। কারণ হাতের কনুই ভাঁজ হলে ভিকটিমের বুকে পর্যাপ্ত চাপ পড়বে না। মনে রাখবেন, প্রোপার ওয়েতে সিপিআর দেওয়া হলে ভিকটিমের বুকের ২-৪ টি হাড় ভেঙে যায়। হাড় ভেঙে যাবে, ভিকটিম কষ্ট পাবে এমনটা ভাবা যাবে না৷ কারণ মনে রাখতে হবে, প্রোপার সিপিআর তার হাড় ভেঙে দিলেও তার প্রাণ বাঁচানোর একমাত্র উসিলা।
কাজটি অনেক হালকা আর সহজ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করুন এই কাজটি অত্যন্ত কষ্টকর। একই প্রেসার ৫ মিনিট চাপ প্রয়োগ করাটাই যেখানে কষ্টকর বা অসম্ভব। সেখানে ৩০ মিনিট আপনার শরীরের শক্তি প্রয়োগ করা কতটুকু সম্ভব ভেবে নিন। তাই একাই এই কাজটি করবেন এমন বোকামি করবেন না। কাজটি করার সময় ২-৩ জনের সহায়তা নিন। রোগীও বেঁচে যেতে পারে আর আপনার শক্তিও।

একটা কথা না বললেই নয়, আমাদের দেশে পন্ডিত বা সবজান্তা টাইপের অনেক মানুষ দেখতে পাওয়া যায়। আসলে নিজেকে সবজান্তা মনে করলেও আসলে এরা অজ্ঞ এবং সময় আর মানুষের জন্য ক্ষতিকর। শুধু আমাদের দেশে বললে ভুল হবে। সারা বিশ্বেই এমন শ্রেনীর অনেক মানুষ দেখা যায়।
অনেক সময় হাসপাতালে ডাক্তাররা রোগীর প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করতে CPR দেওয়ার সময় রোগীর স্বজনদের কাছে হেনস্তার শিকার হয়। আর রাস্তাঘাটে রোগীকে বাঁচাতে এই পদ্ধতিতে কাজ করতে গেলে জনগণের গণধোলাই পর্যন্ত খেতে হতে পারে৷ অনেকেই বলে বসবে রোগীকে যাতা/চাপ দিয়ে মেরে ফেলেছে 😂আসুন মানুষের এই ভুল বুঝার আগেই তাদের ভুল ভাঙাতে কাজ করি। সিপিআর কি আর কিভাবে সিপিআর দিতে হয় মানুষকে এই বিষয়ে শিখিয়ে প্রাণ বাঁচাতে তৈরি করি অসংখ্য সিপিআর হিরো (CPR HERO)
সিপিআর সম্পর্কে ধারনা পেতে ইউটিউবে বা ফেসবুকে CPR লিখে সার্চ দিলে অসংখ্য ভিডিও পাবেন। গুগল বা ফেসবুকে অনেক লেখাও পাবেন এই বিষয়ে। আপনি সচেতন হতে চাইলে নিজ ইচ্ছায় ভিডিও দেখে নিতে পারেন বা লেখাগুলো পড়ে নিতে পারেন।
আর হ্যাঁ। শুধুমাত্র গরমেই মানুষের CPR প্রয়োজন হয় এমনটা নয়। যে কোন সিজনে আর যে কোন সময়েই মানুষ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। আর সেসময় হার্টবিট বা শ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে সাথেসাথে শুরু করে দিতে হবে সিপিআর সেবা।

আরও পড়ুনঃ হিট স্ট্রোকের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে। 

1 thought on “সিপিআর (CPR) কি? কখন, কাকে আর কিভাবে দিতে হয়:”

  1. Pingback: এন্ডোমেট্রিয়াল হাইপারপ্লাসিয়া কি? - রক্ত বন্ধন - Rokto Bondhon

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *