কিডনির বিরল ক্যান্সার রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামো

একটি বিরল ও জটিল ক্যান্সারের নাম রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামো। এই বিরল ক্যান্সারটি মূলত পেটের গহ্বরের পিছনে অবস্থিত অংশ রেট্রোপেরিটোনিয়ামে হয়ে থাকে। এই ক্যান্সারের অবস্থান এবং যে সকল টিস্যুকে কান্সার প্রভাবিত করতে পারে এমন টিস্যুগুলো নির্ণয় ও চিকিৎসা করাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং।

রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামো হচ্ছে এক ধরনের নরম টিস্যু সারকামো যা রেট্রোপেরিটোনিয়াল স্পেসে সৃষ্টি হয়। এই স্পেসগুলোর মধ্যে কিডনি, অগ্ন্যাশয় এবং প্রধান রক্তনালীর মত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বা কাঠামো রয়েছে।

অন্যান্য নরম টিস্যু সারকোমাস থেকে ভিন্ন।রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকোমাগুলোর প্রায়শই লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই বড় হয়ে যায়। এর ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করাটা খুবই কঠিন হয়ে যায়। এই রোগের কার্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য রোগটির অনন্য বৈশিষ্ট বোঝা চিকিৎসকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামোর কারণ ও ঝুঁকিঃ

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামোর সঠিক কারণসমূহ অজানা। তবে কারণ অজানা থাকলেও বেশ কিছু ঝুঁকির কারণ চিহ্নিত করা গেছে। এসব কারণের মধ্যে জিনগত ট্রুটি যেমন Li-Fraumeni সিনড্রোম রবং নিউরোফাইব্রোমাটোসিস টাইপ-1 উল্লেখযোগ্য। এই জিনগত প্রবণতাগুলো সারকামোসহ বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও কিছু রাসায়নিক এবং বিকিরণের এক্সপোজার সারকামো বিকাশের ঝুঁকি উচ্চ হারে বাড়িয়ে দিয়ে থাকে। এই কারণগুলো নির্দিষ্টভাবে রোগের পূর্বাভাস দেয় না। এবং অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়াগুলো অন্বেষণ করতে থাকে। 

রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামোর লক্ষণঃ

রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামোর লক্ষণগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনির্দিষ্ট হয়। আবার টিউমারের আকার এবং অবস্থানের উপর ভিত্তি করে এর লক্ষণগুলো পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। তবে রোগীদের মধ্যে সাধারণ কিছু লক্ষণ দেখা যায়৷ এসকল লক্ষণের মধ্যে রয়েছে-
★ পেটে ব্যথা বা অস্বস্তি,
★ পেটে এক ধরণের স্পষ্ট ভর,
★ বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া,
★ অব্যক্ত ওজন হ্রাস পাওয়া,
★ অন্ত্রের অভ্যাসের পরিবর্তন।

এই লক্ষণগুলো দেখা দিলেই যে কোনো ব্যক্তি রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামোতে আক্রান্ত এমনটা ভাবা উচিত নয়। অন্যান্য রোগের কারণেও কোনো ব্যক্তির মাঝে এই লক্ষণগুলো দেখা যেতে পারে। আর বিভিন্ন রোগের সাথে এই রোগের লক্ষণগুলোর মিল থাকায় এই রোগটি ডায়াগনস্টিক প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে। এর ফলে কোনো ব্যক্তি অবিরাম পেটের ব্যথা বা পেটের সমস্যার উপসর্গ নিয়ে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয় তাদের গ্যাসের সমস্যা, আলসার, আমাশয় বা জন্ডিসের মত রোগের সন্দেহ করা হলেও ডাক্তার রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামোর মত গুরুতর রোগকে সন্দেহর তালিকা থেকে বাদ দিয়ে চিকিৎসা মূল্যায়ন করে।

রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামো নির্ণয়ঃ

রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামো নির্ণয়ের জন্য ইমেজিং টেস্ট (MRI, City Ultrasonogram), বায়োপসি এবং ল্যাবরেটরি পরীক্ষার সমন্বয়ে নির্ণয় করা হয়। এমআরআই, সিটিস্ক্যান বা আল্ট্রাসনোগ্রামে কোনো কিছু ধরা পড়লে রোগ নিশ্চিত করার জন্য বায়োপসি করার করা অপরিহার্য। বায়োপসির মাধ্যমে প্যাথলজিস্ট একটি মাইক্রোস্কোপের নিচে টিউমারের টিস্যু নমুনা পরীক্ষা করে থাকেন।
উন্নত ইমেজিং প্রযুক্তি এবং আনবিক পরীক্ষা অন্যান্য ধরণের নরম টিস্যু সারকামো এবং সৌম্য অবস্থা থেকে রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামোকে আলাদা করতে বিশেষ সহায়তা করে।

রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামোর বিকল্প চিকিৎসাঃ


সার্জারীঃ

রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামোর প্রাথমিক চিকিৎসা হচ্ছে সার্জারী। এই রোগের চ্যালেঞ্জিং অবস্থানের কারণে, সার্জিক্যাল রিসেকশনের জন্য আশেপাশের অঙ্গসমূহ এবং কাঠামো সংরক্ষণের সময় টিউমার অপসারণ করতে দক্ষতা এবং সতর্ক পরিকল্পনা খুব বেশি জরুরী।
এন ব্লক রিসেকশন, যেখানে টিউমার এবং সুস্থ টিস্যুর একটি মার্জিন একসাথে সরিয়ে ফেলা হয় যেন টিউমারটি পুনরায় আবার সৃষ্টি না হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে টিউমারের সাথে জড়িত থাকলে সেই সকল অঙ্গগুলোকেও অপসারণ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে হয় ডাক্তারদের। এই পদ্ধতিগুলোর জটিলতা বিবেচনা করে বিভিন্ন অভিজ্ঞ সার্জারী টিমের সাথে আলোচনা করে বিশেষ কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসার গুরুত্বকে আন্ডারস্কোর করে থাকেন।

রেডিয়েশন থেরাপিঃ

বিকিরণ বা রেডিয়েশন থেরাপি রোগীর স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর জন্য প্রায়শই অস্ত্রোপাচারের সাথে ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে অপারেশনের পূর্বে এবং অনেক রোগীর ক্ষেত্রে অপারেশনের পরে রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয়ে থাকে৷ অপারেশনের পূর্বে রেডিয়েশন টিউমারকে সঙ্কুচিত বা ছোট করতে পারে। যার ফলে অপারেশনের সাহায্যে টিউমারকে অপসারণ করা আরো সহজ ও কম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে। অপারেটিভ বিকিরণ অবশিষ্ট ক্যান্সার কোষ দূর করতে এবং পুনরায় যেন টিউমার বা ক্যান্সার সৃষ্টি না হয় সেই সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে। ইনটেনসিটি-মড্যুলেটেড রেডিয়েশন থেরাপি (IMRT) এবং প্রোটন থেরাপির মত উন্নত কৌশল সমূহ সুস্থ টিস্যুকে বাঁচিয়ে রেখে টিউমারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করতে সক্ষম।

কেমোথেরাপিঃ

অন্যান্য ক্যান্সারের তুলনায় রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামো চিকিৎসায় কেমোথেরাপির ভূমিকা তুলনামূলক কম স্পষ্ট। মূলত কেমোথেরাপি সারকামোর নির্দিষ্ট উপ-প্রকারের জন্য রোগটি মেটা স্টে সাইজ করার ক্ষেত্রে সুপারিশ করা হয়। জেনে রাখা ভালো, কেমোথেরাপির কার্যকারিতা পরিবর্তিত হয়। এবং কেমোথেরাপি রোগীর কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে সুপারিশ করা হয়। চলমান ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলো রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামো রোগীদের জন্য চিকিৎসাএ ফলাফলকে ইমপ্রুভ করার জন্য অভিনব কেমোথেরাপিউটিক এজেন্ট এবং সংমিশ্রণগুলো অন্বেষণ করছে।

রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামোর পূর্বাভাসঃ

রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামো রোগীদের শরীরে বেশ কিছু পূর্বাভাস দেখা যায়। এসব পূর্বাভাস টিউমারের আকার, গ্রেড, হিস্টোলজিকাল সাবটাইপ এবং একইসাথে অস্ত্রোপাচারের সম্পূর্ণতা সহ বিভিন্ন কিছু কারণের উপর নির্ভর করে।
দুর্ভাগ্যবশত, অন্যান্য সারকোমাগুলোর তুলনায় রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামোগুলোর পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এজন্য চিকিৎসার পরে নিয়মিত ফলোআপ এবং পর্যবেক্ষণের উপর চিকিৎসকগণ বেশি জোর দিয়ে থাকেন।
অস্ত্রোপাচারের কৌশল এবং সহায়ক থেরাপির অগ্রগতি বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে। তবে রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামোর সামগ্রিক পূর্বাভাস পরিবর্তনশীল থাকে।

রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামো এবং অন্যান্য নরম টিস্যুসারকামোর পার্থক্য:

রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামো অন্যান্য নরম টিস্যু সারকামোর তুলনায় শরীরবৃত্তীয় অবস্থান, উপস্থাপনা এবং চিকিৎসা পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ আলাদা। যদিও অনেক নরম টিস্যু সারকামো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অস্ত্রোপাচারের মাধ্যমে মোকাবেলা করার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামোগুলো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের খুব কাছাকাছি হওয়ায় অস্ত্রোপাচার জটিল হওয়ার পাশাপাশি আরো কিছু জটিল অস্ত্রোপাচারের প্রয়োজন হয়ে থাকে বা করতে হতে পারে।
উপরন্তু, টিউমার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি না হাওয়া পর্যন্ত রেট্রোপেরিটোনিয়াল সারকামোর লক্ষণগুলো নাও স্পষ্ট হতে পারে। যা প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্তকরণকে জটিল করে তুলে। এই পার্থক্যগুলো বুঝা, চিকিৎসার কৌশল জানা এবং রোগীর ফলাফলের উন্নতি পর্যবেক্ষণ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a Comment