ব্যাক পেইনে করণীয় কি আর কিভাবে মুক্তি পাবেন ।

ব্যাকপেইন

**************

এমন মানুষ হয়তো পৃথিবীতে পাওয়া যাবে না, যিনি তার জীবনে একবারও কোমর,পিঠ বা ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করেননি। মেরুদণ্ডের নিচের হাড়ের মধ্যবর্তী তরুণাস্থি বা ডিস্কের বার্ধক্যজনিত পরিবর্তনের ফলে এ ব্যথার সুত্রপাত হয়। আবার ভারী জিনিস উত্তোলন, পূর্বের আঘাত ইত্যাদির কারণেও তরুণাস্থির এই পরিবর্তনের সাথে সাথে মেরুদণ্ডের নিচের দিকে সংবেদনশীলতার পরিবর্তন হয়ে থাকে। সাধারণত এ পরিবর্তন ৩০ বছর বয়স থেকে শুরু হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ রোগের কোন উপসর্গ থাকে না। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোগের উপসর্গও বাড়তে থাকে।

কোমর ব্যথার কারণঃ

সাধারণত দেখা যায় মেরুদণ্ডের মাংসপেশি, লিগামেন্ট মচকানো বা আংশিক ছিঁড়ে যাওয়া, দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী ডিস্ক সমস্যা, কশেরুকার অবস্থান পরিবর্তনের কারণে কোমর ব্যথা হয়ে থাকে। চলাফেরা, খুব বেশি ভার বা ওজন উত্তোলন, মেরুদণ্ডের অতিরিক্ত নড়াচড়া, একটানা বসে বা দাঁড়িয়ে কোন কাজ করা, মেরুদণ্ডে আঘাত পাওয়া, সর্বোপরি কোমরের অবস্থানগত ভুলের জন্য এ ব্যথার দেখা দিয়ে থাকে।

অন্যান্য কারণের মধ্যে বয়সজনিত মেরুদণ্ডে ক্ষয় বা বৃদ্ধি, অস্টিওআথ্র্যাটিস বা গেঁটে বাত, স্নায়ুবিক সমস্যা, অস্টিওপোরেসিস, এনকাইলজিং স্পনডাইলাইটিস, মেরুদণ্ডের টিউমার, ক্যান্সার, বোন টিবি, কোমরের মাংসে সমস্যা,বিভিন্ন ভিসেরার রোগ বা ইনফেকশন, বিভিন্ন স্ত্রীরোগ জনিত সমস্যা, মেরুদণ্ডের রক্তবাহী নালির সমস্যা, অপুষ্টিজনিত সমস্যা, মেদ বা ভুড়ি, অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

কোমর ব্যথার লক্ষণঃ

কোমরের ব্যথা আস্তে আস্তে বাড়তে পারে বা হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে। নড়াচড়া বা কাজকর্মের কারণে ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে পারে। ব্যথা কোমরে থাকতে পারে বা কোমর থেকে পায়ের দিকে নামতে পারে অথবা পা থেকে কোমর পর্যন্তও উঠতে পারে। আবার অনেক সময় কোমর থেকে ব্যথা মেরুদণ্ডের পেছন দিক দিয়ে মাথা পর্যন্ত উঠতে পারে। রোগী অনেকক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ব্যথার কিছুক্ষণের মধ্যে পায়ে শিন-শিন বা ঝিন-ঝিন জাতীয় ব্যথা নামতে বা উঠতে পারে। হাঁটতে গেলে পা খিচে আসে বা আটকে যেতে পারে ভুক্তভোগীর। ব্যথা দুই পায়ে বা যেকোন এক পায়ে নামতে পারে। অনেক সময় বিছানায় শুয়ে থাকলে ব্যথা কিছুটা কমে আসে। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে রোগীর কোমর ও পায়ের মাংসপেশীর ক্ষমতা কমে আসে এবং শুকিয়ে যেতে পারে। সর্বোপরি রোগী চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল।

আধুনিক এই যুগেও কোমর ব্যথা একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বাস্থ্য সমস্যা। এ সমস্যার সমাধানে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।

কোমর ব্যথার প্রতিকারঃ

ফার্মাকোথেরাপিঃ

চিকিৎসকরা রোগীকে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সাধারণত ব্যথানাশক এনএসএআইডিএস গ্রুপের ওষুধ, মাসল রিলাক্সজেন ও সেডেটিভজ জাতীয় ঔষধ দিয়ে থাকেন। যেহেতু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে সেজন্য অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঔষধ খাওয়া উচিত। ব্যথানাশক ঔষধ অতিরিক্ত সেবনের ফলে কিডনীর সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

ফিজিওথরাপিঃ

কোমরের ব্যথাজনিত সমস্যার অত্যাধুনিক চিকিৎসা ফিজিওথেরাপি। এই চিকিৎসা ব্যবস্থায় চিকিৎসক রোগীকে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন, আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপি, লেজার থেরাপি, লাম্বার ট্রাকশন শর্টওয়েভ ডায়াথার্মি, ইন্টারফেরেনশিয়াল থেরাপি, অটো মেনুয়াল ট্রাকশন, ইনফারেড রেডিয়েশন, অতিলোহিত রশ্মি, ট্রান্স কিউটেনিয়াস ইলেকট্রিক নার্ভ ইস্টিমুলেটর, ইলেকট্রিক নার্ভ ও মাসেল ইস্টিমুলেটর, হাইড্রোথেরাপি, ও বিভিন্ন প্রকার ব্যায়ামের মাধ্যমে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এছাড়াও চিকিৎসা চলমান অবস্থায় কোমরে নির্দিষ্ট অর্থোসিস বা ব্রেস প্রয়োগ করে থাকেন।

সার্জারিঃ

যদি দীর্ঘদিন ফার্মাকোথেরাপি ও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা চালানোর পরও রোগীর অবস্থার পরিবর্তন না হয় এক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী কোমর-মেরুদন্ডের অপারেশন বা সার্জারি করনোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসক। সার্জারি পরবর্তীতে রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নির্দেশনা মোতাবেক রোগীকে নির্দিষ্ট ব্যায়াম দীর্ঘদিন চালিয়ে যেতে হয়।

প্রতিকার এবং দৈনন্দিন কাজে সতর্কতাঃ

★নিচ থেকে কিছু তোলার সময়-

– কোমর ভাঁজ করে কিংবা ঝুঁকে ভারী কোন কিছু তুলবেন না। তুলতে হলে হাঁটু ভাঁজ করে তুলতে হবে।

★ কোন কিছু বহন করার সময়

– ঘাড়ের ওপর কিছু তুলবেন না,

– ভারি জিনিস শরীরের কাছাকাছি রাখতে হবে,

– পিঠের ওপর ভারি কিছু বহন করার সময় সামনের দিকে ঝুঁকে বহন করুন।

★ ঘুমানো বা শোয়ার সময়-

– উপুড় হয়ে শুবেন না। ভাঙ্গা খাট, ফোম বা স্প্রিংয়ের খাট পরিহার করতে হবে,

– সমান তোশক ব্যবহার করতে হবে,

– বিছানা শক্ত, চওড়া ও সমান হতে হবে। শক্ত বিছানা বলতে সমান কিছুর ওপর পাতলা তোশক বিছানোকে বুঝায়।

★ দাঁড়িয়ে থাকার সময়

– ১০ মিনিটের বেশি একস্থানে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলে ছোট ফুট রেস্ট ব্যবহার করুন,

– হাঁটু না ভেঙে সামনের দিকে ঝুঁকবেন না,

– দীর্ঘক্ষণ হাঁটতে বা দাঁড়াতে হলে উঁচু হিলযুক্ত কিছু পরবেন না,

-অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হলে কিছুক্ষণ পর পর শরীরের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে নিতে হবে,

★ বসে থাকার সময়

– আপনার চেয়ারটি টেবিল থেকে বেশি দূরে সরিয়ে রাখবেন না,

– সামনে ঝুঁকে কাজ করা যাবে না,

– কোমরের পেছনে সাপোর্ট ব্যবহার করা ভালো,

– এমনভাবে বসতে হবে যেন ঊরু মাটির সমান্তরালে থাকে,

– নরম গদি বা স্প্রিংযুক্ত সোফা বা চেয়ারে বসা পরিহার করতে হবে।

★ যানবাহনে চড়ার সময়

– গাড়ি চলানোর সময় স্টিয়ারিং হুইল থেকে দূরে সরে বসা যাবে না। সোজা হয়ে বসতে হবে,

– ভ্রমণে ব্যথার সময় লাম্বার করসেট ব্যবহার করতে হবে,

কোমর ব্যথা বেশি হলে বিছানা থেকে শোয়া ও ওঠার নিয়মঃ

– চিৎ হয়ে শুয়ে এক হাঁটু ভাঁজ করতে হবে,

– এবার অন্য হাঁটুটি ভাঁজ করতে হবে এবং হাত দুটি বিছানায় রাখতে হবে,

– এবার ধীরে ধীরে এক পাশ কাত হতে হবে,

– পা দু’টি বিছানা থেকে ঝুলিয়ে দিতে হবে। এবার কাত হওয়া দিকের হাতের কনুই এবং অপর হাতের তালুর ওপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসতে হবে,

– দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে বসে মেঝেতে পা রাখতে হবে।
এরপর দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে দাঁড়াতে হবে।

স্বাস্থ্য বিষয়ক পোস্ট এবং রক্তদাতা সংগ্রহ করতে রেজিষ্ট্রেশন করুন নিচের লিংকেঃ


https://roktobondhon.com/registration


মেয়েরা যেসব নিয়মকানুন মেনে চলবেনঃ

* অল্প হিলের জুতো বা স্যান্ডেল পড়তে হবে। বিভিন্ন জুতোর হিলের উচ্চতা বিভিন্ন না হওয়াই ভালো,

* তরকারি কাটা, মসলা বাটা, কাপড় কাচা ও ঘর মোছার সময় মেরুদন্ড সাধারণ অবস্থায় এবং কোমর সোজা রাখতে হবে,

* কোমর ঝুঁকে বাচ্চাকে কোলে নেওয়া যাবে না। ঝাড়ু দেয়া এবং টিউবওয়েল চাপার সময় কোমর সোজা রাখতে হবে,

* মার্কেটিং বা শপিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হলে ১০ থেকে ১৫ মিনিট দাঁড়ানো বা হাঁটার পরে বিশ্রামের জন্য একটু বসে নিতে হবে,

* বিছানা গোছানোর সময় কোমর ভাঁজ না করে হাঁটু ভেঙে বসতে হবে,

* ওজন কমাতে হবে এবং খাদ্যাভাস পরিবর্তন করতে হবে।

★★ গরু এবং খাসির মাংস, ডালজাতীয় খাবার, মিষ্টিজাতীয় খাবার, তৈলাক্ত খাবার খাদ্য তালিকা থেকে কমিয়ে আনতে হবে। এসব খাবারের পরিবর্তে শাকসবজি, তরি-তরকারি, ফলমূল আমাদের খাদ্য তালিকায় বেশি পরিমাণে যুক্ত করতে হবে। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে এবং যাদের দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস আছে, এই অভ্যাস পরিবর্তন করে রাতে দ্রুত ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে।

★ নোটঃ
ব্যাক পেইনের কারণে অনেকেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। চিকিৎসা নেওয়ার পূর্বে মেডিকেল টেস্ট করিয়ে নিয়ে তবেই একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে। টেস্ট ব্যতীত যে কোন প্রকার চিকিৎসা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

Leave a Comment