প্যানিক অ্যাটাক কি?

প্যানিক অ্যাটাকঃ

প্যানিক অ্যাটাক এমন এক রোগ, যা ভীতি ও উদ্বেগের মাধ্যমে হটাৎ করেই আমাদের স্তব্ধ বা হতবিহ্বল করে দিতে পারে। এবং এর পাশাপাশি হালকা মাথাব্যথা, হার্টবিট বাড়িয়ে দেওয়া এবং শ্বাসকষ্টের মত শারীরিক সমস্যার উপসর্গ তৈরি করতে পারে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে অর্থাৎ প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হলে অনেক শিশু এমনকি বড় মানুষ আতঙ্ক অনুভব করে। অনেকে মনে করে থাকে এখন তার সাথে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে৷ এমনকি প্রকৃতপক্ষে কোনো বিপদ না থাকলেও যে কোন সময় প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত ব্যক্তি মনে করতে থাকে তার সাথে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে।

প্যানিক অ্যাটাকের কারণ কি?

শিশু বা বড়রা কেন প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হয় এই বিষয়ে সবসময় পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না। এক একজন এক এক কারণে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এসব কারণের মধ্যে কিছু কারণ সাধারণত বেশিরভাগ মানুষের মাঝে দেখা যায়। আর প্রাথমিকভাবে এই কারণগুলোকে চিহ্নিত করেই ডাক্তার বুঝতে পারে ব্যক্তিটি প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে–

১. কোন কিছু নিয়ে উদ্বেগ বোধ করা বা কঠিন অথবা মানসিক চাপযুক্ত কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার ফলে,

২. বাড়িতে, স্কুলে, কলেজে বা কর্মক্ষেত্রে কোন কঠিন অভিজ্ঞতার কারণে ভয় বা উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়ার ফলে,

৩. পরীক্ষা, বন্ধুত্ব বা সম্পর্কের মত বিষয়ে মানসিক চাপ বা আঘাত পাওয়ার ফলে,

৪. প্রিয়জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু বা এক্সিডেন্ট বা ভয়াবহ কিছু দেখে ভয় পাওয়ার ফলে,

৫. নির্যাতন বা অবহেলার মতো ভীতিকর পরিস্থিতিতে সম্মুখীন হলে,

৬. সহিংস অভিজ্ঞতার প্রভাবে,

৭. পারিবারিক নির্যাতন, চাপ বা কোন হুমকিতে ভয়ের কারণে।

শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মাঝে প্যানিক অ্যাটাকঃ

সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালে বেশিরভাগ মানুষ প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে থাকে। আবার অনেককে শৈশবেই ঘটনার বা ভয়ের প্রভাবে এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এসব প্যানিক অ্যাটাক অনেক সময় রোগী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ হতে পারে। সেই সাথে এই রোগটি আক্রান্ত শিশুর মেজাজ, ব্রেন বা অন্যান্য কাজকর্মে বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে৷
প্যানিক অ্যাটাকের শিকার হওয়ার আতঙ্কে থাকে এমন পরিস্থিতি বা স্থান এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে অনেক শিশু৷ আবার দেখা যায় ভয়ে বা অতঙ্কে থাকা অনেক কিশোর-কিশোরী তাদের ভয় বা উদ্বেগ কমাতে ড্রাগ বা অ্যালকোহল গ্রহণ করা শুরু করে। যদি রোগীর ভয় বা আতঙ্কের কারণ চিহ্নিত করা না যায় এবং প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত ব্যক্তি ড্রাগ বা অ্যালকোহল সেবন করছে কি না এই বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া না যায়, এবং সঠিক চিকিৎসা না দেওয়া হয় তাহলে প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত শিশু বা কিশোর-কিশোরী ভবিষ্যতে জটিল সমস্যার শিকার হতে পারে। যেমন: আক্রান্ত শিশু বা কিশোর-কিশোরী হাই ডিপ্রেশন বা চূড়ান্ত বিষন্নতায় ভুগতে পারে। এর পাশাপাশি তারা আত্মঘাতমূলক আচরণও করতে পারে।
প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করা সম্ভব হলে প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত শিশু, কিশোর-কিশোরী বা ব্যক্তিকে চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

প্যানিক অ্যাটাকের লক্ষণ ও উপসর্গঃ

আপনার সন্তান বা আপনার পরিবারের কোন সন্তান যদি প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে তার চারপাশে যে সকল ঘটনা ঘটে সেসব ঘটনা তার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে বলে সেই সন্তান অনুভব করতে থাকে। আর এই অনুভবের কারণে, তার শরীর বিপদে পড়েছে বা সে মারা যাচ্ছে এমন অনুভব করে আতংকিত হয়ে পড়ে। প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হলে আমাদের শরীরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে:

★ শ্বাসকষ্ট, দ্রুত শ্বাস নেওয়া বা শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া,
★ আলোকে আরও উজ্বল ও তীব্র অনুভব করা,
★ মাথা হালকা বা ভারী অনুভব করা বা অচেতন হয়ে যাবো এমন অনুভব করা,
★ হার্টবিট দ্রুত থেকে দ্রুততর হওয়া এবং বুকে চাপ অনুভব করা,


★ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়া, এমন অনুভব করে যেন কান্নাই থামতে চাচ্ছে না,
★ পায়ে কাঁপুনি ও টালমাটাল অনুভূতি,
★ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘামিয়ে যাওয়া,
★ পেট ফাঁপা বা অসুস্থ বোধ করা
★ মনে হওয়া কিছুতে আটকে গেছি, যেন আমি নড়াচড়া করতে পারছি না।
সন্তান আক্রান্ত হলেও এসব লক্ষণ দেখা যাবে তাদের মাঝে।

আপনার সন্তান প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হলে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেনঃ
প্যানিক বা আতঙ্ক মোকাবেলায় প্রথম ধাপ হচ্ছে, কি কারণে বাচ্চা বা ব্যক্তি প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েছে বা হচ্ছে তা নির্ণয় করা। আপনার সন্তান বা যিনি প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হচ্ছে তাকে জিজ্ঞেস করুন তিনি কেমন অনুভব করছেন। আর কোন কারণে তিনি মানসিক চাপ বা উদ্বিগ্নতা অনুভব করছেন এই বিষয়টি তার থেকে জেনে নিন। এমন কোন নির্দিষ্ট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যা সন্তান বা পরিচিত ব্যক্তির মাঝে আতংকের অনুভূতি তৈরি করছে তা জানার পরে সেই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে কি কি করতে হবে বা কি কি করবে এই বিষয়ে তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে পারলে এই অবস্থা থেকে তাকে স্বাভাবিক করতে সহায়তা করতে পারে।
প্যানিক অ্যাটাকের সময় আক্রান্ত সন্তান বা ব্যক্তির মনে হতে পারে, সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। তবে এমন কিছু পদ্ধতি রয়েছে যার মাধ্যমে আপনি আক্রান্ত সন্তানকে তার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে ও পুনরায় স্বাভাবিক অনুভব করাতে সহায়তা করতে পারে। পদ্ধতিগুলো হচ্ছে–

১. পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন/করানঃ
কখনও কখনও আমাদের আতঙ্কিত করে এমন পরিস্থিতি বা স্থানকে এড়িয়ে যাওয়াটা সহজ বলে মনে হতে পারে। আর এমনটা মনে হওয়াটাও স্বাভাবিক। তবে এই পরিস্থিতি এড়িয়ে চলার বিষয়টাই আমাদের আতঙ্ক বা উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। সন্তানকে বা নিজেকে আতঙ্কিত করতে পারে, এমন পরিস্থিতিকে এড়িয়ে চলাকে সমাধান হিসেবে দেখা ঠিক নয়। নিজেকে বা সন্তানকে আতঙ্কিত করে তুলতে পারে এমন পরিস্থিতিকে এড়িয়ে চলার পরিবর্তে নিজেকে বা সন্তানকে সেই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলার শিক্ষা দিতে হবে৷ এতে করে ধীরে ধীরে আতঙ্ক বা উদ্বেগের কারণের সাথে নিজেকে বা সন্তানকে মানিয়ে নেওয়া যাবে।

২. শ্বাস-প্রশ্বাসে মনোনিবেশ করুন/করানঃ
প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হলে নিজেকে বা আক্রান্ত সন্তানকে গভীর শ্বাস নিতে হবে। গভীর শ্বাস নেওয়ার ফলে যেন পেট ফুলে উঠে। এই প্রক্রিয়াটি খুবই প্রশান্তিদায়ক এবং এই পদ্ধতিতে শ্বাস নিলে আমাদের ফুসফুসের গভীরে অক্সিজেন সরবরাহ হতে থাকে।
৩ টি ধাপে শ্বাস নিতে পারেন বা আক্রান্ত সন্তানকে ৩ টি পদ্ধতিতে শ্বাস নিতে সহায়তা করতে পারেন।
★ পেটে হাত রাখুন। পেটে হাত রেখে গভীর শ্বাশ নিন।
★ ৫ বার গভীর শ্বাস নিন। ৫ সেকেন্ড শ্বাস টেনে ধরে রাখুন এবং ৫ সেকেন্ড পর্যন্ত শ্বাস ছাড়ুন। নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে শ্বাস ছেড়ে দিতে হবে।
★ নিজেকে বুঝতে হবে বা প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত শিশুকে বলুন, যখন শ্বাস নিবে তখন বেলুনের মত পেট ফুলে যায় আর শ্বাস ছাড়ার সময় ধীরে ধীরে বেলুনের মত পেটের বাতাস বের হয়ে গেলে আমাদের পেট বেলুনের মত চুপসে যায়।
এটি মূলত নিজের বা আক্রান্ত বাচ্চার মস্তিষ্ককে অন্যদিকে নিয়ে গিয়ে প্যানিক অ্যাটাক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটি পদ্ধতি।

৩. নিরাপদ স্থান খুঁজুন:
আপনি বা আপনার সন্তান যদি কোনো পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত বোধ করেন, তাহলে নিজেকে বা সন্তানকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে এমন একটি স্থানে নিয়ে যান, যেখানে আপনি বা আক্রান্ত সন্তান শান্তভাবে শ্বাস নিতে পারেন এবং অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করতে পারেন। স্থানটি নিজের বাড়ি, কক্ষ, ছাদ বা এমন কোন স্থান হতে পারে যা আপনার বা আপনার সন্তানের পরিচিত ও পছন্দনীয় স্থান। যেমন: কোন পার্ক, রিসোর্ট, দর্শনীয় স্থান ইত্যাদি।

৪. বর্ণমালা ধরে এগিয়ে যানঃ
আপনার সন্তান যদি প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়, তাহলে আপনার সন্তানকে বর্ণমালার প্রতিটি অক্ষরের সাথে কিছু একটার নাম বলতে বলুন। নামের মধ্যে হতে পারে ফলের নাম, ফুলের নাম, প্রাণীর নাম, খাবারের নাম, জায়গার নাম ইত্যাদি। আবার সন্তানকে দোয়া বা মন্ত্র পড়ার দিকেও মনোনিবেশ করাতে পারেন।
এতে তাদের মস্তিষ্কের একটি অংশ এসব কাজে ব্যস্ত থাকবে এবং তাদের মনোযোগ ভীতি ও উদ্বেগ থেকে তাদের দূরে সরিয়ে আনবে।

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবেঃ

উচ্চ পর্যায়ে প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হলে শিশু, কিশোর-কিশোরী বা আক্রান্ত ব্যক্তি ঘর থেকে বের হতে ভয় পেতে পারে। নিজের বা আপনার সন্তানের মাঝে প্যানিক অ্যাটাকের এমন গুরুত্বর লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে। প্রথমে পারিবারিক কোন ডাক্তার থাকলে তার স্মরণাপন্ন হতে হবে। যদি পারিবারিক ডাক্তার না থাকে তাহলে একজন শিশু বিশেষজ্ঞর স্মরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। যদি উপসর্গের কারণ হিসেবে অন্য কোন শারীরিক অসুস্থতা নির্ণয় করা না যায়, তাহলে প্যানিক অ্যাটাক থেকে নিজেকে বা সন্তানকে রক্ষা করতে একজন মানসিক ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নিতে হবে।
মনে রাখবেন, চিকিৎসার মাধ্যমে প্যানিক অ্যাটাক থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নেওয়া গেলে গুরুতর জটিলতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। অনেক সময় গুরুতর পর্যায়ের রোগী আত্মহত্যার প্রচেষ্টা বা ভয়ের কারণে সামনে মানুষের উপর হামলাও করতে পারে।

আরও পড়ুনঃ মেনোরেজিয়া কি?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *