নিপাহ ভাইরাসে এখনই হতে হবে সচেতন

নিপাহ ভাইরাস কিঃ

নিপাহ ভাইরাস হচ্ছে এক ধরণের ভাইরাসঘটিত সংক্রমণ, যা নিপাহ নামক ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি এক ধরণের আরএন ভাইরাস যা প্যারামিক্সোভিরিডি পরিবারের হেনিপাহ গোত্রের একটি অংশ। সংক্রমিত পশু বা মানুষের সংস্পর্শে আসলে এই রোগিটি এক দেহ থেকে আরেক দেহতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মূলত রোগের উপসর্গ থেকে রোগটি নির্ণয় করা হয়ে থাকে এবং ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীটি নিশ্চিত করা হয়। এখন পর্যন্ত এই রোগের কার্যকরী কোনো টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার করা যায় নি। সহায়ক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগটি উপশম করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। তবে ২০২৪ সালের জানুয়ারী মাসে অক্সফোড বিশ্ববিদ্যালয় নিপাহ ভাইরাসের একটি ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করেছে বলে জানায়। এবং এই ভ্যাক্সিন মানব দেহে পরীক্ষার জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে। এই ট্রায়ালে নেতৃত্ব দিচ্ছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যানডেমিক সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট। যেখানে ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী মোট ৫১ জনের দেহে ভ্যাক্সিনের ১ম ডোজ পুশ করা হয়েছে। ১ম ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরে ১৮ মাস ধরে তাদের মাঝে ট্রায়াল চলবে। এবং এর মাঝে আরও একটি ডোজ পুশ করা হবে তাদের দেহে। ভ্যাক্সিনটির নাম দেওয়া হয়েছে ChAdOx1 Nipah B বা চ্যাডক্স-১ নিপাহ বি।

এই ভ্যাক্সিনগুলো ভেক্টর ভ্যাক্সিন বা ভেক্টর নির্ভর টিকা। অর্থাৎ অ্যাস্ট্রাজেনিকা এবং ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের করোনা ভ্যাক্সিনের মত একই প্রযুক্তিনির্ভর এই টিকা।
১৯৯৯ সালে সর্বপ্রথম মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে প্রথম দেখা যায়। এই রোগটির নামকরণ করা হয় মালয়েশিয়ার একটি গ্রাম সুঙ্গাই নিপাহ এর নামানুসারে। সেই সময় এই রোগের বিস্তার রোধ করতে লক্ষ লক্ষ শুকরকে মেরে ফেলা হয়েছিল
অপরিশুদ্ধ খেজুরের রস, বাদুর ও রুগ্ন শূকর থেকে থেকে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

লক্ষণ ও উপসর্গঃ

রোগের উপসর্গ অনেকের মাঝে নাও দেখা দিতে পারে। তবে অধিকাংশের শরীরে এই ভাইরাসের উপসর্গ দেখা যায়। রোগের উপসর্গ সংক্রমণের ৩ থেকে ১৪ দিন সর্বোচ্চ ২১ দিনের মধ্যে দেখা দেয়। প্রাথমিকভাবে আক্রান্তের শরীরে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশীতে ব্যথা, গলাব্যথা বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মত উপসর্গ দেখা দেয়। পাশাপাশি মাথা ঘোরা, তৃষ্ণা, অসংলগ্ন প্রলাপ বকা, বেঁহুশ হয়ে যাওয়া, বিভ্রান্তি এবং মস্তিষ্কের তীব্র সংক্রমণ জনিত স্নায়বিক লক্ষণ লক্ষ্য করা যায়। এমন লক্ষণ দেখা গেলে বুঝতে হবে রোগীর অবস্থা গুরত্বর। এছাড়াও কিছু লোক নিউমোনিয়া, তীব্র বুকে যন্ত্রণাসহ তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগতে পারেন। শ্বাসকষ্টবিহীন রোগী অপেক্ষা যে সকল রোগীর শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় তাদের মাধ্যমে এই রোগীটি বেশি ছড়িয়ে পড়ে। ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টায় আক্রান্ত রোগী অচেতনাবস্থায় চলে যেতে পারে। অল্পসংখ্যক মানুষ প্রাথমিক অবস্থায় ভালো হয়ে গেলেও পরবর্তীকালে মস্তিষ্কের সংক্রমণে ভুগতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার হার ৪০% থেকে ৭৫% পর্যন্ত হতে পারে।

সংক্রমণের মাধ্যমঃ

নিপাহ ভাইরাস একটি জুনেটিক ভাইরাস, যা প্রাণী থেকে মানুষে এবং আক্রান্ত মানুষ থেকে সুস্থ মানুষে সংক্রমিত হয়ে থাকে। মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে এই ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের সময় বেশিরভাগ মানুষের সংক্রমণের কারণ ছিল এই ভাইরাসে আক্রান্ত অসুস্থ শূকর বা তাদের দূষিত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে সরাসরি যোগাযোগ। এই সংক্রমণ শূকরের গলা বা নিঃশ্বাসের স্রাবের সাথে নিঃসৃত দূষিত ভাইরাস কণার মাধ্যমে ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

বাংলাদেশ এবং ভারতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে বাদুড়ের প্রস্রাব অথবা লালা দ্বারা দূষিত ফল এবং কাঁচা খেজুরের রস খাওয়ার মাধ্যমে। পরবর্তীতে প্রাদুর্ভাবের সময় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ থেকে সুস্থ মানুষের শরীরে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের শিলিগুড়িতে ভাইরাসটি স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের মাধ্যমে অন্যদের শরীরে ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। শিলিগুড়িতে সে সময় আক্রান্ত মানুষের ৭৫ শতাংশই ছিল হাসপাতালের কর্মচারী বা হাসপাতালে আসা অন্য রোগী এবং তাদের পরিজন। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে প্রায় অর্ধেক সংক্রমণ রোগীদের সেবাদানকারী নার্স বা ব্যক্তিদের মাধ্যমের এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।

রোগ নির্ণয়ঃ

নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের কোন নির্দিষ্ট প্রাথমিক লক্ষণ এবং উপসর্গ নেই। এবং প্রাথমিক সময়ে নিপাহ ভাইরাস রোগ হিসেবে প্রায়ই সন্দেহ করা হয় না। যা সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বাঁধা হতে পারে। পাশাপাশি প্রাদুর্ভাব শনাক্তকরণ ও যথাসময়ে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় একটি সমস্যা সৃষ্টি করে। উপরন্তু ক্লিনিকাল নমুনার পরিমাণ, মান, টাইপ সংগ্রহের সময়-জ্ঞান এবং পরীক্ষাগারে রোগীদের থেকে নমুনা স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ার ত্রুটি রোগ নির্ণয়ের ফলাফলকে প্রভাবিত করে থাকে।
রক্ত, প্রস্রাব, সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড ইত্যাদি শারীরিক তরল থেকে প্রকৃত সময় পলিমারেজ চেইন প্রতিক্রিয়া (RT-PCR) সহ প্রধান পরীক্ষার পাশাপাশি এলাইসা, কোষ কালচার দ্বারা ভাইরাসটিকে শনাক্ত করা হয়। রোগ থেকে সুস্থতা লাভের পরে ইমিউনোগ্লোবিউলিন জি এবং ইমিউনোগ্লোবিউলিন এম এন্টিবডি শনাক্ত করে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত করা হয়ে থাকে।

প্রকোপঃ

নিপাহ ভাইরাসের প্রকোপ সর্বপ্রথম মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে দেখা যায়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়ায় এর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ে। এসব দেশের মধ্যে এই ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে বাংলাদেশে। সাধারনত শীতকালে আমাদের দেশে এই রোগের বিস্তার ঘটে থাকে। যার মূল কারণ হচ্ছে কাচা খেজুরের রস পান করা। ১৯৯৮ সালে সর্বপ্রথম ভাইরাসটির সংক্রমণ মালয়েশিয়ার শূকর ও শূকর চাষীদের মধ্যে ছড়ায়। ১৯৯৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত সেখানে ১০৫ জন মারা যায় এবং ২৫৬ জন মানুষের মস্তিষ্কে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি সিঙ্গাপুরে ১ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি ১১ জনের মস্তিষ্কে সংক্রমণ এবং শ্বাসজনিত সমস্যা সৃষ্টি হতে দেখা যায়। আমাদের দেশে ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় এই ভাইরাসের সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। পাশাপাশি ভারতের শিলিগুড়িতেও একই সময় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর আসে। পরবর্তীতে ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে নওগাঁ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় এই রোগের প্রকোপ দেখা যায়। এবং ধীরে ধীরে পরবর্তী বছরগুলোতে বিভিন্ন জেলায় এর ভাইরাসের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ২০১৮ সালে ভারতের কেরেলা রাজ্যের কোঝিকোড় জেলায় নিপাহ ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়, এবং একজন নার্সসহ ১৩ জন মারা যায়। ২০২৩ সালের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে সর্বমোট ৩৩৯ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত এবং ২৪০ জন মৃত্যুবরণ করেছে বলে নথিভুক্ত হয়েছে।

চিকিৎসাঃ

এখন পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসের অনুমোদিত কোনো ভ্যাক্সিন বা ঔষধ আবিষ্কার করা যায়নি। সুতরাং নিপাহ ভাইরাসের কোনো চিকিৎসা নেই বর্তমানে। সহায়ক চিকিৎসার দ্বারা এই উপশমের চেষ্টা করা হয়। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত এমন সন্দেহভাজন প্রতিটি ব্যক্তিকে আলাদা করে রেখে প্রগাঢ় সহায়ক চিকিৎসা প্রদান করা জরুরী। পরীক্ষাগারে বিবাভিরিনের কার্যকারিতা লক্ষ্য করা গেলেও মানবদেহে এর প্রভাব এখনো প্রমাণিত হয়নি। তবে নিপাহ জি গ্লাইকোপ্রোটিনের বিরুদ্ধে উৎপাদিত একটি হিউম্যান মনোক্লোনাল এন্টিবডি ব্যবহার করে টিকাকরণের পরীক্ষা চলছে।নিপা ভাইরাসের পূর্ণতালাভে ক্লোরোকুইন অন্তরায় সৃষ্টি করলেও এখন পর্যন্ত মানবদেহে এর কার্যকারিতা পরীক্ষিত নয়। এসবের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ায় হিউম্যান এন্টিবডি M102.4 মানবদেহে ট্রায়াল দেওয়া হয়েছে।

প্রতিরোধঃ

নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের কোনো কার্যকরী চিকিৎসা না থাকায় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বাদুড় ও রুগ্ন শূকর থেকে দূরে থেকে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। পাশাপাশি বাদুড়ের লালা বা প্রস্রাব মিশ্রিত অথবা বাদুড়ে খাওয়া ফল, বাদুড়ের বর্জ্যমিশ্রিত খেজুরের রস পান করা এবং বাদুড়ে পুর্ণ কুয়োর পানি ব্যবহার না করার মাধ্যমে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। সাধারণত বাদুড় খোলা পাত্রে সংগ্রহীত খেজুঁরের রস পান করে এবং মাঝে মাঝে প্রস্রাব করে থাকে। ফলে সেই রস পান করার ফলে নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে। বাদুড়ের প্রজননের সঙ্গে এই রোগের সম্পর্কিত কি না সেই বিষয়টি এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়নি। হাসপাতাল সঞ্জাত সংক্রমণ প্রতিরোধ করার প্রমাণ ব্যবস্থাগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। হেন্ড্রা জি প্রোটিন নির্মিত একটি টিকা বানরের হেন্ড্রা ভাইরাসের সংক্রমণে ব্যবহার করা হয়েছে। এই টিকা হেনিপাহ ভাইরাস এবং নিপাহ ভাইরাসের বিরুদ্ধেও এন্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম। তবে মানুষের উপর এখন পর্যন্ত এই টিকার প্রভাব নির্ণীত হয়নি।

Leave a Comment