নিউরোব্লাস্টোমা এক ভয়ানক ক্যান্সার।

নিউরোব্লাস্টোমা (Neuroblastoma)

 

নিউরোব্লাস্টে সৃষ্টি হওয়া অপরিণত স্নায়ুকোষ যা ভ্রুণের উপর তার বিকাশের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গঠন করে নিউরোব্লাস্টোমা। ভ্রুণ পরিপক্ক হওয়ার সাথে সাথে নিউরোব্লাস্টগুলোও স্নায়ুকোষ এবং তন্তুগুলোর মধ্যে পরিণত হতে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই নিউরোব্লাস্টগুলো পরিপক্ক হয়ে উঠে অথবা শেষ পর্যন্ত এগুলো কিছু সময়ের মধ্যে কার্যক্ষমতা হারিয়ে কোষের বা তন্তুর মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু যেসকল ক্ষেত্রে এই নিউরোব্লাস্টগুলো কার্যকর হয়ে থেকে যায়, সেই সকল ক্ষেত্রে এইসব অপরিপক্ক স্নায়ুকোষগুলো কোষের মধ্যে পিন্ড বা টিউমার তৈরি করে থাকে। আর এই টিউমাকেই বলা হয় নিউরোব্লাস্টোমা বা নিউরোব্লাস্টোমা ক্যান্সার।

নিউরোব্লাস্টামো হচ্ছে এক ধরণের বিশেষ ক্যান্সার, যা অপরিণত কোষ (immature nerve cells) এর মাধ্যমে মানব দেহে সৃষ্টি হয়। এই ক্যান্সার শরীরের বিভিন্ন স্থানকে আক্রান্ত করতে সক্ষম। এই ক্যান্সার সাধারণত এন্ড্রিনাল গ্রন্থ এবং এর আশেপাশের অংশকে আক্রান্ত করে থাকে। এছাড়াও এই ক্যান্সার পেটের অন্যান্য অঙ্গগুলোর পাশাপাশি বুক, ঘাড় এবং মেরুদণ্ড এবং আশেপাশের স্নায়ু কোষগুলোর গ্রুপ রয়েছে এমন অঙ্গগুলোকে আক্রান্ত করতেও সক্ষম।

সাধারণত নিউরোব্লাস্টামো ক্যান্সারে পাঁচ বছর বা তারচেয়ে কম বয়স এমন বাচ্চাদের বেশি আক্রান্ত করে থাকে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের বড় এমন বাচ্চাদেরও এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।

প্রাথমিকভাবে কোন জেনেটিক পরিবর্তনের কারণে নিউরোব্লাস্টোমা বেড়ে থাকে তা এখনও সকলের অজানা। তবে শরীরের ওজন কমে যাওয়া, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ, ডায়েট, অনিয়মিত জীবন-যাপন এবং তামাকের ব্যবহারের মত বেশ কয়েকটি কারণ বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সারে বিরাট ভূমিকা পালন করে বলে গবেষণায় দেখা যায়। তবে এই কারণগুলো ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে অনেক সময় নেয় বলে নিউরোব্লাস্টোমার মতো শৈশব ক্যান্সারে খুব বেশি ভূমিকা পালন করবে বলে বিবেচনা করা হয় না। আবার পরিবেশগত কারণকেও এই রোগের কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।

তবে গর্ভকালীন সময়ে মায়ের ধুমপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন বা কক্ষে পিতার ধুমপান বা মাদক সেবনের প্রভাবে সন্তান এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

পূর্বসূরি এক বা একাধিক ব্যক্তি নিউরোব্লাস্টোমায় আক্রান্ত ছিল বা সন্তানের বাবা বা মা শৈশবে আক্রান্ত হয়েছিল এমন ইতিহাস থাকলে সন্তানের নিউরোব্লাস্টোমায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

ফ্যামিলিয়ার নিউরোব্লাস্টোমায় আক্রান্ত শিশুদের দুই বা দুইয়ের অধিক অঙ্গে নিউরোব্লাস্টোমা ক্যান্সার আক্রমণ করতে পারে। উদাহরণস্বরুপ বলা যেতে পারে, এ ধরণের শিশুদের এন্ড্রিনাল গ্রন্থি এবং একাধিক সহানুভুতিশীল গ্যাংলিওন এই উভয় ক্ষেত্রে এই ক্যান্সারের বিকাশ ঘটতে পারে।

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মগত ত্রুটি রয়েছে এমন শিশুদের দেহে নিউরোব্লাস্টোমা হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এর কারণ হতে পারে, জন্মগত ত্রুটি এবং নিউরোব্লাস্টোমার মধ্যে কিছু লিংক রয়েছে, যা ভ্রুণের বিকাশ ঘটার সময় জিনের পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত।

 

লক্ষণ (Symptoms)

 

শরীরের কোন অংশ আক্রান্ত হয়েছে বা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে নিউরোব্লাস্টোমার সংকেত আর লক্ষণগুলো পৃথক বা ভিন্ন হতে পারে। আসুন জানার চেষ্টা করি শরীরের কোন অংশ আক্রান্ত হলে কি কি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

 

পেটের নিউরোব্লাস্টোমা (Neuroblastoma in the Abdomen):

পেটের নিউরোব্লাস্টোমায় আক্রান্ত হয়েছে এমন রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এসকল রোগীর মধ্যে কিছু লক্ষণ ও সংকেতে মিল পাওয়া যায়। লক্ষণগুলো হচ্ছে-

* পেটে ব্যথা,

* অন্ত্র স্থানের পরিবর্তন। অর্থাৎ, ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য,

* পেটের ত্বকের নিচে একটি মাংসপিন্ড বা টিউমার তৈরি হওয়া, যা স্পর্শকালে কোমল হয় না, শক্ত অনুভূতি হয়।

বুকের নিউরোব্লাস্টোমা (Neuroblastoma in the chest):

নিচের সংকেত ও লক্ষণগুলো বুকে নিউরোব্লাস্টোমায় আক্রান্ত রোগীদের মাঝে বেশি লক্ষ্য করা যায়।

* বুক ব্যথা,

হুইজিং (Wheezing)

* চোখের পরিবর্তন; এর মধ্যে চোখের পলক এবং অসমান পলকের আকার লক্ষণীয়।

এসব লক্ষণ ছাড়াও নিচের লক্ষণগুলোও নিউরোব্লাস্টোমা রোগে আক্রান্ত রোগীদের মাঝে লক্ষ্য করা যায়।

♦জ্বর

♦হঠাৎ অতিরিক্ত ওজন কমে যাওয়া,

♦পিঠে ব্যথা,

♦হাড়ে ব্যথা

♦চোখের বলগুলো সকেট (Sockets) থেকে প্রসারিত বলে মনে হওয়া,

♦ত্বকের নিচের টিস্যুগুলো গলিত বা গলে গেছে এমন মনে হওয়া ইত্যাদি।

যদি আপনার বা আপনার পরিবাবারে থাকা সন্তানদের শরীরে এমন কোন লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় তাহলে এটি আপনার বা আপনার পরিবারের সকলের উদ্বেগের কারণ হতে পারে। তাই এসব লক্ষণের মধ্যে যদি কোন একটি লক্ষণ শিশুর মাঝে দেখতে পাওয়া যায়, তাহলে দেরি না করে দ্রুত ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে শিশুর চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন।

এই ক্যান্সারটি সাধারণত জেনেটিক মিউটেশন (Genetic Mutation) এর মাধ্যমে শুরু হয়ে থাকে। যা স্বাভাবিক আর স্বাস্থ্যকর কোষগুলোকে থামার সিগন্যাল না দিয়ে আরও বেড়ে উঠতে সহায়তা করে। ফলে ক্যান্সারের কোষগুলোর ক্রমবর্ধমান অব্যাহত থাকে এবং এক সময় কোষগুলো নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়। ফলে, ক্রমবর্ধমান এই কোষগুলো একটি পিন্ড বা টিউমারে রুপান্তরিত হয়। সেখান থেকেই তৈরি হয় এই নিউরোব্লাস্টোমা ক্যান্সারের।

নিউরোব্লাস্টোমা নির্ণয়, এর চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের উপায় কি! সেই বিষয়ে বিস্তারিত থাকবে আপনাদের চাহিদার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী পোস্টে। 

 

–Rumel Rahma

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *