জ্বর ঠোসা.. স্বাভাবিক ভাবলেও অন্ধত্বের অন্যতম কারণ, ঘটায় মৃত্যুও

জ্বর ঠোসা…

জ্বর ঠোসা খুবই কমন ও স্বাভাবিক একটি রোগ হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। কিন্তু জানেন কি? সারাবিশ্বে প্রতিবছর যত মানুষ অন্ধ হয়ে যায়, তার বিশাল এক অংশ এই জ্বর ঠোসার ভাইরাসের কারণেই অন্ধত্ব বরণ করে। শুধু তাই নয়, যৌনাঙ্গের ভয়াবহ রোগ হার্পিস পর্যন্ত ঘটায় এই জ্বর ঠোসার ভাইরাস। আর এই হার্পিস রোগ সম্পূর্ণ নির্মূলের কোনো উপায়ই এখন পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে সক্ষম হয় নি। আবার নবজাতকের দেহে এই জীবাণুটি ছড়িয়ে গেলে সেই নবজাতকের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

আমাদের অধিকাংশের মাঝেই একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে। আর তা হচ্ছে, রাতে জ্বর আসলে মানুষের শরীরে জ্বর ঠোসা বের হয়। এটি একেবারেই ভুল ধারণা।

সুতরাং, সাধারণ ভেবে নেওয়া এই জ্বর ঠোসাকে অবহেলা না করে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
আসুন তাহলে জ্বর ঠোসা সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেই এবং সতর্ক হই।

জ্বর ঠোসা কেন হয়ঃ

জ্বর ঠোসা ভাইরাস জনিত একটি রোগ। সাধারণত ভাষায় বললে এটি ছোঁয়াচে রোগ। রোগীর সংস্পর্শে আসলে যে কোনো ব্যক্তি এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। মানুষের দেহে ‘হার্পিস সিমপ্লেক্স’ নামের এক ধরণের ভাইরাসের প্রভাবে এই রোগটি হয়ে থাকে। এই ভাইরাস বিভিন্নভাবে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যেমন–

★ জ্বর ঠোসা স্পর্শ করে সেই হাত ভালোভাবে না ধুয়ে অন্য কারও মুখে স্পর্শ করলে অপর ব্যক্তি এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

★ জ্বর ঠোসায় আক্রান্ত ব্যক্তির মুখ অথবা মুখের লালার সংস্পর্শে আসলে জ্বর ঠোসা হতে পারে।

★ জ্বর ঠোসা হয়েছে এমন ব্যক্তি কারও যৌনাঙ্গে মুখ দিলে যৌনাঙ্গে ইনফেকশন প্রবলভাবে ছড়িয়ে যেতে পারে। আবার যৌনাঙ্গে মুখ দিলে সেই ব্যক্তিরও গনোরিয়া, ওরাল ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
কারও শরীরে একবার জ্বর ঠোসার ভাইরাস প্রবেশ করলে তা সারাজীবন শরীরের থেকে যায়। বেশিরভাগ সময় এই ভাইরাস নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকলেও মাঝে মাঝে জেগে উঠে। আর তখনই আমাদের শরীরে (সচরাচর মুখের বিভিন্ন অংশে) জ্বর ঠোসা দৃশ্যমান হয়ে থাকে। আর এই ভাইরাস সক্রিয় হলেই বারবার বা মাঝে মাঝে জ্বর ঠোসা দেখা হয়ে থাকে।
এই ভাইরাস শরীরে সক্রিয় হয়ে উঠার কারণ হচ্ছে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাওয়া। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কিছু লক্ষণ রয়েছে। যেমন: ঠান্ডা লাগা, জ্বর আসা, শারীরিক দুর্বলতা, ঝিমুনি ইত্যাদি। শুধু যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলেই এই ভাইরাস সক্রিয় হয় এমনটা নয়। আরও কিছু কারণ আছে, যার কারণে এই ভাইরাস সক্রিয় হতে পারে। এসবের মধ্যে খুব ক্লান্ত থাকলে, মানসিক চাপে থাকলে, কোনো কারণে অসুস্থ হলে, মেয়েদের মাসিকের সময়ে এবং খুব বেশি রোদে গেলে এই ভাইরাস সক্রিয় হয়ে জ্বর ঠোসা হতে পারে।

জ্বর ঠোসা হয়েছে কিভাবে বুঝবেনঃ

হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস সক্রিয় হল মুখমন্ডলের যে কোনো জায়গায় জ্বর ঠোসা উঠতে পারে। যে স্থানে জ্বর ঠোসা উঠবে, আগে থেকেই সেই স্থানে ঝিমঝিম করা, জ্বালাপোড়া অথবা চুলকানি শুরু হতে পারে। এই লক্ষণগুলো দেখা দেওয়ার পরবর্তী ৬-৪৮ ঘন্টার মাঝে আরও কিছু লক্ষণ দেখা দিয়ে থাকে। আর সেগুলো হচ্ছে–
* ছোটো ছোট ফোস্কা বা ঠোসা উঠবে এবং এসব ঠোসার মধ্যে পানির মত তরল পদার্থ থাকে।
* ফোস্কাগুলো ফেটে যায় এবং ফেটে গিয়ে সেগুলোর উপরে আস্তে আস্তে চলটা পড়া শুরু করে।
সচরাচর ১০ দিনের মধ্যে জ্বর ঠোসা সেরে উঠতে শুরু করে। সম্পূর্ণ সেরে উঠার আগে পর্যন্ত এটি ছোঁয়াচে হয়ে থাকে। ভালো হওয়ার আগে পর্যন্ত জ্বালাপোড়া অথবা ব্যথা অনুভব হয়ে হতে পারে।

জ্বর ঠোসা কতদিন ছোঁয়াচে থাকেঃ

যখন থেকে ঝিমঝিম, জ্বালাপোড়া বা চুলকানি শুরু হয়, তখন থেকেই উক্ত স্থানে হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস সক্রিয় হয়ে থাকে। অর্থাৎ এই সময় থেকেই এটি ছোঁয়াচে। সেই দিন থেকে যতদিন পর্যন্ত জ্বর ঠোসা সম্পূর্ণ সুস্থ না হয় ততদিন পর্যন্ত এটি ছোঁয়াচে। বিশেষ করে যখন ঠোসা কাঁচা থাকে এবং ভিতরের পানি গলে যায় তখন এটি সবচেয়ে বেশি বিপদজনক।
তাই ঝিমঝিম করা, জ্বালাপোড়া বা চুলকানি শুরু হলে তখন থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে।এবং অবশ্যই নিচের নির্দেশনাগুলো মেনে চলতে হবে।

★ সম্ভব হলে পানি পানের পাত্র, প্লেট আলাদা ব্যবহার করতে হবে। আলাদা করা সম্ভব না হলে পানি পান করার পরে বা খাবার গ্রহণের পরে ডিস ওয়াশ দিয়ে ভালোভাবে গ্লাস ও প্লেট ধুয়ে ফেলতে হবে।

★ ঝিমঝিম করা, জ্বালাপোড়া বা চুলকানি শুরু হলে তখন থেকেই উক্ত স্থানে অ্যান্টিভাইরাল ক্রিম ব্যবহার করলে সবচেয়ে ভালো হয়। এর ফলে জ্বর ঠোসা দ্রুত সেরে যেতে পারে।

কি কি সতর্কতা অবলম্বন করবেনঃ

জ্বর ঠোসাকে হালকা ভাবে দেখা যাবে না। আবার জ্বর ঠোসা উঠলে ভয়ের কিছু নেই। কিছু সতর্ককা অবলম্বন করলেই নিজেকে এবং পরিবারসহ অন্যদের সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। সাবধানতাগুলো হচ্ছে-

★ চোখের সুরক্ষা:
মানুষের চোখের সামনে একটি স্বচ্ছ আবরণ থাকে, যাকে আমরা ‘কর্নিয়া’ বলে জানি। কর্নিয়া চোখের জানালা হিসেবে কাজ করে থাকে। এই কর্নিয়ার সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীতে যত মানুষ অন্ধ হয়ে যায় তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ জ্বর ঠোসার ভাইরাস হার্পিস সিমপ্লেক্সে আক্রান্ত হয়ে থাকে। আর তা নিজেদের অজান্তেই। অর্থাৎ নিজেদের অজান্তেই মুখের জ্বর ঠোসার এই হার্পিস ভাইরাস যদি কোনোভাবে মানুষের চোখে চলে যায়, তাহলে অন্ধত্বের মত মারাত্মক বিপত্তি ঘটার একটা প্রবল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
জ্বর ঠোসা থেকে অন্ধত্ব প্রতিরোধে ৪টি করনীয় আছে। এই করণীয়গুলো হচ্ছে–
১. জ্বর ঠোসা হলে জ্বর ঠোসায় হাত লাগাবেন না,
২. জ্বর ঠোসায় হাত লাগিয়ে ফেললে দ্রুত ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে,
৩. জ্বর ঠোসা থাকা অবস্থায় ভুলেও চোখে হাত লাগানো যাবে না।
৪. চোখে সমস্যা দেখা দিলে বা হাত লাগাতে হলে প্রথমে ভাবোভাবে সাবান/হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে চোখ ধুয়ে নিতে পারেন। এবং হাত লাগানোর পরে পুনরায় হাত ধুয়ে নিতে হবে।
চোখ হার্পিস ভাইরাসের সংস্পর্শে আসলেই বা এই ইনফেকশন হলেই যে মানুষ অন্ধ হয়ে যায় এমনটা নয়। অনেকের এর ইনফেকশন হওয়ার পরে সেরে যায়। তাই ইনফেকটেড হলেই যে অন্ধ হয়ে যাবে এমন ধারণা পোষণ করার প্রয়োজন নেই। তবে কিছু সংখ্যক মানুষের ক্ষেত্রে এই ইনফেকশন জটিল রুপ ধারণ করতে পারে। সুতরাং ভয় না পেয়ে সতর্ক থাকাই উত্তম।

★ যৌনাঙ্গের হার্পিস থেকে সুরক্ষাঃ
কারও যৌনাঙ্গ জ্বর ঠোসার সংস্পর্শে আসলে যৌনাঙ্গের হার্পিস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। জ্বর ঠোসার ন্যায় যৌনাঙ্গে হার্পির ভাইরাস হলে এটিও সম্পূর্ণ সারিয়ে তোলা অসম্ভব। আবার নারীদের যৌনাঙ্গে হার্পিস হয়ে সন্তান প্রসবের সময় এই রোগটি নারী থেকে নবজাতকের শরীরেও ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
এজন্য জ্বর ঠোসা পুরোপুরি সেরে ওঠার আগে কখনোই ওরাল সেক্স করা যাবে না। এমন অবস্থায় ওরাল সেক্স থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। না হলে আপনার থেকে এই রোগ আপনার সঙ্গীর যৌনাঙ্গে এবং সেখান থেকে আপনার নবজাতকের শরীরে ছড়িয়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়ে যায়। আর ওরাল সেক্স হারাম বলা না হলেও এটি অপছন্দনীয় কাজ। এর ফলে মুখে নানা রকম অসুখ এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।

★ নবজাতক এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল এমন মানুষের ক্ষেত্রে করণীয়ঃ
যে সকল মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের ক্ষেত্রে হার্পিস ভাইরাসটি ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে। কেমোথেরাপি নিচ্ছে বা স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ খাচ্ছেন এমন রোগী, গর্ভবতী নারী, ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তি বিশেষভাবে সাবধানে থাকতে হবে। কারণ সাধারণ জ্বর ঠোসাও এই শ্রেনীর মানুষের শরীরে মারাত্মক ইনফেকশন ঘটিয়ে বিশেষ ক্ষতি করতে পারে। এসকল রোগী জ্বর ঠোসা থাকা অবস্থায় নবজাতক বা শিশুদের চুমু দিলে শিশুরাও মারাত্মক ইনফেকশনের শিকার হতে পারে। এমনকি ইনফেকশনের প্রভাবে শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
আবার মায়ের স্তনে যদি জ্বর ঠোসা হয়ে থাকে, আর শিশুকে এই অবস্থায় সেই স্তন থেকে দুধ পান করানো।হয়, তাহলে সেই শিশুর শরীরেও এই ইনফেকশন ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য নবজাতকের দিকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ছোট শিশুদের গুরুতর ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
কোনো ব্যক্তির একজিমা নামক চর্মরোগ থাকলে জ্বর ঠোসার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এই রোগে আক্রান্ত রোগীর চামড়ার ক্ষতর মধ্য দিয়ে জ্বর ঠোসার ভাইরাস শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে প্রাণঘাতী ইনফেকশনে রুপ নিতে সক্ষম।

★ স্মৃতিশক্তির সংক্রান্ত ‘আলঝেইমার’ রোগীর সুরক্ষাঃ
স্মৃতিশক্তি কমে গেছে, একই প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞেস করে, কথা মনে রাখতে পারে না অথবা কথা বলতে গেলে কথা খুঁজে পায় না এমন বয়ষ্ক মানুষ আমাদের আশেপাশে প্রায়ই দেখা যায়। এগুলো সকল লক্ষণই ‘আলঝেইমার’ এর।

সম্প্রতি বেশ কিছু গবেষণা থেকে জানা যায় যে, জ্বর ঠোসা সৃষ্টিকারী ভাইরাস হার্পিসে আক্রান্ত হওয়ার সাথে আলঝাইমার রোগের সম্পর্ক পাওয়া যায়। যদিও এই এই ভাইরাসের কারণেই আলঝাইমা রোগ হয় কি না সেই বিষয়ে এখনও কোনো গবেষক নিশ্চিত নয়। তবে গবেষণায় এই আক্রান্তের বিষয়ে বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে৷ সুতরাং যদি কোনো মানুষের জ্বর ঠোসা হয়ে থাকে, তাহলে নিজের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বারা অন্য কেউ এই ভাইরাসে সংক্রামিত না হয় সেই বিষয়ে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে বয়ষ্ক মানুষের থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে। কারণ একবার এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে সারা জীবন শরীরের মধ্যে থেকে যায়। আর এই ভাইরাসের প্রভাবে বৃদ্ধ মানুষের আলঝাইমার, চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ার মত মারাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়া সঙ্গীর যৌনাঙ্গে হার্পিস, নবজাতকের আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত ঘটতে পারে।

জ্বর ঠোসা হলে কি করা উচিতঃ

জ্বর ঠোসা হলে সচরাচর নিজে থেকেই সেরে যায়। আর সেরে যাওয়ার পরে সাধারণত উক্ত স্থানে কোনো দাগও থাকে না। তবে উপশমে কিছু কাজ করা যেতে পারে।

‌‌‌১. অ্যান্টিভাইরাল ক্রিম বা মলম ব্যবহারঃ
জ্বর ঠোসা হবে এমন মনে হলে অর্থাৎ মুখে ঝিমঝিম, জ্বালাপোড়া বা চুলকানি অনুভব করার সাথে সাথেই অ্যান্টিভাইরাল ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে। এর ফলে দ্রুত জ্বর ঠোসা সেরে উঠতে পারে। ক্রিম লাগানোর সময় জ্বর ঠোসায় ঘষে ঘষে লাগানো যাবে না। আঙুল দিয়ে আলতো করে চেপে চেপে লাগাতে হবে। আর অবশ্যই ক্রিম বা মলম লাগানোর আগে এবং পরে অবশ্যই হ্যান্ড ওয়াশ বা সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে।

২. মধু ব্যবহারঃ
মধুকে বলা হয় মহৌষধ। কিছু গবেষণায় অ্যান্টিভাইরাল ক্রিমের পরিবর্তে জ্বর ঠোসায় কানুকা মধু ব্যবহার করে দেখা গেছে অ্যান্টিভাইরাল ক্রিমের মতই কাজ করছে মধু। কানুকা বা খাঁটি যে কোনো মধু ব্যবহার করে দেখা যেতে পারে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর ঠোসায় এটি কাজ করছে কি না। জ্বর ঠোসা সম্পূর্ণ ভালো না হওয়া পর্যন্ত দিনে ৫ বার জ্বর ঠোসার উপরে এই মধু ব্যবহার করতে হবে।

৩. ব্যথা কমানোর উপায়ঃ
জ্বর ঠোসা উঠলে অনেকের ব্যথা হয়। এই ব্যথা মৃদু থেকে তীব্র হতে পারে৷ এই ব্যথা কমানোর জন্য কয়েকটা উপায় আছে। সুবিধা অনুযায়ী যে কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারেন—
→ বরফঃ জ্বর ঠোসার স্থানে বরফ লাগানোর মাধ্যমে বা বরফের ছোট ছোট টুকরো চুষে খাওয়া যেতে পারে৷ এর ফলে ব্যথার পাশাপাশি জ্ব্বলাপোড়া এবং চুলকানিও কমে যেতে পারে।

→ ঠান্ডা সেঁকঃ দিনে কয়েকবার ঠান্ডা সেঁক দেওয়ার মাধ্যমে লালচে ভাব ও জ্বালাপোড়া কমানো যেতে পারে। ছোট পরিষ্কার তোয়ালে ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে সেই তোয়ালে ৫-১০ মিনিট জ্বর ঠোসার উপরে দিয়ে রাখতে পারেন। দিনে ৫-৭ বার এমন করতে হবে।
→ মলমঃ উপরের পদ্ধতিগুলো কাজ না করলে জ্বর ঠোসায় লিডোকেইন জাতীয় জেল বা মলম ব্যবহার করা যাবে।
→ ঔষধঃ ফোলা, জ্বর ও ব্যথা কমাতে প্যারাসিটামল অথবা আইবুপ্রোফেন ঔষধ খাওয়া যেতে পারে। শিশুরা জ্বর ঠোসায় কষ্ট পেলে বা জ্বর আসলে প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়াবেন।

৪. পানি শূন্যতা রোধঃ
জ্বর ঠোসা হলে অনেকের তীব্র ব্যথা হয়ে থাকে। আর এই ব্যথার কারণে অনেকেই পানি পান বা খাবার খাওয়া কমিয়ে দেয়। এর ফলে অনেকের দেহে পানি শূন্যতা দেখা দেয়। ব্যথা হোক বা অন্য যে কোনো সমস্যা, পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। পানি শূন্যতা রোগ কমানোর থেকে বাড়িয়ে দেয়।

৫. পেট্রোলিয়াম জেলিঃ
অনেকের ত্বক শুষ্ক হয়ে থাকে। আবার পর্যাপ্ত পানি পান না করার কারণে ঠোঁট বা ত্বক ফেটে যায়। শুষ্ক ত্বক ফেঁটে যাওয়া রোধে জ্বর ঠোসার উপরে এবং এর আশেপাশে আলতো করে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগাতে হবে। তবে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগানোর আগে এবং পরে অবশ্যই সাবান/হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।

৬. রোদ থেকে সুরক্ষাঃ

রোদে UV-B রশ্মি থাকে যা ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। জ্বর ঠোসায় আক্রান্ত থাকলে এই সময় উক্ত স্থানের ত্বক আরও শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। তাই রোদে বের হলে ভালো সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে SPF 15 বা তার থেকে বেশি শক্তির সানব্লক লিপ বাম ব্যবহার করতে হবে।

৭. ঘনঘন ঠোসা হওয়া রোধে করণীয়ঃ
রোদ, মানসিক চাপ, অতিরিক্ত ক্লান্তি, ভিটামিন সি যুক্ত খাবার গ্রহণ না করা ইত্যাদি বারবার জ্বর ঠোসা হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দিতে পারে। এই সকল কাজ জ্বর ঠোসার ভাইরাসকে জাগিয়ে দিতে পারে। তাই এই সকল কাজ এড়িয়ে চলতে হবে। এর ফলে পরবর্তীতে জ্বর ঠোসা হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা কমে যাবে।

জ্বর ঠোসা হলে যা যা করবেন নাঃ

★ কখনোই জ্বর ঠোসা হাত দিয়ে স্পর্শ করবেন না। ঔষধ লাগানো, বরফ দেওয়া ইত্যাদি সময়ে হাত দেওয়ার আগে ও পরে অবশ্যই ভালোভাবে সাবান/হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।

★ আক্রান্ত অবস্থায় কাউকে চুমু দেওয়া যাবে না। বিশেষ করে নবজাতক বা ছোট শিশুদের একেবারেই চুমু দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এটি না করলে আক্রান্ত ব্যক্তি নবজাতক বা শিশুর মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে।

★ জ্বর ঠোসা হলে চোখে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে ঘুম থেকে উঠার পরে অবশ্যই এই কাজ করা যাবে না। কোনো কারণে চোখে হাত দিতে হলে অবশ্যই আগে হ্যান্ড ওয়াশ বা সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে। এবং হাত দেওয়ার পরেও হাত ধুয়ে নিতে হবে।

★ মাল্টা, জাম্বুরা, টমেটো, কমলা, অতিরিক্ত মসলাদার খাবার এবং লবণ যুক্ত খাবার জ্বর ঠোসার সংস্পর্শে আসলে জ্বালাপোড়া হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির এসব খাবারে জ্বালাপোড়া হলে এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।

★ জ্বর ঠোসা থাকা অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তির খাবার অথবা পান করা পানি অন্যজনের সাথে শেয়ার করা যাবে না। প্লেট ও গ্লাস আলাদা করে ফেললে সবচেয়ে ভালো। আর ব্যবহারের পরে অবশ্যই ভালোভাবে ডিস ওয়াশ দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।

★ জ্বর ঠোসায় ছোঁয়া লাগে এমন জিনিসপত্র আলাদা করে রাখতে হবে। গ্লাস, চামচ, রেজার, তোয়ালে, লিপ জল, লিপস্টিক ইত্যাদি আলাদা রেখে ব্যবহার করতে হবে।

★ খুবই জরুরী না হলে জ্বর ঠোসা থাকা অবস্থায় দাঁতের কোন প্রসিডিওর না করানোই ভালো। সম্পূর্ণ সেরে যাওয়ার পরে দাঁতের কাজ করাটাই উত্তম।

★ জ্বর ঠোসা থাকা অবস্থায় ওরাল সেক্স বা যৌনাঙ্গে মুখ স্পর্শ করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। না হলে আক্রান্ত ব্যক্তি হার্পিস ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ঠোঁটে চুম্বন থেকেও বিরত থাকতে হবে। জ্বর ঠোসা হলে সহবাসে কোনো বাঁধা নেই।

জ্বর ঠোসার ঔষধঃ

জ্বর ঠোসা সারানোর জন্য নিচে দেওয়া ‘ওভার দা কাউন্টার’ ঔষধগুলো ব্যবহার করতে পারেন। ওভার দা কাউন্টার ঔষধগুলো বাসার আশেপাশের ফার্মেসীতেই পাওয়া যাবে। তবে ঔষধগুলো কিনে ঔষধের সাথে থাকা নির্দেশিকা পড়ে সেই অনুযায়ী ব্যবহার করা নিরাপদ৷ তবে উপযুক্ত ডোজ সম্পর্কে নিশ্চিত না হলে বা ঔষধের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই একজন ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে ঔষধ সেবন করতে হবে।

১. মলম বা ক্রিমঃ
জ্বর ঠোসার চিকিৎসায় অ্যান্টিভাইরাল ক্রিম ব্যবহার করা যাবে। এসাইক্লোভির জাতীয় মলম বা ক্রিম এই ক্ষেত্রে খুবই ভালো কাজ করে। এই ক্রিম দিনে ৫ বার করে অন্তত ৪ দিন ব্যবহার করতে হবে। তবে ব্যবহারের আগে অবশ্যই নির্দেশিকা পড়ে নিতে হবে। এক এক কোম্পানি এক এক নামে এই জাতীয় ক্রীম বাজারে এনে থাকে। ক্রিমের নাম ও কোম্পানির নাম নিচে দেওয়া হলোঃ
★ ভাইরাক্স → স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড
★ অ্যাসেরাক্স → অপসনিন ফার্মা লিমিটেড
★ নোভাইরাক্স → ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড
★ ভাইরিনিল → গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড
★ সিমপ্লোভির → ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড
★ ভাইরক্সি → এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড

২. ব্যথা কমানোর মলমঃ
জ্বর ঠোসা হলে অনেকেই তীব্র বা মাঝারি ব্যথা অনুভব করে। এই ব্যথা কমাতে লিডোকাইন জাতীয় জেল অথবা মলম ব্যবহার করা যায়। তবে ব্যবহার করার আগে অবশ্যই ভিতরে থাকা নির্দেশনা পড়ে সেই নিয়ম ও পরিমাণ অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এসব মলম সরাসরি ব্যবহার না করে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে তার পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে।
ফার্মেসীতে যে সকল নামে যে সকল কোম্পানির মলম পাবেন–
★ জেসোকাইন → জেসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড
★ জেড-লিডোকেইন → জিসকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড
★ জাইলোজেল → ইউনিমেড ইউনিহেলথ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড

৩. প্যারাসিটামল অথবা আইবুপ্রোফেনঃ
জ্বর ঠোসার কারণে ব্যথা, ব্যথায় আসা জ্বর এবং ফোলা কমাতে প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ঔষধ খাওয়া যেতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে ট্যাবলেট না ক্যাপসুল খাওয়ানো যাবে না। শিশুদের প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়াতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়েই তাদের পরামর্শ অনুযায়ী সকল ঔষধ খাওয়াতে হবে।

কখন ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে:

সচরাচর জ্বর ঠোসা একা একাই ভালো হয়ে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে। ব্যক্তি, জ্বর ঠোসার অবস্থান ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে কিছু মানুষকে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হয়। সেগুলো হচ্ছে–

★ চোখের আশেপাশে জ্বর ঠোসা উঠলে,

★ জ্বর ভালো না হলে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে।

★ গর্ভবতী নারী, ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তি, কেমো থেরাপি বা রেডিও থেরাপি নিচ্ছে এমন ব্যক্তি, ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তি এবং স্টরয়েড নিচ্ছে এমন ব্যক্তিদের সচরাচর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। এই সকল ব্যক্তিকে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে।
★ যৌনাঙ্গ, হাত, পা বা শরীরের অন্য কোথাও জ্বর ঠোসা ছড়িয়ে পড়লে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।

★ অনেকখানি জায়গা জুড়ে জ্বর ঠোসা উঠলে বা জ্বর ঠোসা ছড়িয়ে পড়েলে এবং জ্বর ঠোসা ১০-১২ দিনের বেশি সময়েও ভালো হওয়া শুরু না হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

★ তীব্র ব্যথা হলে এবং ব্যথায় খাবার ও পানি পান করতে সমস্যা হলে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে।
★ মাড়ি ফুলে গিয়ে ব্যথা হলে এবং মুখের ভিতরে ঘা হলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কারণ মাড়ি ফুলে যাওয়া এবং মুখে ঘা হওয়া ইনফেকশনের অন্যতম লক্ষণ।
★ কিছুদিন পরপর জ্বর ঠোসা উঠলে। বিশেষ করে বছরে ৬ বার বা তার বেশি জ্বর ঠোসা উঠলে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে। আবার জ্বর ঠোসা নিয়ে দুশ্চিন্তা হতে থাকলেও ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে জ্বর ঠোসা এবং দুশ্চিন্তা দূর করতে হবে।
★ জ্বর ঠোসার মত দেখালেও অন্য কোনো রোগ হয়েছে এমন মনে হলেও ডাক্তারের কাছে গিয়ে কি রোগ সেটা নিশ্চিত হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।

কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তার রোগীকে অ্যান্টিভাইরাল ট্যাবলেট সেবনের পরামর্শ দিতে পারে।

মনে রাখবেন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, গর্ভবতী নারী এবং নবজাতক শিশুর গুরুতর জ্বর ঠোসা হতে পারে। এক্ষেত্রে এসকল রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হতে পারে। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে গুরুতর জ্বর ঠোসা সারিয়ে তোলা এবং সৃষ্ট জটিলতা প্রতিরোধে সাহায্য করে। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না নিলে এই ধরণের রোগীর শরীরে ইনফেকশন ছড়িয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

আরও পড়ুনঃ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে কিভাবে বুঝবেন?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *