বর্তমানে মেয়েদের স্তন ক্যান্সার একটি আতঙ্কের নাম। সারা বিশ্বে এই রোগের প্রকোপ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। তবে নিঃশব্দে মৃত্যুর ভয়ঙ্কর থাবা বসাচ্ছে এর থেকেও ভয়াবহ রোগ জরায়ু ক্যান্সার। জরায়ু ক্যান্সারকে বলা হয় সাইলেন্ট কিলার। কারণ, অনেক নারীরাই এর রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো বুঝতে পারে না বা লক্ষণ দেখা দিলেও বিশেষ গুরুত্ব দেয় না।
বর্তমানে দেশে হাজার হাজার নারী এই প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত। সচেতনার অভাব এবং লজ্জার কারণে জরায়ু ক্যান্সারের পরীক্ষা করাতে চায় না অধিকাংশ নারী। যখন রোগ ধরা পড়ে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আর কিছুই করার থাকে না।
অনেকেই মনে করেন, জরায়ু ক্যান্সার হয়তো প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরে হয়ে থাকে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। যে কোন বয়সের নারীরাই এই ক্যান্সার আক্রান্ত হতে পারে। তবে বিশেষ করে ৫০ বছর বা তার চেয়েও অধিক বয়সের নারীদের জরায়ু ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে, বিশেষ করে উত্তর ও পূর্ব ইউরোপে ২০১২ সালে প্রায় ৬৫,০০০ হাজার নারী জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। এবং ইউরোপের দেশগুলিতে ছয় প্রকার ক্যান্সারের মধ্যে জরায়ু ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং ভয়াবহ। প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ২,৫০,০০০ নারী জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীরা এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রথম অবস্থায় চিকিৎসা না করানোর ফলে তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৫০% কমে যায়। আর যারা প্রথম থেকেই চিকিৎসা নেয়, তাদের বেঁচে থাকার সম্ভবনা থাকে ৯৫%।
তাই সুস্থ থাকতে এই রোগের প্রাথমিক কিছু লক্ষণ সম্পর্কে জেনে রাখতে হবে। লক্ষণগুলো দেখা দিলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে ক্যান্সার স্ক্রিনিং করিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।
জরায়ু মুখের ক্যান্সার হওয়ার রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো কীঃ
১) অল্প বয়সে বিয়ে করা,
২) অল্প বয়সে বাচ্চা নেওয়া,
৩) কোন ব্যক্তির পূর্বের স্ত্রীর এই রোগ হয়ে থাকলে, তার সাথে যৌন মিলন করা,
৪) একাধিক ব্যক্তির সাথে যৌন মিলন করা,
৫) ঘনঘন বা অধিক বাচ্চা নেয়া,
৬) খাবার বড়ি ব্যবহার করা,
৭) ইনফেকশন – এইচ.আই.ভি. , হিউম্যান পেপিলমা , ক্লামাইডিয়া ভাইরাস ইনফেকশন,
এই ফ্যাক্টর বা কারণগুলো একজন নারীর শরীরে ক্যান্সারের দানা বাঁধতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে। সঠিকভাবে এই ব্যাপারগুলো এড়িয়ে গেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটা কমে যাবে। নিম্নবিত্তদের মধ্যে শিক্ষার অভাব বিরাজমান। কিন্তু যারা মোটামুটি পড়াশোনা করেছেন এবং স্বাস্থ্য সচেতন তাদেরকে এসব ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং আশেপাশের ব্যক্তি এমনকি কাজের মেয়েদেরও সচেতন করতে হবে।
জরায়ু ক্যান্সারের কিছু প্রাথমিক লক্ষণঃ
১. আচমকা ক্ষুধা কমে যাওয়া,
২. পেটে অতিরিক্ত ব্যথা কিংবা পেট ফুলে থাকা,
৩. সবসময় বমি বমি ভাব কিংবা বার বার বমি হওয়া,
৪. গ্যাস, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, হালকা খাবারের পরেও ভরপেট অনুভব করা, পেটে অস্বস্তি অনুভুতি ইত্যাদি । পেটের কোন সমস্যা খুব বেশি হলে সেটাও জরায়ু ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে,
৫. যৌনাঙ্গের চারপাশে চাপ চাপ বোধ হওয়া এবং ঘন ঘন মূত্রত্যাগ করা,
৬. অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি কিংবা হঠাৎ করে ওজন অনেক কমে যাওয়া,
৭. অভ্যস্ত থাকার পরেও যৌনমিলনের সময় ব্যথা অনুভূত হওয়া,
৮. নারীদের মেনোপজ হয়ে যাওয়ার পরেও রক্তক্ষরণ হওয়া,
৯. অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করা,
১০. দুই মাসিকের মধ্যে রক্তপাত,
১১. যৌন সংগমের পর রক্তপাত,
১২. পেলভিক পরীক্ষার পর রক্তপাত,
১৩. পেলভিক ব্যথা যা মাসিক চক্রের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়,
১৪. ভারি বা অস্বাভাবিক স্রাব, স্রাবে দুর্গন্ধ থাকতে পারে,
১৫. ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া আর প্রস্রাব করার সময় ব্যথা অনুভর করা,
প্রতিরোধের উপায়ঃ
বাজারে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ পরিষ্কার রাখার জন্য সুগন্ধি সাবান, ভেজা টিস্যু পেপার, জেলসহ নানা জিনিস পাওয়া গেলেও সেসব ব্যবহার করা উচিত নয় বলেই বিশেষজ্ঞগণ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এসব পন্য উপকারের থেকে ক্ষতি করে বেশি।
যৌনাঙ্গের যত্নে বিভিন্ন ধরনের পরিষ্কারক ব্যবহার করেন, সেরকম ১৪০০ নারীকে নিয়ে ক্যানাডায় সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, এসব ব্যবহারের ফলে তাদের যোনি এবং মূত্রনালীতে সংক্রমণের ঝুঁকি অন্য নারীদের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
এসব পরিষ্কারক দ্রব্য থেকে অনেকসময় গোপনাঙ্গে ইনফেকশন, ফাঙ্গাস, জ্বালাপোড়া বা চুলকানি হতে পারে। তাছাড়া নারীর সন্তান ধারণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। নিয়মিত যৌনাঙ্গের যত্ন না নিলে হতে পারে জরায়ু ক্যান্সার। এজন্য জরায়ু ক্যান্সার থেকে বাঁচতে যৌনাঙ্গের স্বাস্থ্য রক্ষায় সচেতন হতে হবে। তাহলে জেনে নেই যৌনাঙ্গের স্বাস্থ্য রক্ষায় কি করবে নারীরা।
★ কুসুম গরম পানিঃ
প্রয়োজনে গোপনাঙ্গের আশেপাশে অর্গানিক সাবান ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে যোনি বা লিঙ্গে শুধু হালকা গরম পানির ব্যবহারই যথেষ্ট এবং উত্তম। গরম পানিতে হালকা লবণ ব্যবহার করা যেতে পারে।
★ সুতির আন্ডার প্যান্টঃ
নারী-পুরুষ সকলেরই সুতি কাপড়ের আন্ডার প্যান্ট পরা উচিত। সিন্থেটিক কাপড় থেকে অ্যালার্জিসহ নানা ধরনের স্কীন সমস্যা হতে পারে। যদিও আজকাল এই প্রজন্মের অনেক মেয়েরই আকর্ষণীয় ডিজাইন এবং বিভিন্ন ধরনের লেস বা কাপড়ের আন্ডার গারমেন্টসই বেশি পছন্দ, কিন্তু যৌনাঙ্গের জন্য এসব উপকারী নয়।
★ পরিচ্ছনতার উপকারঃ
যৌনাঙ্গ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখলে যে শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর যৌনমিলনের আনন্দ পাওয়া যায় তা-ই নয়, মানসিক ও শারীরিকভাবেও মানুষ সুস্থ বোধ করবে।
★ যৌনমিলনের আগে ও পরেঃ
যৌনমিলনের আগে যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করতে হবে, তবে ঠিক আগ মুহূর্তে নয়। এতে যৌনসুখ কিছুটা কমে যেতে পারে। যৌনমিলনের পরে অবশ্যই প্রস্রাব করা এবং যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করা উচিত।
★ নতুন আন্ডারওয়ারঃ
নারী, পুরুষ কারোই কখনো অন্তর্বাস না ধুয়ে পরা উচিত নয়। এতে যৌনাঙ্গে সংক্রমণ বা অ্যালার্জি হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। এই নিয়ম অবশ্যই সব বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
★ অতিরিক্ত টাইট অন্তর্বাস পরিধান না করাঃ
টাইট বা অতিরিক্ত টাইট এমন অন্তর্বাস পরিধান একেবারেই উচিত নয়। কারণ, এতে রক্ত চলাচলে যেমন বাধাগ্রস্ত হয়, তেমনি বাতাস আসা যাওয়ায় বিঘ্ন ঘটার কারণে যৌনাঙ্গে দুর্গন্ধ হয়। আর দুর্গন্ধ থেকেই শুরু হয় সমস্যা।
★ দুর্গন্ধ ও সংক্রমণ এড়াতেঃ
যৌনাঙ্গে পানি ব্যবহারের পর অবশ্যই জায়গাটুকু টাওয়েল দিয়ে মুছে ফেলতে হবে। না হলে দুর্গন্ধ এবং মূত্রনালীতে ফাঙ্গাস জন্মাতে পারে।
★ মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময়ঃ
ঠিক এই সময়টাতে মেয়েদের যৌনাঙ্গ বিশেষভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং নিয়মিত প্যাড বদলানো উচিত। কারণ, স্যাঁতস্যাতে বা ভেজা প্যাডে বা কাপড়ে সহজেই জীবাণু বাসা বাঁধে। আর এ থেকে হয়ে যেতে পারে বড় ধরনের ক্ষতি। একটি প্যাড ৬ ঘন্টার বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। এক প্যাড দীর্ঘক্ষণ ব্যবহার করা এবং এর জেল জরায়ু ক্যান্সারের অন্যতম কারণ।
★ মেনোপজঃ
অনেক নারীর ক্ষেত্রে হরমোনের তারতম্যের কারণে মেনোপজের আগে ও পরে তাঁদের যোনিপথ কিছুটা শুষ্ক হয়ে যায়। এক্ষেত্রে বাজার থেকে কেনা কোন ক্রিম বা তেল ব্যবহার না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
এখন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য টিকা পাওয়া যায়। মেয়েদের বয়স যখন ১০ থেকে ১২ বছর ঠিক তখন তিনটি ডোজের মাধ্যমে ছয় মাসের মধ্যে এই টিকা দিতে হবে। এই টিকা মূলত বিয়ের পূর্বে অথবা যৌন সক্রিয় হওয়ার আগে দিতে হবে। এছাড়াও নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব।
১. টিকা প্রদান করে অবিবাহিত মহিলাদের জরায়ু ক্যান্সার থেকে নিরাপদ রাখা,
২. কোন লক্ষণ চোখে পড়লেই যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা,
৩. জরায়ু ক্যান্সার সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা,
৪. নারীদের সাহস জোগাতে হবে। এক্ষেত্রে পুরুষদেরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে,
৫. ১৮ থেকে ৬০ বছরের নারীদের বছরে একবার করে জরায়ু পরীক্ষা করা প্রয়োজন। তবে পরপর দুইবার রিপোর্ট নেগেটিভ আসলে ৩ অথবা ৫ বছর পরপর পুনরায় পরীক্ষা করাবেন। ঝুঁকিপূর্ণ নারীরা ৩ বছর পরপর পরীক্ষা করাবেন।
★ জীবন জীবনই আর তা অনেক মূল্যবান।
★ সচেতন হোন।
★ নিয়মিত নিজের শরীরের প্রতি বিশের খেয়াল রাখুন।
★ মনে রাখবেন, আপনার সচেতনতাই আপনার সুস্থ থাকার প্রধান ঔষধ।