গল ব্লাডার স্টোন বা পিত্তি থলির পাথর কেন হয়, লক্ষণ ও প্রতিকার কি ?

রক্তে কোলেস্টেরল বাড়লে বা বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে পিত্তরস ক্ষরণে বাঁধাগ্রস্থ হয়। তখন সেই পিত্তরস পিত্তথলিতে জমে সেখান থেকেই পাথর তৈরি করে।

নারীদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্তের প্রবণতা পুরুষের থেকে তুলনামূলক অনেক বেশি। না খেয়ে থাকা, অসময়ে খাওয়া-দাওয়া করা, ডায়াবেটিক, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে না থাকা বা রাখা, মেনোপজের পর হরমোন রিপ্লেসমেন্টে অভ্যস্ত বা এক সময়ে প্রচুর গর্ভনিরোধক বড়ি খেয়েছেন এমন নারীদের পিত্তি থলিতে পাথর জন্মানোর আশঙ্কা বেড়ে যায় অনেকগুণ। জীবনের নানা পর্যায়ে, এমনকি গর্ভাবস্থায় হরমোনের যে তারতম্য সৃষ্টি হয় তার মাধ্যমেও নারীদের পিত্তি থলিতে পাথর জমার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।

মেয়েদের তুলনায় কম আক্রান্ত হলেও, পুরুষও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার বাইরে নয়। অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, হরমোনাল ডিজিস, অতিরিক্ত কোলেস্টেরল, ইত্যাদি পুরুষদের ক্ষেত্রেও গলব্লাডারে পাথর তৈরি করে থাকে। দুবেলা খাবারের মাঝে অনেকক্ষণ বিরতি থাকলেও এই সমস্যা হয়ে থাকে।

গলব্লাডারে পাথর হলে সাধারণত পেটের উপরের অংশে ডান দিকে ব্যথা হয়। এটি ছাড়াও আরও কিছু উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে । ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে ঔষুধেই এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। দেরি হলে অস্ত্রোপচার করতে হয়।

রোগের লক্ষণঃ

১. এই রোগের মূল লক্ষণ পেটের ডান দিকে ব্যথা। যা ছড়িয়ে পড়ে ডান কাঁধ পর্যন্ত। পেটের উপরের অংশে ডান দিকে ব্যথা হলে সতর্ক হতে হবে। খেয়াল করতে হবে সেই ব্যথার বিস্তার কতটুকু। ডান কাঁধ পর্যন্ত ছড়ালে যত দ্রত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতেই হবে।

২. এই রোগে আক্রান ব্যক্তির কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। পেটে ব্যথার সঙ্গে এমন জ্বর এলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।

৩. অনেক সময় এই অসুখে আক্রান্তরা হেপাটাইটিসের শিকার হয়ে পড়ে। তাই পেটে ব্যথার সঙ্গে হেপাটাইটিস দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

৪. একটু ভারী খাওয়া-দাওয়া, বিশেষ করে মাংস ও তেল জাতীয় কিছু খেলে ব্যথা বাড়বে, সঙ্গে বমি হতে পারে      ঘনঘন।

গলব্লাডারে পাথর হলে অপারেশন ছাড়া যেমন গতি নেই, অপারেশন–পরবর্তী জীবনেও খাবারে অনেক বিধি-নিষেধ থাকে।

কি কি বিষয় মেনে চলবেনঃ

১. লো ক্যালোরির সুষম খাবার খাবেন। প্রয়োজন হলে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন।

২. ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। যেমন, শাকসবজি, ফল, হোলগ্রেন তথা ব্রাউন রাইস, আটা–জোয়ার–বাজরা ইত্যাদির রুটি, ব্রাউন ব্রেড, ডাল ইত্যাদি।

৩. খাবারে বৈচিত্র্য রাখতে হবে। রোজ এক ধরনের খাবার না খেয়ে সব রকম খাবার মিলিয়ে মিশিয়ে খাবেন।

গল ব্লাডারের অবস্থান।

৪. ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার রাখবেন খাবারে। ছোলা,খেজুর,ওটলি,ডাল,গমে প্রচুর ফাইবার থাকে।

৫. দিনে ২–৩ সার্ভিং প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
এক সার্ভিং: ৭৫ গ্রাম মাছ–মাংস বা চিকেন, দুটি ডিম, ৩/৪ কাপ বিনস–শুকনো মটরশুঁটি বা মুসুর ডাল, ১৫০ গ্রাম বা ৩/৪ কাপ টোফু, ২ টেবিল চামচ পিনাট বাটার, সিকি কাপ বাদাম।

৬. মাংস বা চিকেনের যে অংশে চর্বি কম থাকে সেই অংশ খাবেন। চিকেনের উপরের পাতলা চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে খাবেন অবশ্যই। মাঝেমধ্যে নিরামিষ প্রোটিনও খাবেন।

৭. হজম করতে পারলে দিনে ২–৩ সার্ভিং লো ফ্যাট দুধ বা দুধের তৈরি খাবার খাবেন। এক সার্ভিং–এর মানে হল ২৫০ মিলি দুধ বা এই পরিমাণ দুধে বানানো ছানা, ৫০ গ্রাম চিজ, ১৭৫ মিলি ইয়োগার্ট বা টক দই। তবে ইয়োগার্টে ২ শতাংশের কম ফ্যাট থাকতে হবে। লোয়ার ফ্যাট চিজে দুধের প্রোটিন যেন ২০ শতাংশের কম থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ক্রিম বা ক্রিম জাতীয় খাবারভনা খাওয়াই ভাল।

৮. রোজ কিছু না কিছু উপকারি ফ্যাট খাওয়ার অভ্যাস করুন। বাদাম, মাছের তেল, অ্যাভোক্যাডো, অলিভ অয়েল খেতে পারেন। তবে ঘি–মাখন বা এ ধরনের তেল জাতীয় খাবার পুরোপুরি বাদ দেওয়ার দরকার নেই। কারণ ফ্যাট না খেলে গল স্টোন হয় না এমন নয়। উপকারি ফ্যাট না খেলে নানা রকম সমস্যা হতে পারে। তবে এই ফ্যাট জাতীয় খাবার যেন মাত্রা না ছাড়ায় সেদিকে খেয়াল করবেন। দিনে ২–৩ টেবিল চামচ বা ৩০–৪৫ মি.লি-র বেশি তেল খাওয়া যাবে না। সিকি চামচ ঘি/মাখন খাবেন সপ্তাহে দুই–তিন বার। সপ্তাহে ৩–৪ বার ২৫ গ্রামের মতো লবণহীন সেঁকা বাদাম খাবেন।

৯. চিনির কোন উপকার নেই, বরং অপকার আছে অনেক। কাজেই সব রকম মিষ্টি স্বাদের খাবার খাওয়া বন্ধ করুন। ব্যতিক্রম ফল। প্রচুর ফল খেতে পারেন। তবে ফলের রস চলবে না একেবারেই। প্রতি দিন দুই-তিনটি ফল চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করেন।

১০. ক্যাফেইনসমৃদ্ধ খাবার বা পানীয় যতটা সম্ভব কম খেতে হবে। দিনে তিনবারে ২৫০ মিলি কফি খেতে পারেন। গর্ভাবস্থায় তা নেমে আসবে দু’কাপে। চকোলেট বা কোমল পানীয় পানের ব্যাপারেও সতর্ক থাকুন। চা একটু বেশি খাওয়া যায়। তবে তাও যেন মাত্রা না ছাড়ায়। চিনি পরিহার করুণ চায়ে।

জীবনযাপনঃ

– ওজন যেন না বাড়ে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বেড়ে গেলে রাতারাতি কমানোর চেষ্টা না করে স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে সময় নিয়ে ওজিন কমানোর জন্য পরিশ্রম করুন।

– ভাল করে ঘুমোতে হবে অবশ্যই। ঘুমের বিকল্প কিছু নেই। ভালো ঘুম সুস্থ থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

– লো ক্যালোরির সুষম খাবার খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন। যেন ওবেসিটি, ডায়াবিটিস ও হাই কোলেস্টেরলের সম্ভাবনা কমে যায়।

– দয়া করে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন গর্ভনিরোধক বড়ি খাবেন না। ঋতুস্রাব বন্ধের পর নিতান্ত প্রয়োজন না হলে হরমোন থেরাপি করানোর দরকার নেই।

– মধ্যবয়সে মানসিক চাপ এবং এর কারণে ভুলভাল খাবার ও ওজন বৃদ্ধির সমস্যা এড়াতে দরকার রিল্যাক্সেশন থেরাপি। নিয়মিত ব্যায়াম, ইয়োগা, মেডিটেশন ও কোনো ভাল লাগার কাজের চর্চা এই কাজে সহায়তা করতে পারে। প্রয়োজনে কাউন্সিলিং করে হলেও মানসিক চাপ এড়ানোর চেষ্টা করবেন।

Leave a Comment