ITP বা আইটিপি রোগ কী

আইটিপি কীঃ

আইটিপি এর পূর্ণরুপ হচ্ছে ইমিউন থ্রাম্বোসটোপেনিক পারপুরা। একটি অটোইমিউন গোত্রের রোগ হচ্ছে আইটিপি। এই রোগে দেহে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত এন্টিবডি তৈরি হয়, যা রক্তের প্লাটিলেট বা অনুচক্রিকাকে ধ্বংস করতে থাকে। যার ফলে রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে যায়। সাধারণত সুস্থ মানুষের রক্তে প্রতি ঘনমিটারে দেড় লাখ থেকে চার লাখ পর্যন্ত প্লাটলেটের উপস্থিতি থাকে। এই রোগে আক্রান্ত হলে এই প্লাটিলেটের সংখ্যা দেড় লাখের নিচে নেমে আসে। এমনকি এই প্লাটিলেটের সংখ্যা কমতে কমতে ৫০০০ এ নেমে আসতে পারে।

রক্তে থাকা প্লাটিলেট নামের কোষের কাজ হচ্ছে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করা। আইটিপি হলে রোগীর প্লাটিলেট কতটা কমলো তার উপর নির্ভর করে রোগীর উপসর্গ বা লক্ষণ কি কি হতে পারে। তবে রোগীর প্লাটিলেট যদি ২০০০০ এর নিচে নেমে যায় তবে রোগীর রক্ত ক্ষরণের সম্ভাবনা প্রবল।
আইটিপির কারণে হওয়া এই রক্ত ক্ষরণ রোগীর ত্বক ও মিউকাস মেমব্রেনে হয়ে থাকে। যেমন ত্বকের নিচে লাল দাগ (ছোট ফুসকুড়ির মত হলে পারপুরা, বড় ছড়ানো রক্ত ক্ষরণ দেখা দিলে ইকাইমোসিস), কালো পায়খানা বা মলের সাথে রক্তপাত, নাক থেকে রক্ত ক্ষরণ, দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত ক্ষরণ, মাসিকের সাথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ইত্যাদি। তবে শুধুমাত্র যে বাহ্যিক রক্তক্ষরণই যে হবে এমনটা নয়। খুবই অল্প কিছু রোগীর ক্ষেত্রে শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ থেকে যেমন মস্তিষ্ক বা পেটের ভিতর থেকেও রক্তক্ষরণ হতে দেখা গেছে। তবে এই ক্ষেত্রগুলো খুবই বিরল।

আইটিপি কেন হয়ঃ

আমাদের শরীরে থাকা রক্তকোষসমূহ (যাদের অনুবিক্ষণ যন্ত্র বা মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা যায় না) শরীরের ভিতর নানা ধরণের কাজ করে থাকে। এসব কাজের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হচ্ছে রোগী-জীবাণু বা নিজ শরীরের বাহিরের অন্য কোষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এই কাজটিকে বলা হয় ইমিউনিটি। ইমিউনিটির কাজ হচ্ছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জোরদার করা। সুস্থ অবস্থায় ইমিউনিটি নিজ দেহকোষ থেকে ভিন্ন কোষ বা জীবাণু পৃথক করতে পারে। যার ফলে নিজ দেহের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তবে ইমিউন রোগে ইমিউনিটির সাথে সম্পৃক্ত রক্তকোষ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যাদের একত্রে ইমিউন সিস্টেম বলা হয়, সেগুলো নিজ দেহকোষের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক আচরণ শুরু করে অন্য কোষের পাশাপাশি নিজ দেহকোষও ধ্বংস করতে থাকে। অর্থাৎ এই সময় ইমিউনিটি সিস্টেম শত্রু মিত্র চিনতে পারে না।
যে কোন বয়সে একজন মানুষ আইটিপিতে আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশুদের এর রোগ হলে খুব দ্রুত সেরে যায়। প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। পূর্বের রোগীদের রিপোর্ট অনুযায়ী গবেষণায় জানা যায় ৮০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পিছনে কোনো কারণ চিহ্নিত করা যায় না। এই সকল ক্ষেত্রকে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় প্রাইমারি বা প্রাথমিক আইটিপি। তবে বাকি ২০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এই রোগটি হওয়ার জন্য অন্য রোগ দায়ী বলে গবেষণায় পাওয়া যায়। আইটিপে আক্রান্ত করতে পারে এমন অন্য রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে লিমফোমা, এসএলই ইত্যাদি। কোনো রোগের প্রভাবে কেউ আইটপিতে আক্রান্ত হলে তাকে বলা হয় সেকেন্ডারি আইটিপি। আবার অনেক সময় এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পিছনে কিছু ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণও দায়ী হতে পার।

লক্ষণঃ

প্রধানত পুরাপুরা বা ত্বকের নিচে ছোট ছোট রক্তক্ষরণের চিহ্নকেই আইটিপির মূল উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ এটি ছাড়াও ত্বকের নিচে গোলগোল কালো দাগ বা চাকতি দেখা দেওয়া, দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্তক্ষরণ, নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ, প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে রক্ত ক্ষরণ, পায়খানার সাথে কালো কালো রক্ত যাওয়া বা রক্তক্ষরণ হওয়া, মেয়েদের মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়া ইত্যাদিকে এই রোগের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বুঝার উপায়ঃ

আইটিপি হলে জ্বর বা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দেয় না। কেবল ছোটখাটো রক্তপাত বা রক্তক্ষরণ হতে দেখা যায়। এসময় CBC বা রক্তের কমপ্লিট কাউন্টে প্লাটিলেট কমে গেলে আইটিপি সন্দেহ করা যায়। তবে প্লাটিলেট কমে গেলে যে আইটিপিই হয়েছে এমনটা ভাবা যাবে না। অন্য অনেক কারণেও মানুষের রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে যেতে পারে। ব্লাড ক্যান্সার, নানা রকম ক্যান্সার, বিভিন্ন ভাইরাস সংক্রমণ (যেমন ডেঙ্গু), ঔষধের প্রভাব ইত্যাদি কারণেও মানুষের প্লাটিলেট কমে যেতে পারে। কি কারণে রোগীর প্লাটিলেট কমে গেছে তা রোগীর ইতিহাস ও শারীরিক অবস্থা পর্যালোচনা করার পাশাপাশি ল্যাবরেটরিতে ব্লাড ও অন্যান্য পরীক্ষার সাহায্যে নির্ণয় করা সম্ভব। প্লাটিলেট কমার অন্য কোনো কারণ নির্ণয় করা না গেলে একজন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ অর্থাৎ হেমাটোলজিস্ট আইটিপি শনাক্ত করার জন্য আরও।কিছু পরীক্ষা বা পদক্ষেপ নিতে পারেন।

পরীক্ষাঃ

রক্তের সিবিসি বা ফিল্ম পরীক্ষাই আইটিপির প্রাথমিক পরীক্ষা। কিছু পরীক্ষা করা হয় সম্ভাব্য কারণগুলো মাথায় রেখে। যেমন ভাইরাস, অটো অ্যান্টিবডির পরীক্ষা ইত্যাদি। আইটিপি ছাড়াও প্লাটিলেট কমে যাওয়ার আরো কিছু কারণ আছে। যেমন ব্লাড ক্যান্সার, ডেঙ্গু ইত্যাদি। রোগের ইতিহাস ও সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা করে সেসব রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে বোনম্যারো পরীক্ষারও প্রয়োজন হতে পারে।

চিকিৎসাঃ

আইটিপি হলে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এই রোগ দেখা দিলে প্রয়োজন ধৈর্য ধরা ও সম্পূর্ণ চিকিৎসা নেওয়া। কারণ এই রোগের চিকিৎসা ও পূর্ণ সুস্থতা পেতে অনেক সময় প্রয়োজন। ঔষধ সেবনের মাধ্যমে খুব ধীরে ধীরে রোগীর প্লাটিলেট বাড়ে। এক্ষেত্রে চিকিৎসা সঠিক হচ্ছে না ভেবে ঘনঘন ঔষধ পরিবর্তন বা ঔষধ বন্ধ করা যাবে না। সাধারণত স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ দিয়ে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। এর বাহিরে আরও কিছু ঔষধের মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। ঔষধ ছাড়া আরও কিছু বিশেষায়িত চিকিৎসা রয়েছে, যে চিকিৎসাগুলো একজন বিশেষজ্ঞ হেমাটোলজিস্ট বা রক্তরোগ বিশেষজ্ঞর তত্ত্বাবধানে থেকে নেওয়াটা জরুরী। এসব চিকিৎসার মধ্যে-
★ ইমিউনোগ্লোবিউলিন,
★ এজাথিউপ্রিন,
★ এন্টি ডি,
★ এলট্রম্বোপেগ,
★ মনোক্লোনাল এন্টিবডি ইত্যাদি অন্যতম।

মনে রাখতে হবে আইটিপি আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে প্লাটিলেট সঞ্চালন চিকৎসা কার্যকর নয়। বরং প্লাটিলেট বা রক্ত সঞ্চালন রোগীর জন্য ক্ষতিকর। আবার আয়রণ বা পুষ্টিকর খাবার খাওয়িয়েও এই রোগীদের প্লাটিলেট বাড়ানো সম্ভব নয়। সম্পূর্ণ ঔষধের উপর নির্ভর করে অর্থাৎ পরিপূর্ণ চিকিৎসা ও সঠিক ঔষধই এই রোগের চিকিৎসা।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইটিপি রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দীর্ঘ মেয়াদে ঔষধ সেবন করলে রোগটি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যে সকল আইটিপি ভালো হয় না, সেই সকল আইটিপিকে ক্রনিক আইটিপি বলা হয়। ক্রনিক আইটিপির ক্ষেত্রে চিকিৎসা বা সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলাটা বেশ জটিল হয়ে পড়ে। এজন্য দেরি না করে লক্ষণ দেখা দিলেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে ধাপে ধাপে চিকিৎসা নিতে হবে এবং নিয়মিত পর্যাবেক্ষণে থাকতে হবে।

আরও পড়ুনঃ জরায়ু ক্যান্সার কতটা ভয়াবহ। 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *