ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স কি?

ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স কিঃ

ইন্সুলিন পর্যাপ্ত ব্যবহার না হওয়ার ফলে শরীরে শর্করা বা Glucose এর পরিমাণ বেড়ে যাওয়া বা ব্লাড সুগার বেড়ে যাওয়াকে ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স বলা হয়।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা যত খাবার খেয়ে থাকি তার অধিকাংশই হচ্ছে শর্করা। আমাদের শরীরের ভিতরে নানা ধরনের বিপাকীয় ক্রিয়া অথবা মেটাবোলিজমের মাধ্যমে শর্করাগুলো ক্ষুদ্র গ্লুকোজে পরিণত হয়। অগ্ন্যাশয়ে তৈরি হওয়া ইন্সুলিন নামক হরমোন মানুষের শরীরের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ বা Regulation করতে সহায়তা করে।
যখন মানুষের দেহের বিভিন্ন কোষ ইন্সুলিনকে ভালো করে ব্যবহার ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়, তখন দেহে নানা রকমের সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে। ফলে শরীরে থাকা গ্লুকোজগুকো অব্যবহৃত থেকে যায়। আর এই সমস্যা থেকে বাঁচতে অগ্ন্যাশয় একটানা ইন্সুলিন তৈরী করতে থাকে। আর অতিরিক্ত ইন্সুলিন তৈরি হতে থাকাকেই বলা হয় ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স (Insulin Resistance).

ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্সের লক্ষণ কি কিঃ

Insulin Resistance যেহেতু মানুষের শারীরিক সমস্যা, এজন্য এর বেশ কিছু লক্ষণ মানুষের মাঝে দেখা যাবে এটাই স্বাভাবিক। ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্সের কিছু লক্ষণ হচ্ছে-
★ অতিরিক্ত পিপাসা এবং ক্ষুধা লাগা,
★ সাধারণের তুলনায় বেশি অবসাদ বোধ করা,
★ খাবার পরেও ক্ষুধা লাগা,
★ ঘনঘন প্রস্রাব লাগা বা মূত্রত্যাদের প্রবণতা বেড়ে যাওয়া,
★ ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া,
★ শরীর শুকিয়ে বা মোটা হয়ে যাওয়া,
★ বিভিন্ন রক্ত পরীক্ষায় রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি পাওয়া।
ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স মানুষকে নানা রকম ক্ষতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এসব ক্ষতির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে Type-2 ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্থুলতা বা ওজন বৃদ্ধি পাওয়া। অনেকের ওজন কমে যেতেও দেখা যায়। আবার মানবদেহে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার জন্যও অতিরিক্ত গ্লুকোজকে দায়ী করা হয়।

ইন্সুলিন রেজিস্ট্যকন্স নির্ণয় পদ্ধতিঃ

রোগীর ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স নির্ণয়ের জন্য ডাক্তার বিভিন্ন রকমের টেস্ট করতে দিবেন। এই টেস্টগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যোগ্য কিছু টেস্ট হচ্ছে–

★ ফাস্টিং প্লাজমা গ্লুকোজ টেস্ট,
★ ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট,
★ হিমোগ্লোবিন A1C টেস্ট।
এই টেস্টগুলো মানুষের শরীরে ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স আছে কি না দেখার পাশাপাশি ডায়াবেটিস আছে কি না বা ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না তা দেখার জন্য রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কতটা তা পরিমাপ করে থাকে।

ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্সের কারণঃ

যে সকল কারণে ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স হতে পারে সেসকল কারণের অধিকাংশই হচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবন-যাপনের অংশ জুড়ে। আর এই জীবন-যাপন আমাদের শরীরের মেটাবোলিজমে প্রভাব ফেলে। ঠিক তখনই যে সকল সমস্যা দেখা দিতে পারে, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমাদের আলোচ্য বিষয় ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স। আসুন জেনে নেই এই ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্সের কতিপর কারণ।
১. অতিরিক্ত তেল-চর্বি এবং শর্করা সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ।
২. তামাক জাতীয় দ্রব্য সেবন এবং গুল খাওয়া।
৩. প্রয়োজনীয় শারীরিক পরিশ্রম বা ব্য্যাম না করা।
৪. পরিবারের কোনো ব্যক্তির ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স বা টাইপ-২ ডায়াবেটিস থাকলে।
৫.স্টেরয়েড অথবা এন্টিসাইকোটিক ঔষধ গ্রহণের ফলে অনেক সময় ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স হতে পারে।
৬. ফ্যাটি লিভার ডিজিজ বা পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (POC) থাকলে এই রোগ হতে পারে।

ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স হলে যে সকল খাবার খাবেনঃ

মানুষ চাইলেই অসুস্থ অবস্থায় যে কোনো খাবার খেতে পারে না। কষ্ট হলেও এমন বেশ কিছু খাবার আছে যেগুলো অসুস্থ অবস্থায় পরিমিত পরিমাণে খাওয়াটা জরুরী। ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্সের সময়ও এমন কিছু খাবার গ্রহণ করা উচিত যা শরীরের জন্য উপকারী। খাবারগুলো হলো–

গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের নিচের দিকের খাবার সমূহঃ
বিভিন্ন ধরণের খাবারের মাঝে কোন খাবারগুলো কত দ্রুত এবনহ কত বেশি পরিমাণে রক্তের সুগার লেভেল বাড়িয়ে তুলতে পারে তার একটি লিস্ট রয়েছে। আর এই তালিকাকেই বলা হয় গ্লাইসেমিক ইনডেক্স। ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্সে আক্রান্ত রোগীর যে সকল খাবার গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের উপরের দিকে আছে সেই সকল খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। আর যে সকল খাবার এই ইনডেক্সে নিচের দিকে আছে, সেই সকল খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত। যেমন: আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলু বা আলু জাতীয় খাবার পরিহার করে অধিক পরিমাণে সবুজ শাক সবজি খেতে হবে।

★ শাক-সবজিঃ
শাক-সবজিতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ বা ডায়েটেরি ফাইবার থাকে। সাথে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেলস। এই উপাদানগুলো গ্লুকোজ মেটাবলিজমের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

★ কিছু ফলমূল:
নানা ধরণের ফল নানাভাবে মানুষের শরীরের অভাবগুলোকে পূর্ণ করে। তবে কিছু ফল আছে যেগুলোতে প্রাকৃতিকভাবেই সুগার থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিছু ফল আছে যেগুলো গ্লাইসেমিক ইনডেক্সে বেশ নিচের দিকে থাকে। এসব ফলের মধ্যে আপেল, নানা ধরণের বেরি জাতীয় ফল, খেজুর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

★ মাছঃ
বেশ কিছু মাছ OMEGA-3 এর বর উৎস। এসব মাছ আমাদের শরীরের পুষ্টির ঘাটতি মেটাতেও সহায়ক হয়ে থাকে। ওমেগা-৩ ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স রোধে সহায়তা করে। পাঙ্গাস মাছ, তেলাপিয়া মাছসহ অধিকাংশ সামুদ্রিক মাছে ওমেগা-৩ এর উপস্থিতি পাওয়া যায়।

★ দুগ্ধ জাতীয় খাদ্য:
লো ফ্যাটযুক্ত ডেইরি প্রডাক্টকে অনেকেই ভালো হিসেবে মনে করে থাকে। দুধে ল্যাকটোজ সুগার থাকে। যা কিছু মানুষের রক্তে সুগারের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম। টক দই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হলেও পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।

★ হোল গ্রেইনঃ
লাল আটা, বার্লি, লাল চাল, ওটস ইত্যাদিকে হোল গ্রেইন বলা হয়। এই খাবারগুলো দেহের জন্য বেশ উপকারী।

★ মাংসঃ
পরিমিত পরিমাণে মাংস গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের শরীরের আমিষের ঘাটতি পূরণ হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি শর্করা আর ক্যালরি গ্রহণের হার কমিয়ে দিবে।

★ বিচি জাতীয় খাবারঃ
মটরশুটি, শিমের বিচি, সূর্যমুখীর বিচি, কুমড়োর বিচিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার পাওয়া যায়। আবার ছোলা বা বুটেও ভালো পরিমাণে ফাইবার উপাদান থাকে।

ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স থেকে বেঁচে থাকার উপায়ঃ

কথায় বলে “প্রতিকাত থেকে প্রতিরোধ উত্তম”। অন্যান্য রোগের মতই ইন্সুলিন রেজেস্ট্যান্স থেকে বেঁচে থাকার সবচেয়ে উপযুক্ত পন্থা হচ্ছে প্রতিরোধ। শারীরিক পরিশ্রম বা নিয়মিত ব্যায়ামে আমাদের শরীরের মেটাবোলিজম কিংবা বিপাকক্রিয়াকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। যার ফলশ্রুতিতে শরীরে থাকা অতিরিক্ত শর্করা শরীরে ঝরে যায় এবং অতিরিক্ত শর্করা জমার সুযোগ পাবে না। নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরীক পরিশ্রমের পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে আমরা যে সকল খাবার খাই তা যেন সুষম খাবার হয়। কারণ সুষম খাবার খাওয়া হলে কখনোই অতিরিক্ত শর্করা বা সুগার জাতীয় খাবার খাওয়া হবে না। আর এর ফলে শরীরের ভারসাম্যও নষ্ট হবে না।
শাকসবজি এবং ফাইবার জাতীর খাবার গ্রহণ করা একটি ভালো মাধ্যম হতে পারে। সেই সাথে যারা ইতোমধ্যে ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্সে আক্রান্ত হয়েছে তাদের ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে ডাক্তারের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।
শুধু খাবারই নয়, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়ম মেনে ঔষধ সেবনের পাশাপাশি নিয়মানুবর্তী জীবন-যাপনে সচেষ্ট হতে হবে। আর এসব নিয়ম মেনে চললেই ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্সাকে পরাজিত করে সুস্থ জীবন-যাপন করা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুনঃ ডায়াবেটিস রোগীদের যে ৬টি কাজ করা যাবে না।

Leave a Comment