গর্ভাবস্থায় আয়োডিনের অভাব; ঘটাতে পারে সন্তানের মৃত্যুও

গর্ভাবস্থা একজন নারীর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনই গুরুত্বপূর্ণ গর্ভে থাকা সন্তানের জন্যও। এই সময় নারীর প্রতি বিশেষ যত্নশীল হতে হয় পরিবারের সদস্যদের। পরিবারের কোন নারী গর্ভবতী হলে কোন রকম আঘাত না পাওয়া, ভারী কাজ না করা, ঘর এবং ঘরের ওয়াশরুম পরিষ্কার রাখার মত অনেক কাজেই পরিবারের সদস্যদের আমরা আমরা খুবই সচেতন থাকতে দেখি এই। এত কিছুর মাঝে অনেক নারীকেই দেখা যায় পুষ্টির অভাবে বা আয়োডিনের অভাবে ভুগে থাকে। গর্ভাবস্থায় অন্যান্য বিষয়ে যতটা সচেতন হয় থাকে পরিবার ঠিক ততটাই বা তার থেকে বেশি সচেতন হতে হবে গর্ভবতী নারীর খাবারের বিষয়ে। কারণ এই অবস্থায় একজন নারীর গ্রহণ করা খাবারের পুষ্টি তার সন্তান পেয়ে থাকে। আর এর ফলেই সন্তান সুস্থ্য ও সবল হয়ে জন্ম নিতে পারে পৃথিবীতে।

শিশুর বিকাশে খাবারের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আয়োডিনযুক্ত খাবার। গর্ভবতী মায়ের শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি হলে গর্ভের সন্তান বিভিন্ন সমস্যা ও রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যার প্রভাব গর্ভে এবং জন্মের পরের সন্তানের মাঝে দেখা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে ‘গাছের নিলে যত্ন, গাছ দিবে রত্ন’
আয়োডিনযুক্ত খাবার বা আয়োডিন শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর স্বাস্থ্য বৃদ্ধি এবং বিকাশ নিশ্চিত করতে গর্ভবতী নারীকে অবশ্যই আয়োডিন সম্বৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে। শরীরে আয়োডিনের ঘাটতির অন্যতম সাধারণ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ক্রিটিনিজম। ক্রিটিনিজমের প্রভাবে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ কমে যেতে থাকে। এই ফলে শিশুর মানসিক ও শারীরিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। ভুল যাওয়া, মুখস্থ না হওয়া বা অটিজমের মত সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ডাক্তারগণ গর্ভাবস্থায় আয়োডিনের অভাবকে চিহ্নিত করেছেন।
গর্ভাবস্থায় আয়োডিনের ঘাটতি গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি কমিয়ে দেয়। এর ফলে সন্তান লম্বা ও স্বাস্থ্যবান হওয়া থেকে বিরত থাকে। শিশুর মানসিক বিকাশ ও শারীরিক বৃদ্ধিকে বাঁধা দিয়ে থাকে আয়োডিনের অভাব। চিকিৎসা বিজ্ঞান এটা প্রমাণ পেয়েছে যে, গর্ভবতী মায়ের শরীরে আয়োডিনের অভাব থাকলে তা সন্তানের উপর প্রভাব ফেলবেই।
শিশুদের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক একটি রোগ হচ্ছে গয়েটার। এই রোগের প্রভাবে মানুষের গলা ফুলে যায়। বিরল হলেও নবজাতক এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে শুধুমাত্র গর্ভাবস্থায় আয়োডিনের ঘাটতি থাকলে। এই রোগটি অত্যন্ত বিপদজনক। শিশুদের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাকে প্রভাবিত করতে পারে এই রোগটি।
আয়োডিনের অভাব হলে গর্ভপাতের মত ঘটনা ঘটতে পারে। গর্ভপাত শুধুমাত্র হৃদয় বিদারক ঘটনাই নয়। এটি অত্যন্ত দুঃখজনকও বটে। এর ফলে সন্তানের পাশাপাশি মায়ের প্রাণনাশ পর্যন্ত ঘটতে পারে। আবার গর্ভপাত পরবর্তী সময়ে গর্ভধারণের ক্ষেত্রেও বিরাট প্রভাব ফেলতে সক্ষম। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একবার গর্ভপাত হওয়ার পরে শত চেষ্টা করেও আর গর্ভধারণ করতে পারছে না।

আয়োডিনের অভাব কিভাবে বুঝবেনঃ

কিছু কিছু লক্ষণ দেখে সহজেই বুঝে নিতে পারবেন গর্ভবতী মা বা কোন মানুষ আয়োডিনের অভাব ভুগছে কি না। লক্ষণগুলো হলো-
★ চোখে ফোলাভাব,

★ শুষ্ক ও বিবর্ণ ত্বক,
★ ভঙ্গুর নখ,

★ চুল পাতলা ও অমসৃণ হয়ে যাওয়া,

★ থাইরয়েড, প্রস্টেট, স্তন এবং অন্যান্য প্রজননতন্ত্র জনিত সমস্যা দেখা দেওয়া,
★ কোলেস্টেরলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া,

★ পেশীতে ব্যথা,

★ শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া,

★ ধীরগতিতে কথা বলা,

★ স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া,

★ বিষন্নতা,

★ ক্লান্ত অনুভব করা,

★ কোষ্ঠকাঠিন্য (অনেকের ক্ষেত্রে হয় না)

★ গয়েটর- থাইরয়েড গ্রন্থি বৃদ্ধির কারণে গলায় ফোলাভাব, শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা, খাবার, পানি বা ঢোক গিলতে সমস্যা হওয়া,

★ গর্ভাবস্থা সম্পর্কিত সমস্যা, যেমন- গর্ভস্রাব, মৃত সন্তান প্রসব করা, প্রি-ম্যাচুয়ার বা সময়ের আগে সন্তান জন্ম দেওয়া, এবং শিশুর মধ্যে জন্মগত ত্রুটি দেখা দেওয়া,

★ পিরিয়ডে তারতম্য হওয়া,

★ অনিচ্ছাকৃত ওজন বৃদ্ধি পাওয়া,

★ হাইপোথাইরোডিজম। অর্থাৎ ওজন বৃদ্ধি, অবসাদ, খাবারে অনীহা, শুষ্ক ত্বক ও বিষন্নতা ইত্যাদি।

মনে রাখবেন, গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে আয়োডিনের অভাব দেখা দিলে এর প্রভাব সন্তানের উপর সারাজীবন থেকে যায়।

আয়োডিন সমৃদ্ধ কিছু খাবারঃ

যদি দেখেন গর্ভাবস্থায় কোন নারী আয়োডিনের অভাবে ভুগছে তাহলে কি করবেন? কি খাওয়াবেন? খাবারে কি অনেক খরচ হবে? এমন অনেক প্রশ্ন তৈরি হতে পারে আমাদের মনে। চিন্তার কিছু নেই। আমাদের আশেপাশেই অনেক খাবার আছে, সেগুলো আয়োডিনের ভালো উৎস। শুধু জেনে নিতে হবে কি কি খাবার থেকে পাওয়া যাবে আয়োডিন।

★ ডিম
★ দুধ
★ চিংড়ি
★ টুনা মাছ, হালিবুট, হেরিং, সামুদ্রিক শৈবাল, সার্ডিন,
★ কড এবং কড লিভার ( প্রতি ১০০ গ্রাম কডে 135 mcg এবং ১০০ গ্রাম কড লিভারে 370 mcg আয়োডিন থাকে)।
★ দই
★ কলা
★ স্ট্রবেরি
★ বাদাম
★ মিষ্টি আলু
★ সবুজ শাক-সবজিতে ইত্যাদিতে প্রচুর আয়োডিন পাওয়া যায়।

আবার এসবের সাথে খাবারের সাথে পরিমাণমত লবণ খেয়েও আয়োডিনের ঘাটতি মেটানো যায়। তবে মনে রাখতে হবে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া যাবে না। এটি গর্ভবতী মায়ের পাশাপাশি গর্ভের সন্তানের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

নোটঃ এক বছরের নিচের সন্তানের খাবারে ভুলেও লবণ ব্যবহার করবেন না। এক বছরের নিচের বাচ্চার কিডনি লবণ পরিশোধন করতে পারে না। ফলে বাচ্চা কিডনির সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। ছোট অবস্থায় আক্রান্ত না হলেও বড় হয়ে কিডনির সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে ১ বছরের নিচের সন্তানের খাবারে লবণ ব্যবহার করা।

আরও পড়ুনঃ গর্ভে বা ভূমিষ্ট হওয়া সন্তান মারা যায় কেন? 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *