লিভার সিরোসিস: জানুন মরণঘাতী এই রোগ সম্পর্কে

★লিভার সিরোসিসঃ 

লিভার বা যকৃত রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকগণ।

লিভার সিরোসিস মারাত্মক ও অনিরাময়যোগ্য একটি রোগ। লিভারের বিভিন্ন প্রকার রোগের মধ্যে এটিকে চূড়ান্ত পর্যায়ের একটি রোগ বলে গণ্য করা হয়। এই রোগে আক্রান্ত হলে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট বা প্রতিস্থাপন ছাড়া পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করা সম্ভব নয়। লিভার ট্রান্সপ্লান্ট বা প্রতিস্থাপন অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি অপারেশন প্রক্রিয়া। আর লিভার প্রতিস্থাপন করলেই এই রোগ নির্মূল হবে এটাও বলা সম্ভব নয়। আর এই কারণেই রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পোস্ট এবং রক্তদাতার সন্ধান পেতে রেজিষ্ট্রেশন করুন ওয়েবসাইটে। রেজিষ্ট্রেশন করতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন।

roktobondhon.com/registration

বাংলাদেশে এই রোগে কতজন আক্রান্ত হয়েছে এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ধারণা করা হয়, দেশের হেপাটাইটিস বি ও সি রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক কোটিরও বেশি মানুষ। এদের পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ রোগী লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। সেই হিসাবে দেশে প্রায় ১৭ লাখ মানুষ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়।

★লিভার সিরোসিস কীঃ

প্রথমেই বলে রাখি, লিভার সিরোসিস আর লিভারের ক্যান্সার এক রোগ নয়। তবে লিভার সিরোসিস থেকে লিভারের ক্যান্সার হতে পারে বা হয়ে থাকে।

যখন লিভারের রোগের নানা পর্যায়ের পর কোষগুলো এমনভাবে আক্রান্ত হয় যে, লিভার আর কাজ করতে পারে না, সেই পর্যায়কে লিভার সিরোসিস বলে বর্ণনা করা হয়।

কেউ যখন এই রোগে আক্রান্ত হয়, তখন লিভার বা যকৃৎ তার স্বাভাবিক কাজগুলো, যেমন বিপাক ক্রিয়া, রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণ তৈরি, ঔষুধ ও রাসায়নিকের শোষণ, খাদ্যের পুষ্টি উপাদানের ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি করতে পারে না।

লিভার সিরোসিস হলে লিভার বা যকৃতে সূক্ষ্ম সুতার জালের মতো ফাইব্রোসিসের বিস্তার ঘটে। লিভাত বা যকৃতে তখন ছোট ছোট দানা বাঁধে। আস্তে আস্তে সেটির বিস্তার ঘটতে থাকে। ফাইব্রোসিস ছড়িয়ে পড়লে সেখানে আর লিভার নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে পারে না, ফলে লিভার সংকুচিত হয়ে পড়ে। আর এর ফলেই সৃষ্টি হয় লিভার সিরোসিস।

★লিভার সিরোসিস কেন হয়ঃ

ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী বলেন, হেপাটাইটিস বি, সি এবং ডি ভাইরাসের আক্রমণে লিভারে প্রদাহের তৈরি হয়। লিভারে প্রদাহের তৈরি করে বলেই একে বলা হয় হেপাটাইটিস, যার ফলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।

দীর্ঘদিন ধরে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের আক্রমণে লিভার বা যকৃতের কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে যায়, ফলে লিভারের কার্যক্রম আস্তে আস্তে ব্যাহত হয়। এরপর একেই লিভার সিরোসিস বলা হয়ে থাকে।এছাড়া আরও কয়েকটি কারণে লিভার সিরোসিস হতে পারে বলে জানান তিনি।

লিভার সিরোসিসেত আর একটি বড় কারণ ফ্যাটি লিভার বা যকৃতে চর্বি জমে যাওয়া। দীর্ঘদিন ধরে লিভারে যদি মাত্রাতিরিক্ত চর্বি জমে, তাহলে লিভারের কার্যকারিতা কমে যায়। এর ফলে লিভার সিরোসিস হতে পারে।

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী বলেন, ”শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে ফ্যাটি লিভার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আগামী ১৫ বছর পর লিভার সিরোসিসের বড় কারণ হবে ফ্যাটি লিভার। আর এদের অন্তত ২০ শতাংশ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হতে পারে।

আমাদের দেশে অন্তত ২০ শতাংশ মানুষ ফ্যাটি লিভারের কোন না কোন রোগে আক্রান্ত বলে সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৫ শতাংশ মানুষের নন-অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস জটিলতা রয়েছে।

এছাড়া দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস,শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, স্থূলতা,খাদ্যাভ্যাস,রক্তে কোলোরেস্টল ইত্যাদি কারণে ফ্যাটি লিভার হতে পারে।

অতিরিক্ত মদ্যপান, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ইচ্ছেমত ওষুধ সেবন, রাস্তাঘাটে বিক্রি হওয়া দূষিত পানীয়, ব্যবহার করা বরফ, খোলা শরবত বা ফলের মাধ্যমে যকৃতের রোগ ছড়াতে পারে।

★ লিভার সিরোসিসের লক্ষ্মণগুলো কী:

চিকিৎসকরা বলছেন, লিভার সিরোসিসের শুরুর দিকে রোগীর শরীরে বাহ্যিক তেমন উপসর্গ থাকে না বা দেখা যায় না। অনেক সময় পেটের আলট্রাসাউন্ড কিংবা পেটে অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে এই রোগটি ধরা পড়ে। জন্ডিসও লিভার রোগের একটি লক্ষণ। রক্ত পরীক্ষা, বায়োপসি, সিটি স্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমেও রোগটি শনাক্ত হতে পারে।

ডা. মোহাম্মদ আলী বলেন, কিছু লক্ষণ দেখা গেলে লিভার বা যকৃতের রোগের বিষয়ে সতর্ক হতে হবে এবং দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

শারীরিক দুর্বলতা, খাবারে অরুচি, পেটে অস্বস্তি, ওজন কমে যাওয়া. পেট ফুলে যাওয়া, অবসাদ ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

এছাড়াও লিভার সিরোসিস হলে পেটে বা পায়ে পানি আসতে পারে, চোখ ও প্রস্রাব হলুদ হতে পারে। অনেকে চেতনা হারিয়ে কোমায়ও চলে যেতে পারেন।

লিভার সিরোসিসের চিকিৎসাঃ

চিকিৎসকগণ লিভার বা যকৃতের রোগে চিকিৎসার চেয়ে প্রতিকারের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

বর্তমানে বিশ্বে লিভার সিরোসিসের অনেক আধুনিক চিকিৎসা উদ্ভাবিত হয়েছে। বিশেষ করে হেপাটাইটিস বি-র ক্ষেত্রে শিশুদের জন্মের পরপরই টিকা দেয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্করাও এই টিকা নিতে পারেন।

হেপাটাইটিস সি- থেকে বাঁচতে এক রেজারে বা ব্লেডে একাধিক ব্যক্তির শেভ না করা, রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা পরীক্ষা করে নেয়া, অরক্ষিত যৌন সম্পর্ক পরিহার – ইত্যাদির মাধ্যমে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

দূষিত পানি, অতিরিক্ত মদ্যপান, খোলা খাবার, ফলমূলের মতো যেসব কারণে যকৃতের রোগ হয়, সেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।

২০৩০ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ শিশুর হেপাটাইটিস ‘বি’ টিকা নিশ্চিত করতে চায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ আলী বলছেন, ”অনেকগুলো কারণে লিভার সিরোসিস বা লিভারের রোগ হয়ে থাকে। সতর্ক হলে অনেকাংশে এগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, শারীরিক পরিশ্রম করা, ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা, কোলোস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনা, স্থূলতা দূর করা, অস্বাস্থ্যকর ও তেলযুক্ত খাবার পরিহার ইত্যাদির মাধ্যমে ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়।”

বাংলাদেশে এখন লিভার বা যকৃতের উন্নত মানের চিকিৎসা হচ্ছে। বড় শহরগুলোতে তো বটেই, জেলা বা উপজেলা পর্যায়েও চিকিৎসা সহজলভ্য করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

লিভার সিরোসিস হলে এই রোগটি সারা জীবন বহন করতে হয়। পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করা যায় না এই রোগ থেকে। তবে সঠিক চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জটিলতা কিছুটা দূর করা যেতে পারে।

এই রোগের ক্ষেত্রে সর্বশেষ বা আধুনিক চিকিৎসা হচ্ছে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট বা যকৃত প্রতিস্থাপন। বাংলাদেশেই এখন যকৃতের প্রতিস্থাপন সম্ভব হচ্ছে।

    তবে ব্যয়বহুল এই চিকিৎসায় বাংলাদেশে ৩৫ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।

আরও পড়ুন: ফ্যাটি লিভারের কারণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধ 

Leave a Comment