এমন একটি রোগ আছে যা সামান্য আঘাতেই একজন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। দেখবেন অনেক সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে দুর্ঘটনা কবলিত মানুষ মারা যায়। কিন্তু আহত মানুষটির আঘাত বা ক্ষত ছিল খুবই সামান্য বা মাঝারি আকারের। আহত ব্যক্তিটির কেন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে সেটা কি জানার চেষ্টা করি আমরা? হয়তো এই রোগটিই তার অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণ। আসুন এই পোস্ট থেকে জেনে নেই কি সেই রোগ।
এতক্ষন যে রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে আপনাদের জানানোর চেষ্টা করছিলাম সেই রোগটির নাম হিমোফিলিয়া। প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে একজন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। হিমোফিলিয়া বংশানুক্রমিক জিনগত একটি রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত জমাট বাঁধতে সমস্যা হয়। আর এজন্য একবার শরীরের ত্বক বা রক্তনালী কেটে গেলে সহজে আর রক্তপাত বন্ধ হয় না। যারা সাইন্স নিয়ে পড়ালেখা করেছেন বা সাইন্স সম্পর্কে ধারণা আছে তারা জানেন নারীদের মাঝে দুটি এক্স ক্রোমোজোম থাকে আর পুরুষদের একটি। নারীদের ক্রোমোজম দুটির এক্স ও অপরটি ওয়াই ক্রোমোজোম। আর পুরুষের দেহে থাকে শুধু X ক্রোমোজম। হিমোফিলিয়া রোগটি Y ক্রোমোজমের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। যেহেতু পুরুষের মাঝে Y ক্রোমোজম নেই, নারীরা এই রোগের বাহক অর্থাৎ নারীদের থেকে এই রোগ সন্তানের দেহে ছড়ায়। আর শুধুমাত্র পুরুষরাই এই রোগে আক্রান্ত হয়।
অর্থাৎ মায়ের শরীর থেকে এটি ছেলে সন্তানের শরীরকে আক্রান্ত করে।
হিমোফিলিয়ায় আক্রান্তের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা, প্রতিকার ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন নিচের আলোচনায়।
★হিমোফিলিয়া কিঃ
কোনরকম আঘাত লাগলে বা কেটে গেলে রক্তক্ষরণ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায় সামান্য কেটে গেলেও কেটে যাওয়া অংশ থেকে সহজে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না এবং দীর্ঘ সময় ধরে এই রক্তক্ষরণ চলতেই থাকে। এই রোগকেই বলা হয় হিমোফিলিয়া।
মানবদেহের রক্তে ১৩ প্রকার রক্তজমাটকারী প্রোটিন বা উপাদান থাকে। আর এসব উপাদান প্লাটিলেটের (ছোট রক্তকোষ যা বোনম্যারোতে তৈরি হয়) সাথে যুক্ত হয়ে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। এই রক্তজমাটকারী প্রোটিন বা clotting factors -এর পরিমাণ কম থাকলে রক্ত জমাট বাঁধতে দেরি হয়। আর তখনই তখন এই রোগ সৃষ্টি হয়। এই ব্যাধির রোগীরা ইন্টারনাল ব্লিডিং এর মুখোমুখিও হতে পারে। যার কারণে অস্থিসন্ধিগুলোতে অর্থাৎ জয়েন্টে জয়েন্টে যেমন হাঁটু,কনুই কাঁধ ইত্যাদি স্থানে চূড়ান্ত ব্যথা হয় । যার থেকে রোগীর প্রাণহানিও হতে পারে।
★হিমোফিলিয়া কত প্রকারঃ
A,B এবং C-এই তিন ধরনের হিমোফিলিয়া হয়ে থাকে। এদের মধ্যে সবচেয় কমন হিমোফিলিয়া A। এই রোগটি রক্তে ফ্যাক্টর VIII এর অভাবে হয়ে থাকে। সমীক্ষায় দেখা যায়, ১০ জন হিমোফিলিয়া রোগীর মধ্যে ৮ জনই এই ধরনে আক্রান্ত। হিমোফিলিয়া B কে বলা হয় খ্রিস্টমাস ডিজিস। যা ফ্যাক্টর IX এর অভাবে হয়ে থাকে। আর হিমোফিলিয়া C যাদের হয়ে থাকে তাদের উপসর্গ প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। আর এটি এই রোগের মধ্যে সবচেয়ে বিরল ঘটনা বলা যায় এই ধরনটিকে। সাধারণত এটি হয়ে থাকে ফ্যাক্টর XI এর অভাবে। এই ধরণের হিমোফিলিয়া রোগীদের সচরাচর সামান্য দুর্ঘটনায় বা আঘাতে রক্তপাত হয় না। তবে কোন অপারেশন করার প্রয়োজন হলে অপারেশনের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে।
হিমোফিলিয়া সাধারণত জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে। এবং খুব কম ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যায় যেখানে সদ্যজাত শিশুর শরীরে হিমোফিলিয়ার লক্ষণ বা জীবাণু ধরা পড়েছে। একে অ্যাকুয়ারড হিমোফিলিয়া বা acquired hemophilia বলা হয়। এটি হয়ে থাকে যাদের ইমিউনিটি সিস্টেম VIII বা IX ফ্যাক্টরকে আক্রমন করে।
★হিমোফিলিয়ার কারণঃ
মানুষের শরীরে কোয়াগুলেশন ক্যাসকেড নামে একটি পদ্ধতি হয়ে থাকে, যা রক্তপাতের সময় রক্তকে আস্তে আস্তে জমাট বাঁধতে এবং ক্ষরণ বন্ধ হতে সাহায্য করে। শরীরে বিভিন্ন ক্লটিং ফ্যাক্টরগুলোর অভাব বা স্বল্পতা তৈরি হলে রক্তপাত বন্ধ হতে পারে না। আর এই সমস্যা জেনেটিক কারণেই হয়ে থাকে। অর্থাৎ পরিবারের কোন ব্যক্তির হিমোফিলিয়া থাকলে পরবর্তী জেনারেশনেও এই রোগটি চলে আসে। এই বডি ফ্যাক্টরগুলি অর্থাৎ VIII, IX, XI থাকে X ক্রোমোজোমের মধ্যে।
আমরা এটা জানি যে, প্রত্যেকেই তাদের বাবা-মায়ের থেকে দুটি করে ক্রোমোজোম পেয়ে থাকে। পুরুষরা মায়ের থেকে পেয়ে থাকে X ক্রোমোজোম এবং বাবার থেকে Y ক্রোমোজোম। আর মেয়েরা বাবা এবং মা উভয়ের থেকেই পায় X ক্রোমোজোম। এই রোগটি মূলত X ক্রোমোজোম থেকেই তৈরি হয়ে থাকে। আর এ কারণে বাবার থেকে ছেলের মধ্যে এই রোগ আসতে পারে না।
সুতরাং, ছেলেদের শরীরে এই রোগটি বাবা নয় মায়ের থেকেই আসা সম্ভব । যেসব মহিলাদের একটি X ক্রোমোজোম পরিবর্তিত হয়, তাদের ক্ষেত্রে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ। আর যার ‘কেরিয়ার ওমেন’ হয়ে থাকে অর্থাৎ যার জিন পরিবর্তিত হয় এবং পর্যাপ্ত জিন ফ্যাক্টর থাকার কারণে নিজের মধ্যে এই রোগ দেখা যায় না, সে তার পরবর্তী জেনারেশনকে এই রোগে আক্রান্ত করতে পারেন।
★হিমোফিলিয়া রোগের লক্ষণঃ
হিমোফিলিয়ার লক্ষণগুলো ক্লটিং ফ্যাক্টরের প্রকারভেদের উপর নির্ভর করে নির্ণয় করা হয়। যাদের এই ফ্যাক্টরের অভাব সামান্য, তাদের ট্রমার সময় রক্তপাতের সম্ভাবনা থাকতে পারে। আবার, যাদের ক্লটিং ফ্যাক্টরগুলির অভাবের পরিমাণ বেশি, তাদের দেহে স্বতঃস্ফূর্ত রক্তপাত হয়। রোগীর দেহে কিছু লক্ষণ দেখে ডাক্তার প্রাথমিকভাবে ধারণা করেন রোগী হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত। এই লক্ষণগুলো হচ্ছে–
→ পায়খানা এবং প্রস্রাবে রক্ত আসা,
→ শরীরে কালচে দাগ,
→ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ,
→ নাক থেকে বারবার বা মাঝে মাঝে রক্ত ক্ষরণ হওয়া,
→ অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টে ব্যাথা অনুভব করা।
★★ সচরাচর প্রথমেই রোগীকে হাসপাতালে নিতে হয় এমনটা নয়। তবে কিছু পর্যায়ে বা রোগীর শারীরিক কিছু সমস্যার উপর ভিত্তি করে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হয়। লক্ষণগুলো হলো–
→ অসম্ভব মাথা ব্যথা,
→ অনবরত বমি হওয়া,
→ তীব্র ঘাড় ব্যাথা,
→ চোখের দৃষ্টি আবছা বা ঝাপসা হয়ে যাওয়া,
→ কোন ক্ষতস্থান থেকে একনাগারে রক্তক্ষরণ এবং রক্ত বন্ধ না হওয়া।
রক্তদাতা খুঁজে পেতে রেজিষ্ট্রেশন করুন । রেজিষ্ট্রেশন লিংকঃ
★ হিমোফিলিয়ার রিস্ক ফ্যাক্টর এবং এর প্রভাবে যে সকল সমস্যা হতে পারেঃ
হিমোফিলিয়া A এবং B বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জিন থেকেই পরিবাহিত হয়। এই দুই টাইপে মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি দেখা যায়। হিমোফিলিয়া C আবার পুরুষ এবং স্ত্রী উভয়কেই আক্রান্ত করে থাকে।
অস্থিসন্ধিতে অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে যখম হতে পারে। অনেক সময় ইন্টারনাল ব্লিডিং থেকে নিউরোলোজিক্যাল সমস্যা যেমন– স্ট্রোক, ব্রেন হ্যামারেজ, নার্ভ ড্যামেজ ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি রক্তদান করেন তাহলে যাকে রক্তদান করবে তার শরীরে হেপাটাইটিস বি বা সি এর মত জীবাণু বাসা বাঁধতে পারে। আর এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা ৭৫-৯৫ শতাংশ।
★ হিমোফিলিয়া রোগের চিকিৎসাঃ
প্রাথমিকভাবে ডাক্তারগণ রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগটি এবং রোগীর দেহে কোন ধরনের হিমোফিলিয়ার আছে এটি নির্ণয় করে থাকে। যদি রক্তের প্লাজমায় ক্লটিং ফ্যাক্টরের পরিমান ৫-৪০ শতাংশ হয়, তাহলে মেডিকেলের ভাষায় এটিকে বলা হয় মাইল্ড হিমোফিলিয়া। প্লাজমায় ক্লটিং ফ্যাক্টরের পরিমান ১-৫ শতাংশ হলে এই ধরনের হিমোফিলিয়াকে বলা হয় মডারেট হিমোফিলিয়া। আর শরীরে হিমোফিলিয়া জীবাণুর পরিমাণ ৪০ শতাংশের বেশি হলে তাদের সেভেয়ার হেমোফিলিয়া বলা হয়। এক্ষেত্রে ক্লটিং ফ্যাক্টরগুলোর পরিমান ১ শতাংশেরও কম হয়ে থাকে। অর্থাৎ শরীরে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে মাত্র ১ শতাংশ।
যেহেতু এই রোগটি জেনেটিক কারণে হয়। তাই এই রোগকে সম্পূর্ণরুপে নির্মূল করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তবে যথাযথ চিকিৎসা ও সচেতনতার মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
যারা হিমোফিলিয়া A তে আক্রান্ত, তাদের শরীরে নির্দিষ্ট সময় পরপর ডেসমোপ্রেসিন নামক হরমোন ইঞ্জেক্ট করতে হয়। ক্লটিং ফ্যাক্টরগুলোকে উত্তেজিত বা সচল করে তোলার জন্য এই ইঞ্জেকশন রোগীর শরীরে পুশ করতে হয়।
হিমোফিলিয়া B আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করা হয় রোগীর দেহে রক্ত সরবরাহের মাধ্যমে। আবার অনেক সময় কৃত্রিমভাবেও ক্লটিং ফ্যাক্টরগুলোকে রক্তে চালিত করতে হয়। এই কৃত্রিম পদ্ধতিকে বলা হয় রিকোমব্যায়ান্ট ক্লটিং ফ্যাক্টর সিস্টেম।
আর হিমোফিলিয়া C আক্রান্ত রোগীকে প্লাজমা ইনফিউসনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
★হিমোফিলিয়া কিভাবে প্রতিরোধ করা যেতে পারেঃ
ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছেন মায়ের থেকে তার সন্তানের মধ্যে এই রোগটি পরিবাহিত হয়। শিশুর দেহে এই ব্যাধি আছে কিনা এই বিষয়টি আগে থেকে বুঝা বা নির্ণয়ের কোন সুযোগই নেই। কিন্তু যদি ইনভিট্রো ফারটিলাইজেশন (IVF) পদ্ধতিতে কোন শিশুর জন্ম হয়ে থাকে, তাহলে গর্ভাবস্থায় পরীক্ষা করে হিমোফিলিয়াযুক্ত ডিম্বাণুগুলো আলাদা করে দেওয়া সম্ভব হয়। এতে করে সন্তানের হিমোফিলিয়ার ঝুঁকি ৯৫-৯৮ শতাংশ কমে যায়।
আসুন, সচেতন থাকি এবং সতর্কতার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধের চেষ্টা করি।
আরও পড়ুনঃ রক্ত দেখে ভয় পান? জানুন হিমোফোবিয়া কি?