গর্ভাবস্থায় কোন খাবার বিপদজনক।

মাতৃত্বের স্বাদ একজন নারীকে দেয় নারীর পূর্ণতা। প্রতিটি নারী-ই চায় এই মধুর স্বাদ নিতে। গর্ভে সন্তান আসবে, কোলে সন্তানের খুনসুটি ও মজার মুহুর্তগুলো উপভোগ করবে এমন স্বপ্ন প্রতিটি নারীরই থাকে। আর গর্ভধারণ করার পরে গর্ভের সন্তানকে সুস্থ্য বা ভালো রাখতে সকলেই চেষ্টা করে গর্ভবতী মাকে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ানোর জন্য। তবে এমন কিছু খাবার আছে যা খেলে এসময় মা এবং গর্ভের সন্তানের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে।

শুধু হুমকি নয়, কিছু খাবার নিমেষেই গর্ভপাত ঘটিয়ে দিতে পারে যে কোন সময়। আবার এমন কিছু খাবার আছে, যেসব খাবার না খেলে মায়ের পুষ্টির অভাবের পাশাপাশি সন্তানের মানসিক এবং শারীরিক গঠন ঠিকমত গড়ে উঠে না।

আসুন আজ জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি, গর্ভাবস্থায় কি কি খাবার এড়িয়ে চলতে হবে একজন গর্ভবতী নারীকে।

★ আনারসঃ

আনারসে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ রয়েছে।  একই সাথে আনারসে ব্রোমেলেন নামক একটি উপাদানের উপস্থিতি রয়েছে। এটি ব্রোমেলেন ইনজাইম নামে পরিচিত। এই উপাদানটি জরায়ু মুখে দুর্বলতা সৃষ্টি করে। এই উপাদানের প্রভাবে প্রি-ম্যাচিওর ডেলিভারি বা গর্ভপাত ঘটার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এছাড়াও আনারসে এক ধরনের চিনির ঘনত্বের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এই উপাদান গর্ভাবস্থায় নারীকে ডায়াবেটিস সহ নারীর ওজন বৃদ্ধি এবং অন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। আনারস গর্ভাশয়ের সংকোচন ঘটানোর মত কাজও করতে পারে। যা ক্রমবর্ধমান গর্ভাবস্থার এবং গর্ভে থাকা সন্তানের জন্য মোটেও ভালো না।

★ পেঁপেঃ
বিশেষ করে কাঁচা পেঁপে গর্ভাবস্থায় নারীদের ক্ষতির অন্যতম কারণ বলে গবেষণায় প্রমানিত। কাঁচা পেঁপেতে সাদা কসের মত যে জিনিসটি আমরা দেখতে পারি, তার নাম ল্যাটেক্স। ল্যাটেক্স গর্ভাশয়ের সংকোচন করে থাকে। যা করে গর্ভে থাকা সন্তানের জন্য মারাত্মক হুমকি। এজন্য গর্ভবতী মায়েদের কাঁচা পেঁপে না খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিশেষ করে গর্ভধারণের প্রথম ৩ মাস এবং শেষের ৩ মাস কাঁচা ও আধা পেঁপে খাওয়া থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। কাঁচা পেঁপে ছাড়াও পিপেইন এনজাইম জাতীয় খাবারগুলোও এসময় এডিয়ে চলা উচিত। কাঁচা পেঁপে বা কাঁচা পেঁপের সালাদ এবং পিপেইন আছে এমন খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ এই খাবার খাওয়ার ফলে গর্ভাশয় সংকোচন হয়ে গর্ভপাত ঘটাতে সক্ষম। পাকা পেঁপেতে পিপেইনের পরিমাণ কম থাকে। পিপেইন ছাড়াও পাঁকা পেঁপেতে  অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এবং ভিটামিনের সাথে আরও কিছু পুষ্টি উপাদান থাকায় অনেক ডাক্তার গর্ভবতী মায়েদের নির্দিষ্ট পরিমাণে পাঁকা পেপে খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

★ আঙ্গুরঃ
আঙ্গুরে উচ্চমাত্রায় পেস্টিসাইড এবং রেসভারাট্রল এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। এসব উপাদান গর্ভবতী মায়ের শরীরে ‘টক্সিসিটি’ তৈরি করতে পারে। যার প্রভাবে গর্ভে থাকা সন্তানের ক্ষতি হতে পারে। পুষ্টিকর খাবার হলেও প্রথম ৩ মাস এবং শেষ ৩ মাস গর্ভবতী মায়েদের আঙ্গুর থেকে দূরে থাকাই ভালো। আর যদি আঙ্গুর খেতেই চান তাহলে গরম পানি ও লবণ মিশ্রিত পানি দিয়ে ভালোভাবে আঙ্গুর ধুয়ে নিয়ে অল্প পরিমাণে খেতে পারেন।

★ কলাঃ
অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি খাদ্য হচ্ছে এই। এটি শরীরে পুষ্টির জোগান দেওয়ার পাশাপাশি দ্রুতই শরীরকে এনার্জি এনে দেয়। তবে গর্ভাবস্থায় কিছু নারীর এ ফল থেকে দূরে থাকাই ভালো। এলার্জি আছে বা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এমন নারীদের কলা থেকে দূরে থাকতে হবে। কারণ কলায় থাকা কাইটিনেজ নামক উপাদান ডায়বেটিস আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

★ তেঁতুলঃ
তেঁতুলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। তেঁতুলে থাকা ভিটামিন সি-র পরিমাণ এতটাই বেশি যে, এটি প্রোজেস্টেরন হরমোনের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। আর শরীরে এই হরমোনের পরিমাণ কমে গেলে জরায়ু সংকোচিত হয়ে যায়। আর জরায়ু সংকোচন গর্ভপাত ঘটানোর অন্যতম কারণ।

★ খেজুরঃ
খেজুরে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, আয়রন এবং গ্লুকোজের উপস্থিতি পাওয়া যায়। খেজুর খেলে দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। আর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে দেহের পেশী সংকোচিত হতে থাকে। আর জরায়ুর পেশী সংকোচিত হলে সম্ভাবনা বেড়ে যায় গর্ভপাতের। তবে শরীরে ভিটামিন, আয়রন আর গ্লুকোজের ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রতিদিন ২ টি করে খেজুর খাওয়ানো যেতে পারে। এর বেশি নয়।
   
★ কাঁচা বা হাফ বয়েল ডিমঃ
গর্ভাবস্থায় কাঁচা বা হাফ বয়েল ডিম খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। আবার রোস্ট, গ্রীল, যে কোন চাপ এবং পোড়া মাংসও খাওয়া যাবে না এই অবস্থায়। কারণ এসব খাবারের মধ্যে টকসোপ্লাজমা নামক এক ধরণের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিত পাওয়া যায়। আর কাঁচা ডিমে স্যালমোনাল টাইফি ব্যাক্টিরিয়া থাকতে পারে। এর প্রভাবে গর্ভাবস্থায় টাইফয়েড হবার সম্ভাবনা প্রবল। এই ব্যাকটেরিয়া গর্ভাবস্থায় মায়ের চেয়ে সন্তানের জন্য বেশি ক্ষতিকর। সন্তানকে অপুষ্ট এবং নানা রোগে আক্রান্ত করতে সক্ষম এই ব্যাকটেরিয়া।

★ বাসি সালাদঃ
গর্ভবতী মায়েদের জন্য সবুজ সালাদ অত্যন্ত উপকারী এক খাদ্য। সবুজ সালাদ স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। তবে গর্ভাবস্থায় কখনোই অনেক আগে কেটে রাখা ফল বা সবজির সালাদ খাওয়া যাবে না। অনেক আগে কেটে রাখা সালাদে লিস্টেরিয়া প্যারাসাইড থাকে। লিস্টেরিয়া প্যারাসাইড মা ও গর্ভের সন্তানের জন্য খুবই ক্ষতিকর। সালাদে যেন কাঁচা বা আধা পাকা পেঁপে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

★ সজিনাঃ
গর্ভবতী মায়েদের সজিনা না খাওয়াই ভালো। সজিনায় প্রচুর পুষ্টিগুণ রয়েছে। কিন্তু সজিনায় থাকা ‘আলফা সিটেস্টেরল’ গর্ভপাত ঘটাতে পারে। তাই পুষ্টকর এবং পছন্দের খাবার হলেও গর্ভাবস্থায় সজিনা খাওয়ার মাধ্যমে এত বড় ঝুঁকি না নেওয়াই উত্তম।

★ কাঁচা দুধ ও অপাস্তুরিত দুধের খাবারঃ
কাঁচা দুধ, চিজ বা পনিরসহ জ্বাল না দেওয়া অপাস্তুরিত দুধ দ্বারা তৈরি সকল খাবার এসময় পরিহার করা উচিত। কারণ এসব খাবারে লিস্টেরিয়া, ই-কোলায়, স্যালমোনেলা এবং ক্যামফাইলো ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়। এসকল ব্যাকটেরিয়া ফুড পজজনিং ঘটাতে সক্ষম। যা মা ও সন্তানের জন্য ক্ষতিকর।
গর্ভাবস্থায় দুধ খেতে খাওয়া যতটা জরুরী, জ্বাল দিয়ে ভালোভাবে ফুটিয়ে তারপর দুধ খাওয়া তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

★ অতিরিক্ত চা, কফি এনার্জি ড্রিংকঃ

অনেকেরই  চা, কফি এবং এনার্জি ড্রিংক পান করার অভ্যাস থাকে। কিন্তু গর্ভাবস্থায় চা, কফি পান করার অভ্যাস কমানো খুবই জরুরী। কারণ চা এবং কফিতে ক্যাফেইন নামক উপাদান থাকে। শরীরে অতিরিক্ত ক্যাফেইন প্রবেশ করলে মিস ক্যারেজের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আবার ক্যাফেইন সন্তানের ওজন কমে গিয়ে অপুষ্ট সন্তান জন্মানোর সম্ভাবনাও বাড়িয়ে দেয়। আর এনার্জি ড্রিংক একেবারেই পরিহার করতে হবে। কারণ এনার্জি ড্রিংকে ক্যাফেইনের পাশাপাশি অন্য যে সকল উপাদান থাকে এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই মারাত্মক।

★ রিচ ফুডঃ
ফাস্ট ফুড, প্রসেস ফুড, কোল্ড ড্রিংস চা, কফি, চকলেট এসব বেশি খাওয়া যাবে না। না খাওয়াই উত্তম।

★ ফ্রিজের পানিঃ
গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এ অবস্থায় ঠান্ডা পানি পান করলে জরায়ু সংকোচন হয়ে যায়। আর এই অবস্থায় জরায়ু সংকোচন হলে গর্ভয়াতের সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়।

★ অ্যালোভেরার জুসঃ
পেট পরিষ্কার রাখতে বা চেহারার উজ্জ্বলতা বাড়াতে অনেকেই নিয়মিত অ্যালোভেরার জুস খেয়ে থাকেন। অন্য সময় এই খাদ্যটি উপকারী হলেও গর্ভাবস্থায় এই খাবার বিপদজনক। অ্যালোভের পেলভিক হেমারেজ ঘটাতে সক্ষম। আর পেলভিক হেমারেজের ফলে যে কোন সময় গর্ভপাতের মত দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই এই খাবারটি গর্ভাবস্থায় পরিহার করতে হবে।

★ কিছু সামুদ্রিক মাছঃ
কিছু সামদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণে পারদ বা মার্কারের পরিমাণ বেশি থাকে। এসব মাছের মধ্যে টুনা ফিস অন্যতম। সুতরাং এসময় এ জাতীয় মাছ না খাওয়াই উত্তম। কিছু মাছে লিস্টেরিয়া ইনফেকশনের উপস্থিতি রয়েছে। আবার অনেকের কিছু সামুদ্রিক মাছে এলার্জি জনিত সমস্যা দেখা যায়। এই এলার্জি খুবই মারাত্মক। এটি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় সামুদ্রিক মাছ এড়িয়ে চলাই ভালো।

★ ক্রিমির ঔষধঃ
প্রেগ্ন্যাসির সময় ক্রিমির ঔষধ খাওয়া যাবে না।

★ ডায়রিয়ার ঔষধঃ
গর্ভাবস্থায় ডায়রিয়া হলে মেট্রোনিডাজম জাতীয় ঔষধ খাওয়া যাবে না।

গর্ভাবস্থায় একজন নারীর প্রতি এক্সট্রা যত্নবান হতে হবে। কোন খাবার মা ও সন্তানের জন্য উপকারী আর কোনটা ক্ষতিকর সে বিষয়ে সঠিক তথ্য জেনে নেওয়াটা খুবই জরুরী। খাবারের পাশাপাশি জীবন-যাপনে সচেতন হতে হবে। আর বিশেষ করে লক্ষ্য রাখতে হবে এ সময় যেন কোন নারী কোনভাবে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। আর মানসিকভাবে যেন গর্ভবতী মা সবসময় প্রফুল্ল থাকে সে বিষয়ে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে।

মনে রাখবেন, মানসিক সুস্থতা মা ও সন্তানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 

আরও পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় কখন কখন আল্ট্রাসনোগ্রাম সন্তান ও মায়ের জীবনের ঝুঁকি কমায়? 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *