জানেন কি শীতকালে পায়ে ও হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা বেড়ে যায় কেন? কিভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে এই ব্যথা থেকে? আজকের আলোচনা থেকে জানতে পারবেন এই ব্যথা বেড়ে যাওয়ার কারণ আর প্রতিকার সম্পর্কে।
শীতকাল চলে এসেছে। আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। এসময় সারাদিন রোদের তাপে গরম অনুভূত হলেও সন্ধ্যা থেকে শীতের হিমেল ছোঁয়া শরীরকে শীতল অনুভূতি দিয়ে যাচ্ছে।
শীতের মৌসুমে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশ বেড়ে যায়। আর এসব রোগ শুধু ফ্লু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং শীতের প্রভাবে মানব দেহের বিভিন্ন স্থান যেমন- হাত, পা, পিঠ, ঘাড় বা কোমরের মত বিভিন্ন অংশে ব্যথা থাকলে সেই ব্যথা বেড়ে যায়। আর এর ফলে আমাদের চলাফেরা বেশ কষ্টকর হয়ে যায়। আবার অনেক সময় ভুগতে হয় নানা ভোগান্তিতেও।
শীতকালে শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা বা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যথা বাড়লেও সবচেয়ে বেশি ব্যথা বৃদ্ধি পায় আমাদের পায়ে। কেন শীতকালে পায়ের ব্যথা বেশি বেড়ে যায় এবং এই ব্যথা থেকে পরিত্রাণের উপায় সেই বিষয় নিয়েই আলোচনা থাকছে আমাদের আজকের এই পোস্টে।
বিশেষজ্ঞ সিনিয়র কনসালট্যান্ট, অর্থোপেডিক এবং জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট বেশ কিছু ডাক্তার শীতকালে কেন পায়ের ব্যথা বেড়ে যায় এই বিষয়ে কয়েকটি কারণ তুলে ধরেছেন। এর পাশাপাশি ঘরোয়া কিছু পদ্ধতি সম্পর্কেও জানিয়েছেন, যা পায়ের এই ব্যথাকে কমিয়ে দিতে বা সারিয়ে তুলতে সক্ষম। আসুন তাহলে জানি সেই সব কারণ এবং প্রতিরোধের ঘরোয়া পদ্ধতি সম্পর্কে।
পায়ের ব্যথা বৃদ্ধির কারণঃ
১. অতিরিক্ত পায়ের পরিশ্রম বা পায়ে চাপ পড়া,
২. পানিশূন্যতা,
৩. রক্তে ভিটামিন-ডি, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম বা পটাশিয়ামের ঘাটতি,
৪. পেশীর দুর্বলতা বা পেশী ক্লান্ত হলে,
৫. নমনীয়তার অভাব,
৬. জয়েন্ট, হাড়, পেশী, লিগামেন্ট, টেন্ডন, মিনিসকাস বা অন্যান্য টিস্যুতে আঘাত পেলে,
৭. পুরাতন আঘাত এবং সে সময় সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা না করানো।
৮. অতিরিক্ত ওজন।
আপনি বা আপনার পরিবারের কেউ যদি একটানা বেশ কিছুদিন অথবা খুব বেশি ব্যথা অনুভব করেন, তাহলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব ভালো এবং অভিজ্ঞ ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে। আর সেটা না করলে আপনার বা পরিবারের ভুক্তভোগী মানুষটির সমস্যা আরও বেশি বেড়ে যেতে পারে।
★ ঠান্ডা আবহাওয়াই কি পায়ের ব্যথা বৃদ্ধির জন্য দায়ী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, শীতকালে হাড়ের জয়েন্ট এবং পায়ের ব্যথা বা পেশীতে টান লাগা খুবই সাধারণ বিষয়। বিশেষ করে বয়ষ্ক ব্যক্তি এবং যারা আসীন বা অলস জীবন-যাপন করে এবং যাদের শরীরের ওজন বেশি তারা এই সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হয়।
মূলত দুইটি কারণে শীতে শরীরের ব্যথা বেড়ে যায়। সেগুলো হচ্ছে–
১. শীতকালে গতিশীলতা কমে যায়। এর ফলে হঠাৎ আমাদের পায়ে চাপ পড়ে ব্যথা হলে পারে।
২. সূর্যের আলো থেকে শীতকালে ভিটামিন ডি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। যার ফলে এসময় আমাদের শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি দেখা দিতে পারে৷ এর প্রভাবে আমাদের হাড়ে, হাড়ের জয়েন্টে এবং পায়ে ব্যথা বাড়তে পারে।
পায়ের ব্যথা কমানোর উপায়ঃ
★ স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবেঃ
ভিটামিন ডি, ভিটামিন সি, ওমেগা ৩ ও ফ্যাটি এসিড, আদা, সালমন ফিশ, সয়াবিন, বাদাম, বীজ জাতীয় খাবার, কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবার এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ সবুজ শাকসবজি রাখতে হবে শীতকালের খাদ্য তালিকায়। এই খাবারগুলো হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী।
★ ওজন কমাতে হবেঃ
পা এবং মাজার ব্যথার অন্যতম প্রধান কারণই হচ্ছে শরীরের অতিরিক্ত ওজন। আপনার শরীরের ওজন যদি অতিরিক্ত হয়ে থাকে বা আপনার শারীর যদি স্থূলকায় বা মোটা হয়ে থাকে, তাহলে আজ থেকেই ব্যায়াম এবং ডায়েটের মাধ্যমে ওজন কমানোর লড়াইয়ে নেমে পড়ুন। শারীরিক ওজন কমলে অটোমেটিকলি আপনার পা ও মাজার ব্যথা কমার সাথে সাথে শারীরিক অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়ে যাবেন৷ এসব সমস্যার মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, রক্তে কোলেস্টেরলের সমস্যা অন্যতম।
★ হাইড্রেটেড থাকতে হবেঃ
আমাদের পায়ে ক্রাম্প বা পেশীতে টান ধরার সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রধান কারণ হচ্ছে ডিহাইড্রেশন। অনিয়ন্ত্রিত পেশী সংকোচনকে বলা হয় ক্রাম্প। আমাদের শরীর পর্যাপ্ত আদ্র থাকলে পেশীর শিথিলতা বজায় থাকে। আর যদি শরীরে পর্যাপ্ত পানির ঘাটতি থাকে তাহলে আমাদের পেশীগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠে। এর ফলে পেশীতে ক্রাম্পিং বা পেশীর খিঁচুনি বেড়ে যায়। আর এর প্রভাবে পায়ের পেশীতে টান ধরে ব্যথার সৃষ্টি করে। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। প্রতিদিন ২.৫-৩ লিটার পানি পান করতে হবে। তবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি পান করা উচিত। রাতে অল্প পানি পান করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ। কারণ শীতের রাতে অলসতার কারণে অধিকাংশ মানুষ টয়লেটে যেতে চায় না বা অনেক সময় প্রস্রাব চেপে রাখে। এটি কিডনির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। রাতে কম পানি পান করলে প্রস্রাবের চাপ কম থাকে বা একদমই থাকে না। এতে করে কিডনির সমস্যা থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব।
★ ব্যায়াম বা যোগব্যায়াম করতে হবেঃ
শীতকালে অধিকাংশ মানুষই অলস জীবন যাপন করে থাকে। আর এ কারণে অনেক মানুষই ব্যায়াম বা শারীরিক চর্চা কমিয়ে দেয় বা একেবারেই বন্ধ করে দেয়। আর এই পর্যাপ্ত হাঁটাচলা এবং শরীর চর্চার অভাবে আমাদের পায়ের এবং মাজার পাশাপাশি অন্য জয়েন্টে ব্যথা বেড়ে যায়।
তাই শীতের সময় নিয়মিত কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ মিনিট ব্যায়াম বা যোগব্যায়াম করে শরীরকে চাঙ্গা রাখতে হবে। এর ফলে পায়ের এবং মাজার ব্যথা থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া যাবে। বিশেষ করে মাজা ও পায়ের জন্য উপকারী এমন কিছু ব্যায়াম করার চেষ্টা করতে হবে। জগিং, রানিং, স্কিপিং, থাইয়ের ব্যায়াম, বেলি মারার মত ব্যায়ামের পাশাপাশি পুশ আপ এর মত ব্যায়াম করতে পারেন। এসব না পারলে কমপক্ষে ১০ মিনিট পায়ের যোগব্যায়াম করার চেষ্টা করুন।
এত ফলে আপনার শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং স্নায়ুতন্ত্র প্রশমিত হবে। এর পাশাপাশি দেহে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক থাকবে, পা, পায়ের পেশী, নিতম্ব এবং মাজার পেশী ও হাড় শক্ত হবে। এসবের পাশাপাশি ব্যায়াম বা যোগব্যায়ামের কারণে গোড়ালি ও হাঁটুতে ব্যথা ও ফোলাভাব থাকলে সেটাও কমে যাবে ইনশা আল্লাহ।
★ মাংশ পেশীতে ম্যাসাজ করুনঃ
ব্যায়াম বা ওয়ার্কআউটের ফলে শরীরের যে সকল স্থানে বেশি চাপ বা ব্যথা অনুভব করবেন সে সকল স্থানের পেশীতে ম্যাসাজ করতে হবে। ফলে সেই সকল স্থানের পেশী চাপমুক্ত হবে এবং পেশীত ব্যথা কমে যাবে। আর অবশ্যই প্রতিদিন ব্যায়াম বা শরীরচর্চার আগে এবং পরে স্ট্রেচিং এবং কুলডাউন করে নিবেন। এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ শুরুতে স্ট্রেচিং এবং ব্যায়ামের শেষে কুল ডাউন না করলে রগে অথবা পেশীতে টান লাগতে পারে।
★ ঠান্ডা ও গরম সেক নিতে হবেঃ
পেশির ব্যথা কমাতে ঠান্ডা সেক নিতে পারেন। টাওয়েল বা গামছায় বরফের টুকরো নিয়ে পুটলি করে ব্যথার স্থানে সেক দিতে পারেন। এটি পেশীর খিঁচুনি, ব্যথা এবং ফোলাভাব কমাতে সহায়তা করবে।
আঘাত বেশিদিনের পুরাতন হলে গরম সেক নিতে হবে। গরম সেক পেশীর কম্প্রেস কমানো এবং দুর্বল পেশীকে সুস্থ্য করতে সহায়তা করবে। কোল্ড এলার্জি, মাইগ্রেন, সাইনাস বা সর্দি-জ্বর আছে এমন ব্যক্তিকে ঠান্ডা সেক নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
উপরোক্ত কাজগুলো করার পরেও যদি ব্যথা না কমে বা সমস্যা থেকে মুক্তি না মেলে, তাহলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে। বুকে বা মাথা এবং ঘাড়ে হঠাৎ ব্যথা হলে সরাসরি ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে৷ অনেক সময় হার্টের সমস্যা এবং স্ট্রোকের আগে বা স্ট্রোকের সময় বুকে ও ঘাড়ে ব্যথা হয়ে থাকে। শীতের কারণে ব্যথা হচ্ছে এমনটা ভেবে অনেকেই দেরি করে ফেলে। এতে অনেক মানুষ এসময় হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক করে মারা যায়।
আরও পড়ুনঃ সিজোফ্রেনিয়ায় কয়টি লক্ষণ আছে আপনার মাঝে।