এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস কি?

কোমরের ব্যথা ও প্রদাহজনিত বাত রোগকে বলা হয় এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস। রোগীর মেরুদণ্ডের অস্থিসন্ধিসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এই রোগে প্রভাবিত হয়। একেবারে নির্মূল করা সম্ভব না হলেও আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে কর্মক্ষম থাকা যায়। আধুনিক চিকিৎসা ও কি ধরণের জীবন-যাপনের মাধ্যমে এই রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় আজকের আলোচনা সেই বিষয়েই।

স্পন্ডিলো আর্থ্রাইটিস (স্পা) হচ্ছে বড় ধরনের বাত রোগ। যা শরীরে আরও কিছু রোগকে নিয়ে ছাতার মতো বিস্তার লাভ করে। অর্থাৎ স্পন্ডিলো আর্থ্রাইটিস নামক ছাতার নিচে আরও পাঁচ-ছয়টি রোগ নিজের ক্ষমতা স্থাপন করে। যার একটি হচ্ছে এই এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস। এনকাইলোজিং স্পান্ডিলাইটিস ছাড়াও অন্য রোগগুলো হচ্ছে রি-অ্যাকটিভ আর্থ্রাইটিস, সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস, ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ আর্থ্রাইটিস, ক্রনস ডিজিজ,জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস, ইত্যাদি।

তবে এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস নামক বাতের রোগটিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কর্মক্ষম তরুণ ও যুবকদের (সাধারণত ২৪ বছরের নিচের বয়সীদের) আক্রান্ত হয়ে থাকে। তুলনামূলকভাবে নারীদের থেকে পুরুষদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। ইদানীং এই রোগে আক্রান্তের হার অনেক বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

লক্ষণ বা উপসর্গঃ

♦ এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস রোগের মূল উপসর্গই হচ্ছে কোমর ব্যথা। প্রথম দিকে মৃদু ব্যথা থাকে বলে বেশিরভাগ রোগীই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে রোগী দেরি করে। এই ব্যথা আস্তে আস্তে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।

♦ রাতে ব্যথা বেড়ে ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমের সময় ব্যথায় রোগী বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে।

♦ ঘুম থেকে ওঠার পর কোমর অনড় বা অবশ হয়ে জমে থাকে। বেলা বাড়লে এবং হাঁটাচলা শুরু করলে আস্তে আস্তে ব্যথা কমতে থাকে।

♦ বিশ্রাম নিলে কোমড় ব্যথা বেড়ে যায় আবার কাজকর্ম শুরু করলে ব্যথা কমতে থাকে।

♦ কোমরে ব্যথা না হলেও বিভিন্ন অস্থিসন্ধি, যেমনঃ পায়ের বড় গিঁট বা হিপ জয়েন্ট, হাঁটু, হাতের কনুই ও কব্জি, পিঠের নিম্নাংশে ব্যথা হতে পারে বা ফুলে যেতে পারে। কোনও পায়ে ব্যথা বেশি আবার কোনও পায়ে কম ব্যথা হতে পারে।

♦ পায়ের মাংসপেশিগুলো যেখানে হাড়ের সঙ্গে লেগে থাকে, সেসব স্থানে আক্রণের ফলে ব্যথা হতে পারে।

♦ ত্বকে অস্বাভাবিক অনুভূতি হতে পারে।

♦ অনেকের ক্ষেত্রে এই রোগ চোখে আক্রমণ করতে পারে।

কারণঃ

পৃথিবীর ৮০-৯০ শতাংশ মানুষ জীবনে কখনও না কখনও কোমরে ব্যথা অনুভব করেন। কিছু ব্যথা আছে যা মানব দেহে কারণ ছাড়াই হয়ে থাকে। আমাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি সিস্টেম থাকে। এই ইমিউনিটি সিস্টেমের কাজ হচ্ছে শরীর পাহারা দেওয়া। শরীরে কোন রোগ অবস্থান করতে এলে তা প্রতিরোধ করা৷

কিন্তু হঠাৎ করে যখন এই ইমিউনিটি সিস্টেমই প্রতারণা বা বিদ্রোহ করে বসে, তখন এরাই জয়েন্ট, মাংসপেশি, হাড় প্রভৃতিকে আক্রমণ করতে থাকে। এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস জাতীয় বাত ব্যথা যেকোন মানুষেরই হতে পারে। এখন পর্যন্ত এর সুনির্দিষ্ট কোন কারণ জানা যায় নি।  তবে এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসের জন্য কিছু জিনিসকে দায়ী করা হয়।

বংশগতঃ

২০-২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে জেনেটিক কারণে বা বংশ পরম্পরায়
মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।

ভাইরাসঃ

কিছু কিছু ভাইরাস এই রোগের সাথে জড়িত। অর্থাৎ, কিছু ভাইরাসের প্রভাবে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

 

ব্যাকটেরিয়াঃ

কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে যা আক্রমণ করলে মানব দেহে এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস হতে পারে।

নির্ণয় বা সনাক্তের উপায়ঃ

ল্যাব টেস্টঃ

রক্তের নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই সমস্যা ধরা পড়ে। পরীক্ষার মধ্যে রয়েছেঃ সিবিসি, ইএসআর, সিআরপি, এইচএলএ-বি২৭ ইত্যাদি।

ইমেজিংঃ

মেরুদণ্ডের দুই পাশের দুই জয়েন্টকে স্যাক্রো ইলিয়াক (এসআই) জয়েন্ট বলা হয়। এই দুই জয়েন্টের এক্স-রের মাধ্যমে এই রোগটি নির্ণয় করা যায়৷ ক্ষেত্রবিশেষে হাড়ের সফট টিস্যুগুলোতে বিশেষ চিহ্ন বা লক্ষণ দেখে রোগ নির্ণয়ের জন্য এসআই জয়েন্টে সিটি স্ক্যান এবন্দ এমআরআই করিয়ে রোগ নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

আলট্রাসাউন্ডঃ

এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসে আক্রান্ত কি না মাস্কুস্কেলেটাল আলট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়। এ পরীক্ষাটি আমাদের দেশে বিএসএমএমইউ( সাবেক পিজি) হাসপাতালে করা হয়।

চিকিৎসা ও করণীয়ঃ

আধুনিক চিকিৎসায় এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসকে পুরোপুরি নির্মূল করা না গেলেও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। চিকিৎসার মাধ্যমে রোগী আর দশজনের মতোই কর্মক্ষম থাকতে পারে। রোগের ইতিহাস ও উপসর্গ জেনে, শরীরের কিছু চিহ্ন দেখে এবং কিছু পরীক্ষা করে রোগটি সঠিকভাবে শনাক্ত করে এই রোগের চিকিৎসা নিতে হবে। চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্যই হলো মেরুদণ্ডের জয়েন্টগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে দেহকে ব্যথামুক্ত রাখা।

ঔষধঃ

তীব্র ব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শে সাময়িক উপশমের জন্য ব্যথানাশক ঔষুধ খাওয়া যাবে। তবে ব্যথানাশক ঔষধ  বেশিদিন নয়। শুধু মেরুদণ্ডে যখন এই রোগ আক্রমণ করে, তখন রোগীকে ‘বায়োলজিকস’ নামক এক ধরনের নতুন ঔষুধ সেবন করানো হয়। এছাড়া কম খরচের কিছু ঔষুধ রয়েছে, যার মধ্যে থেলিডোমা অন্যতম ।

খাওয়ার জন্য আরও একটি ঔষুধ বাজারে এসেছে, যার জেনেরিক নাম ‘তোফাসিটিনিব’। এটি বর্তমানে আমাদের দেশের কয়েকটি ঔষুধ কম্পানি বাজারজাত করছে।

আবার যদি দেখা যায়, কোনো রোগীর মেরুদণ্ডের বাইরে অন্যান্য গিঁট, যেমন—পায়ের বড় গিঁট বা হিপ জয়েন্ট, হাঁটু এবং হাতের গিঁটগুলোতে আক্রমণ করে অথবা মাংসপেশিতে প্রদাহ তৈরি করে, তখন চিকিৎসগণ এসবঔষধের সাথে আরও কিছু ঔষুধ সেবন করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন ।

স্টেরয়েডঃ

কিছুটা অ্যাডভান্সড লেভেলের চিকিৎসগণ রোগীকে স্টেরয়েড-জাতীয় কিছু ঔষধ বা ইনজেকশন প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এই চিকিৎসায় বেশ সফলতাও পাওয়া যায়। স্টেরয়েড জাতীয় একটি ঔষধ হচ্ছে  ‘সালফাসেলাজিন’,। এই স্টেরয়েড রোগকে ভেতর থেকে বাধা প্রদান করে। তবে কিডনি ও লিভারের ওপর এই ঔষধ বা ইঞ্জেকশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি বিধায় এই ঔষধ  প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।

ফিজিওথেরাপিঃ

এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসে ব্যায়াম বা ফিজিওথেরাপি একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা। পেশি ও হাড়ের শক্তি বজায়সহ ফ্রিজ হওয়া থেকে রক্ষা করে ফিজিও থেরাপি । পাশাপাশি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতেও বেশ কার্যকর ব্যবস্থা এটি। রিউমাটোলজিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট বা ফিজিক্যল মেডিসিনের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ‘রেঞ্জ অব মোশন’ এবং স্ট্রাকিংয়ের কিছু নির্দিষ্ট ব্যায়ামের মাধ্যমে বেশ ভালো ফল পাওয়া যায় এই চিকিৎসায়। এসব থেরাপি  মাংসপেশিগুলোকে শক্তিশালী ও কর্মক্ষম রেখে অন্যান্য জটিলতা থেকে রক্ষা করে। আবার ভালো ঘুম হওয়ার পাশাপাশি দৈনন্দিন কাজগুলো সহজ করে দিতেও ফিজিও থেরাপি বেশ কার্যকর।

সার্জারীঃ

কিছু কিছু রোগীর সুস্থতার জন্য সার্জারীর প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে পায়ের দিকের যাদের অবশ অবশ লাগে, যাদের প্রস্রাব-পায়খানায় সমস্যা হয় বা ঔষধ বা থেরাপিতে কাজ হয় না এসব রোগীর জন্য সার্জারি লাগতে পারে।

ভয়াবহতাঃ

এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস দেহের জয়েন্টের পাশাপাশি অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও আক্রান্ত করতে পারে। এমনকি এই রোগে চোখও আক্রান্ত হতে পারে। চক্ষু চিকিৎসকরা যদি মনে করবেন, এর সঙ্গে বাত রোগের সম্পর্ক রয়েছে। তখন তিনি একজন রিউমাটোলজিস্টের কাছে রোগিকে রেফার করে থাকেন। তখন রোগীকে যৌথ ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা নিতে হয়।

♦ প্রায় ২০-৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে অনান্য গিঁট, যেমন—ঊরুসন্ধি বা হিপ জয়েন্ট ও হাঁটুসন্ধি আক্রান্ত হয়ে থাকে।

♦ হৃদ্যন্ত্রের কপাটিকা বা হার্টের ভালেভর সমস্যা হতে পারে।

♦ চোখে ব্যথাযুক্ত প্রদাহ ‘ইউভাইটিস’ অথবা ‘আইরাইটিস’ হতে পারে।

♦ স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ করে স্নায়ুগুলো দুর্বল করার মাধ্যমে নানা জটিলতা তৈরি করতে পারে।

♦ দেহে দীর্ঘদিন এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস থাকলে এবং চিকিৎসা না নিলে রোগীর অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয়জাতীয় রোগ হতে পারে।

এসব ছাড়াও আক্রান্তের দেহে আদৃশ্য কিছু জটিলতাও তৈরি হতে পারে। তাই রোগ নির্ণয় করে দ্রুত চিকিৎসা নিয়ে কর্মক্ষম থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।

প্রতিরোধে করণীয়ঃ

এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস প্রতিরোধ করার মতো কোনো উপায় বা চিকিৎসা এখন পর্যন্ত বের হয়নি। এর জন্য আগে থেকেই করণীয়ও কিছু নেই। তবে এই রোগে আক্রান্ত হলে আতঙ্কিত হওয়ারও কিছু নেই। রোগের লক্ষণ দেখা দিলে রোগ শনাক্ত করে দ্রুত চিকিৎসা নিলে সুস্থ বা কর্মক্ষম থাকা সম্ভব। তাই যখনই কোমরে ব্যথা হবে, দেরি না করে তখনই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখিয়ে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত । এ রোগ থেকে সুরক্ষার জন্য আজকাল ধূমপান থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ধুমপান এই রোগের প্রভাব বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে গবেষণায় প্রমানিত।

সুস্থতা সাফল্যের চাবিকাঠি। আর সুস্থ থাকতে হলে চিকিৎসা নিতে হবে সঠিক সময়ে সঠিক নিয়মে।

আরও পড়ুনঃ নিউরোব্লাস্টোমা ক্যান্সার কি? 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *