অনেকেরই ধারণা জরায়ুর টিউমার মানেই ক্যান্সার। অর্থাৎ, জরায়ু টিউমার হয়েছে মানেই রোগী ক্যান্সারে আক্রন্ত হয়ে গেছে বা আক্রান্ত হবে। এটি সম্পূর্ণ ভুল একটি ধারনা। রোগী কি ধরণের টিউমারে আক্রান্ত সেটি নির্ণয়ের মাধ্যমে এবং টিউমারটির ধরণ ও আকার নির্ণয় এবং কিছু পরীক্ষার মাধ্যমের জানা যায় টিউমারটি আসলে ক্যান্সারে রুপ নিয়েছে কি না। নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আল্ট্রাসনোগ্রাফি এবং রক্তসহ আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরীক্ষা করতে হয়। এ সকল পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরের অভ্যন্তরের অনেক রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব। এক্স-রে রেডিয়েশনে শরীরে যে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এক্ষেত্রে রোগে প্রভাব ফেলার কোন সম্ভাবনাই নেই। এখন গ্রামগঞ্জে হাতুড়ে ডাক্তাররাও রোগীর রোগ নির্ণয়ে আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করার পরামর্শ দিচ্ছেন।
জরায়ুতে ফাইব্রয়েড টিউমারের উৎপত্তির কারণ সঠিকভাবে চিহ্নিত করা না গেলেও মনে করা হয় এর উৎপত্তি জরায়ুর অপরিণত মাংসপেশির কারণেই। এই টিউমার মধ্যবয়সী মহিলা, বিশেষ করে যাদের বিয়ে হয়নি তাদের মধ্যে দেহে প্রায়ই পাওয়া যায়। আবার টিউমারের কোন লক্ষণ না থাকলেও ৩০ বছর বয়সের অধিক মহিলার অন্য কোন কারণে তলপেটের আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করা হয়, তাহলে প্রায় ৪০ শতাংশ মহিলার জরায়ুতে মটর দানার মতো ছোট আকারের ১টি বা ২টি ফাইব্রয়েড টিউমার ধরা পড়ছে। টিউমারজনিত কোন লক্ষণ বা সমস্যা না থাকলে এই টিউমারে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। এই টিউমার বিনাইন অর্থাৎ ক্যান্সার নয়। আর এই টিউমার ক্যান্সারে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
ফাইব্রয়েড টিউমারের সমস্যা ও লক্ষণঃ
জরায়ুতে টিউমারের জন্য যে সমস্যাগুলো দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে,
★ মাসিকের সময় তলপেটের ব্যথা,
★ অতিরিক্ত রক্তস্রাব,
★ অনেকদিন যাবৎ রক্তস্রাব এবং অধিক রক্তস্রাবের জন্য রক্তাল্পতা ইত্যাদি।
যদি টিউমারের জন্য শুক্রকীট ও ডিম্বাণুর গমনপথ বাধাপ্রাপ্ত হয় তাহলে রোগী বন্ধ্যাত্বে পরিণত হবে। “টিউমার” যদি আয়তনে খুব বড় হয় তাহলে টিউমারের প্রেসারের জন্য প্রস্রাবের সমস্যা, মলত্যাগে সমস্যা এবং কোমরে ও পায়ে যন্ত্রণা হবে। আর যদি টিউমারের প্রেসার ইউরেটার অর্থাৎ প্রস্রাববাহী নালিতে পড়ে তাহলে রোগীর কিডনী ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। গর্ভবতী মহিলা যদি এই টিউমারে আক্রান্ত হয় তাহলে টিউমারের জন্য যে কোন সময় কারণ ব্যতীত গর্ভপাত এমনকি বারবার গর্ভপাত হতে পারে। আর গর্ভপাত না হলে টিউমারের জন্য গর্ভস্থ সন্তানের অস্বাভাবিক পজিশোন এবং এজন্য প্রসবকালীন নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে অত্যাধিক রক্তপাত ঘটার ফলে রোগী মারাত্মক বিপদের মুখোমুখি হতে পারে। গর্ভাবস্থায় টিউমারের বিশেষ পরিবর্তনের জন্য রোগীর তলপেটে অস্বাভাবিক ব্যথা, জ্বর, যোনিপথ দিয়ে পচা মাছের মত দুর্গন্ধপূর্ণ স্রাব নির্গত হতে পারে। এই অবস্থাকে “রেড ডিজানেরশন” বলা হয়। আবার টিউমার অনেকদিন ধরে জরায়ুতে থাকলে টিউমারের আকৃতির পরিবর্তন এবং টিউমারে ক্যালসিয়াম সল্ট জমা হওয়ায় টিউমারটি পাথরের মত শক্ত হয়ে যায়। যাকে বলা হয় ‘উম্ব স্টোন’।
এই টিউমার রোগীর জরায়ুতে এক বা একাধিক হতে পারে। সমস্যা ও রোগের লক্ষণ নির্ভর করে টিউমারের আয়তন, বিশেষ করে জরায়ুতে টিউমারের পজিশনের উপরে। টিউমার যদি জরায়ুর উপরিভাগে থাকে তবে সাধারণত বড় কোন সমস্যা হয় না। তবে টিউমার যদি জরায়ুর মাংসপেশির মধ্যে বা জরায়ুর গহ্বরে ‘এন্ডোমেট্রিয়ামের’ কাছে থাকে তবে সব রকম সমস্যা হতে পারে। এমনকি রুপ নিতে পারে ক্যান্সারে। রোগীর সমস্যা জেনে কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়। রোগীর তলপেট,রক্ত,প্রস্রাব এবং আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে নিশ্চিত হওয়া যায় রোগী কি টিউমারে আক্রান্ত।
চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর সমস্যার গুরুত্ব এবং বয়সের উপর। কোন সমস্যা না থাকলে সচরাচর কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। রোগীর বয়স, টিউমারের বয়স, টিউমারের আকৃতি ও রোগীর সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসার পদ্ধতি কি হবে তা ঠিক করা হয়।
কুমারী মেয়েদের টিউমার হলে সাধারণত প্রোজেস্টোজেন, ড্যানাজল, লিউপ্রাইড জাতীয় ঔষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু এই চিকিৎসা সাময়িক। এর সকল ঔষুধের মাধ্যমে টিউমার নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়। যদি এই ধরণের মেয়েদের সমস্যা বেশি হতে থাকে তাহলে পরিবর্তন করা হয় চিকিৎসা পদ্ধতি।
যদি বিয়ের পর দেখা যায় এই টিউমার বন্ধ্যাত্বের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাহএল দেরি না করে ‘মায়মেকটমি’ অর্থাৎ জরায়ুর ভেতর থেকে কেমলমাত্র টিউমারটি অপারেশনের মাধ্যমে অপসারণ করে দেওয়া হয় । অপারেশনের পর ‘ক্রোমোটিউবেশন’ অর্থাৎ জরায়ুর গহ্বরে ডাই পুশ করে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর গমনপথের বাঁধা দূর হয়েছে কি না। আরও কোন সমস্যা আছে কিনা দেখে নিয়ে ‘গিলিয়ামস অপারেশন’ অর্থাৎ জরায়ু যেন সঠিক অবস্থানে থাকে এজন্য এই অপারেশন করা প্রয়োজন।
কিন্তু রোগীর বয়স যদি ৪০ বছরের বেশি হয়ে থাকে এবং সন্তানধারণের কোন প্রশ্ন না থাকে তবে টিউমারসহ জরায়ুর এবং দুই ওভারি কেটে বাদ দিয়ে দিতে হবে। ওভারি বাদ দেওয়ার বিষয়ে মতান্তর থাকলেও আমাদের দেশে অপারেশন পরে রোগীরা সঠিকভাবে চেকআপে আসেন না এজন্য ওভারি কেটে ফেলাই শ্রেয়। সঠিক চেকআপ না করানোর কারণে অপারেশনের পরে কোন সমস্যা থেকে থাকলে তা নির্মূল করা সম্ভব হয় না। ফলে মনোপজের জন্য মানসিক সমস্যা এবং ওভারির ক্যান্সারে মৃত্যুর হার আমাদের দেশে সব থেকে বেশি ঘটে থাকে। এজন্য জরায়ুর সঙ্গে দুই ওভারি বাদ দেওয়ার শ্রেয় বলে পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ জরায়ু বাদ দেওয়ার পর ওভারি দুটির নিজে থেকেই কর্মক্ষমতা শেষ হয়ে যায়, কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায় এবং অনেকেই আক্রান্ত হয়। জীবনের নিশ্চয়তায় জরায়ুর সঙ্গে ওভারি বাদ দিলে রোগীর বাকি জীবনটা কাটবে নিরাপত্তায় উদ্বেগহীনভাবে।
আরও পড়ুনঃ জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হয় কখন।
https://roktobondhon.com/polycythemia/
Pingback: স্তন ক্যান্সার কি? - রক্ত বন্ধন - Rokto Bondhon