জেনে রাখুন কিডনী রোগে আক্রান্তের ৫টি লক্ষণ ও ১০টি ভুল ধারণা সম্পর্কে ।

যে ৫টি লক্ষণে বুঝে নিবেন রোগী কিডনি রোগে ভুগছেনঃ

কিডনি শরীরের অঅত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এটি শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ ফিল্টার করে থাকে। শারীরিক বিভিন্ন রোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এসব রোগের কারণে কিডনি শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলোকে ফিল্টার করতে পারে না। ফলে শরীরে টক্সিন তৈরি হয়। এতে করে তৈরি হয় কিডনির সমস্যা। ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত নয় এমন ব্যক্তি যদি শারীরিকভাবে সুস্থ থাকেন তাহলে তার জন্য কিডনি দান কোন ঝুঁকির বিষয় নয়।
অন্যদিকে কিডনিতে সমস্যা তৈরি হলেও তা শরীরে প্রথমদিকে প্রকাশ পায় না। কিডনির রোগ অনেকটাই ‘সাইলেন্ট কিলার’ এর মত কাজ করে। কয়েকটি লক্ষণ আছে যেগুলো দেখে আপনি সহজেই বুঝতে পারেন কিডনি ঠিকমতো কাজ করছে কি না। আসুন জেনে নেই কি সেই লক্ষণগুলো।

১. গোড়ালি ও পা ফোলাঃ 

কিডনি শরীর থেকে বর্জ্য ও অতিরিক্ত সোডিয়াম ফিল্টার করতে সাহায্য করে। যখন কিডনি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে অক্ষম হয়ে যায়, তখন শরীর সোডিয়াম ধরে রাখতে শুরু করে। আর এ কারণে শরীরের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে সে অংশগুলো ফুলতে থাকে। এক্ষেত্রে চোখ, মুখ, হাত, পা, গোড়ালি ও পায়ের পাতা ফুলে যেতে পারে। আর এই লক্ষণ দেখা দিলে বুঝে নিতে হবে হয়তো আপনার কিডনি ঠিকমত কাজ করছে না।

২. দুর্বলতা ও ক্লান্তিঃ

সারাক্ষণ ক্লান্ত বা দুর্বল বোধ করা সব ধরনের অসুখেরই প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়। কিডনির সমস্যা গুরুতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি দুর্বল ও ক্লান্ত বোধ করতে পারেন। এমনকি কিছু সাধারণ ঘরোয়া কাজ করা বা একটু হাঁটাও কিডনি রোগীর জন্য কষ্টকর হয়ে যেতে পারে। কিডনির অকার্যকারিতার কারণে রক্তে টক্সিন জমা হলে এমনটা ঘটে থাকে।

৩. ক্ষুধা কমে যাওয়াঃ

শরীরে বিষাক্ত পদার্থ ও বর্জ্য জমা হলে ক্ষুধা কমে যেতে পারে। এ কারণে ওজন কমতে শুরু করে। ক্ষুধা কম হওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে ভোরে বমি বমি ভাব ও বমি হওয়া। এই অপ্রীতিকর অনুভূতিগুলো আপনাকে খাবারের প্রতি আকাঙ্ক্ষা কমিয়ে দেয়। আর এটি কিডনির সমস্যার একটি লক্ষণও হতে পারে।

৪. প্রস্রাবের বেগে পরিবর্তনঃ

একজন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ দিনে ৬-১০ বার প্রস্রাব করে। এর চেয়ে বেশি বা কম প্রস্রাব কিডনির সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। কিডনির সমস্যার ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি হয় খুব কম অথবা ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ অনুভব করেন।
উভয় অবস্থা-ই কিডনির জন্য ক্ষতির কারণ। অনেকেই প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত দেখতে পান। এটি তখনই ঘটে যখন কিডনি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় রক্তের কোষগুলো প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যেতে শুরু করে।

৫. শুষ্ক ত্বক ও চুলকানিঃ

কিডনির সমস্যার আরও একটি অন্যতম লক্ষণ দেখা দেয় ত্বকে। এক্ষেত্রে ত্বক হয়ে পড়ে শুষ্ক। একই সঙ্গে চুলকানিও হতে পারে। এমনটি হওয়ার কারণ হলো শরীরের ক্ষতিকর টক্সিন বেরিয়ে যেতে পারে না। ফলে শরীরে রক্তে জমা হতে শুরু করে।
এ কারণে ত্বক হয়ে পড়ে বিবর্ণ ও শুষ্ক। ফলে ত্বকে চুলকানির সৃষ্টি হতে পারে। একই সাথে ঘামেও দুর্গন্ধ হয়। কিডনির সমস্যায় হাড়ের রোগ পর্যন্ত হতে পারে ।
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কিডনির রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে। যা শুধু সময়মতো উপসর্গ নির্ণয় করা গেলেই সম্ভব। যারা উচ্চ রক্তচাপ, সুগার ও অতিরিক্ত কোলেস্টেরলের মাত্রায় ভুগছেন তাদের কিডনি ব্যাধি হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।

এমন ব্যক্তিদের উচিত বছরে অন্তত একবার হলেও পুরো শরীরের চেকআপ করে নিশ্চিন্ত হয়ে নেওয়া । কিডনি রোগ ছাড়াও নিয়মিত মেডিকেল চেক-আপ প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন রোগ শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
**********************************************************************************

কিডনি রোগ নিয়ে কিছু ভুল ধারণাঃ

সন্দেহ নেই কিডনি শরীরের অন্যতম একটি অঙ্গ। কিডনি শরীরের অনেক কাজ করে। তবে মূল যে কাজগুলো করে তা হলো গোটা শরীরের পি-এইচ। অর্থাৎ অম্ল ও ক্ষারের মাত্রার একটা ভারসাম্য রক্ষা করে। ফলে শরীরের অন্যান্য অঙ্গগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে এবং শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য বের করে দেয়।
কিছু হরমোন যা হাড় বৃদ্ধি (ভিটামিন-ডি), মজ্জা থেকে রক্ত তৈরি (ইরাইথ্রোপয়েটিন), রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ (রেনিন) উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। কিডনি রোগ অনেক ধরনের হতে পারে। কিন্তু এই কিডনি রোগের চিকিৎসা নিয়ে অনেকেরই বেশ কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। সেগুলো নিয়েই আজকের বাকি আলোচনা।

০১.
ভুল ধারণা: কিডনি রোগ বংশগত।

সঠিক ধারণা: পলিসিসটিক কিডনি ডিজিজের মতো অল্প কিছু রোগ আছে যা বংশগত কারণে হয়ে থাকে বলে জানা যায়। অধিকাংশ কিডনি রোগই বংশগত নয়।

০২.
ভুল ধারণা: কিডনি বিকল মানে একটি বা দুটি কিডনি-ই বিকল।

সঠিক ধারণা: কিডনি রোগে একটি কিডনি আক্রান্ত হওযার ঘটনা খুবই কম বা বিরল। বিশেষ করে কিডনি বিকল বলতে দুটি কিডনি-ই বিকল বোঝায়। কারণ যখন একটি কিডনি বিকল হয় তখন শরীরের তেমন কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না। কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেও কোনো তারতম্য ধরা পড়ে না। শরীরে যখন কিডনি রোগের উপসর্গ ধরা পড়ে তখন দু’টি কিডনি-ই আক্রান্ত হয়েছে বলে বুঝতে হবে। বিশেষ করে কিডনি বিকলের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি সত্য।

০৩.
ভুল ধারণা: বেশি পানি খেলে কিডনি রোগী ভালো থাকে।

সঠিক ধারণা: কিডনির জন্য কখনই অতিরিক্ত পানি ভালো নয়। পর্যাপ্ত পানি গ্রহণই হচ্ছে সঠিক কাজ। শুধুমাত্র কিডনিতে খুবই ছোট কোন পাথর থাকলে তখন সেটিকে পানি প্রবাহের তোড়ে বের করে আনার জন্য একটু বাড়তি পানি পান করতে বলা হয়। কিন্তু কিডনি রোগ হলে পানি পানে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় এবং খুব পরিমিত পানি পান করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়। কিডনির রোগে আক্রান্ত হলে কিডনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শক্রমে সেই পরিমাণে পানি পান করাই শ্রেয়।

০৪.
ভুল ধারণা: কিডনি দান করা নিরাপদ নয়।

সঠিক ধারণা: ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত নয় এমন ব্যক্তি যদি শারীরিকভাবে সুস্থ থাকেন তাহলে তার জন্য কিডনি দান করা ঝুঁকির কোন বিষয় নয়।

০৫.
ভুল ধারণা: ডায়ালাইসিস একবার শুরু করলে তা স্থায়ীভাবে করতে হবে।

সঠিক ধারণা: ডায়ালাইসিস হচ্ছে রক্ত পরিশোধনের একটি আধুনিকতম প্রক্রিয়া। কিডনি অতিমাত্রায় বিকল হলে এটি করতে হয়। যখন ডায়ালাইসি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন রোগীর চিকিৎসার জন্য কিডনি সংস্থাপন বা প্রতিস্থাপন ছাড়া অন্য কোনো উপায় আর হাতে থাকে না। এ অবস্থায় রোগীকে বাঁচানোর জন্য ডায়ালাইসিস করা হয়। কাজেই ডায়ালাইসিস করা শুরু করলে পরবর্তীতে সেটি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আর তখন ডায়ালাইসিস না করা মানে অকালে মৃত্যুর প্রহর গোনা। কাজেই এখানে ডায়ালাইসিস শুরু করার মধ্যে কোনো ভুল নেই। তবে হঠাৎ কিডনি বিকল হলে তখন যদি কারো ডায়ালাইসিস লাগে সেটি সাময়িক সময়ের জন্য লাগবে। কিডনি সঠিকভাবে কাজ শুরু করার পর আর তা করার দরকার পড়ে না।

০৬.
ভুল ধারণা: বিয়ার খাওয়া কিডনির জন্য ভালো।

সঠিক ধারণা: বিয়ার খেলে প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়ে কিন্তু তাতে বিকল কিডনির কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনতে এই পদ্ধতি কোনো কাজে আসবে না। আর বিয়ার খেয়ে প্রস্রাব বাড়ানোর মাধ্যমে কিডনির কার্যকারিতাকে বাড়ানো সম্ভব নয়। বরং এটি কিডনির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

০৭.
ভুল ধারণা: কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট মানে কিডনি প্রতিস্থাপন।

সঠিক ধারণা: অনেকেরই ধরণা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট মানে আক্রান্ত বা নষ্ট কিডনিকে ফেলে দিয়ে সেখানে নতুন একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা। আসলে বিষয়টি তা নয়। কিডনি বিকল হওয়া রোগীকে কিডনি সংস্থাপনের সময় বিকল কিডনিকে আগের স্থানেই রেখে দেয়া হয়। বিকল কিডনি দুটির সঙ্গে নতুন সুস্থ একটি কিডনিকে জুড়ে দেয়ার বিষয়টিই হচ্ছে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট বা কিডনি সংস্থাপন বা সংযোজন। বিকল কিডনিকে ফেলে দেয়ার ঘটনা খুবই বিরল।

০৮.
ভুল ধারণা: কিডনি পাথরের সঙ্গে কিছু খাবারের সম্পর্ক রয়েছে।

সঠিক ধারণা: এটি কিছুটা সত্য তবে সব সময়ে এই কথা সত্য নয়। যাদের কিডনিতে পাথর হওযার প্রবণতা রয়েছে তাদের বেলায় এটি কিছুটা প্রযোজ্য। তবে সুস্থ স্বাভাবিক লোকের বেলায় নয়। এ বিষয় একজন কিডনি বিশেষজ্ঞের অভিমত হলো, যারা অতিরিক্ত আমিষ গ্রহণ করেন তাদের কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা বেশি। কারণ বাড়তি আমিষের কারণে শরীর থেকে বাড়তি ক্যালসিয়াম বেরিয়ে যায়। ফলে প্রস্রাবে অতিরিক্ত ক্যালসিয়ামের উপস্থিতি ঘটে। যা কিডনিতে পাথর তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। আবার অনেকের ধারণা যেহেতু বেশিরভাগ কিডনি পাথরই ক্যালসিয়ামের তৈরি। তাই ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার কম খেলে কিনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনাও কম হবে। সাম্প্রতিক গবেষণায় এই ধারণাটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কম ক্যালসিয়াম শরীরে অন্যান্য বিপর্যয় ডেকে আনে। তাই স্বাভাবিক মাত্রার ক্যালসিয়াম খেতে হবে। কম ক্যালসিয়াম খাওয়ার চেয়ে স্বাভাবিক মাত্রার ক্যালসিয়াম গ্রহণই ভালো। তবে যাদের ইতিমধ্যে কিডনিতে পাথর হয়েছে বা আছে, তারা কম ক্যালসিয়াম গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু সুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে কম ক্যালসিয়াম গ্রহণ কখনোই কিডনির পাথর হওয়ার প্রবণতা কমায় না।

০৯.
ভুল ধারণা: কিডনিতে পাথর হওয়ার বিষয়টি বিরল ঘটনা।

সঠিক ধারণা: কিডনিতে পাথর কোন বিরল ঘটনা নয়। এটি কিডনির ক্ষেত্রে বা রোগীরজন্য সবচেয়ে সচরাচর ঘটনা। আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ডায়াবেটিস অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ এন্ড কিডনি ডিজিজেসের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, প্রায় ১০ ভাগ আমেরিকান তাদের জীবনের কোন না কোন সময়ে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যাদের বয়স ২০-৪০ বছরের মধ্যে।

১০.
ভুল ধারণা: কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করলেই কিডনি নিয়ে আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই।

সঠিক ধারণা: অনেকেরই ধারণা কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার পর রোগীর সুস্থ জীবন যাপনে আর কোনো বাঁধা নেই। এ ধারণা একদম ঠিক নয়। বরং রোগীর জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। কারণ কিডনি সংস্থাপনের পর কিডনিটি যেন শরীরের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে অর্থাৎ কিডনিটি যেন শরীর থেকে বিয়োজিত হয়ে না যায় সেজন্য রোগীকে সারাজীবন বিশেষ কিছু ঔষুধ গ্রহণ করতেই হবে। এই ঔষুধ ক্রয় বা গ্রহণ করা অনেকেরই সামর্থ্যের বাইরে থাকে। এছাড়া রোগীর যেন সহসা কোন ইনফেকশন না হয় সেজন্য রোগ জীবাণু থেকে দূরে থাকতে হবে। এগুলো না বুঝলে সংযোজিত কিডনি শরীরের কোন উপকারই করতে পারবে না।

আরও পড়ুনঃ কিডনির সমস্যা থেকে হতে পারে মানসিক রোগ। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *