হিট স্ট্রোক কি? লক্ষণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় কি ?

হিট স্ট্রোকঃ


আগমন হয়েছে গ্রীষ্মের। প্রচন্ড গরমে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা চলছে বিবিন্ন জেলায়। গরমের সময় আমরা প্রায়ই শুনতে বা দেখতে পাই, চলতি পথে একজন মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে বা চোখ মুখ উল্টে মারা গেছে। এই ব্যক্তিরা মূলত অসুস্থ বা মারা যায় হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে। আজকের পোস্টে আপনাদের জানাবো হিট স্ট্রোক কি, কিভাবে বাঁচবেন হিট স্ট্রোক থেকে, এর লক্ষণ, চিকিৎসা ও করণীয় সম্পর্কে।

হিট স্ট্রোক (Heat stroke) বা সান স্ট্রোক (sun stroke) এক ধরনের অসুস্থতা, যা অত্যধিক গরমের কারণে হয়ে থাকে। এই অসুখে শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ᱸ ফারেনহাইটের বেশি এবং সেইভসাথে শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছরে ৬০০ জনেরও বেশি মানুষ হিট স্ট্রোকে মারা যায়। অনেক সময় রোগী ধীরে ধীরে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে হঠাৎ করে হিট স্ট্রোক করার সম্ভাবনাই বেশি। আমাদের দেশেও এই রোগ এখন প্রায়ই দেখা দেয় এবং হিট স্ট্রোকে মারা যাওয়ার খবরও পাওয়া যায়। প্রতিনিয়তই পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে চলা এবং হিট স্ট্রোক হলে করণীয় কি সেই সম্পর্কে ধারণা না থাকাটাই মৃত্যুর প্রধান কারণ।

হিট স্ট্রোক কেন হয়, করণীয় কি, প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় নিয়েই আজ আলোচনা করবো।

হিট স্ট্রোকের কারণঃ

হিট স্ট্রোক কয়েকটি কারণে হতে পারে।

– পারিপার্শ্বিক উচ্চ তাপমাত্রা,

– শরীরে পানিশূন্যতা বা মিনারেলসের (minerals) অভাব,

– কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়, যেমন- ডাই-ইউরেটিক্স (diuretics), বিটা ব্লকারস (beta blockers), অ্যালকোহল (alcohol), হার্ট বা স্কিনের অসুখের কারণে ।

লক্ষণ বা উপসর্গঃ

হিট স্ট্রোকে প্রাথমিক কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেয়। হিট স্ট্রোক করার দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি ধরতে পারলে বা বুঝতে পারলে অনেক জটিল অবস্থা থেকেও রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। সাধারনত নিচের লক্ষণগুলো হিট স্ট্রোকে দেখা যায়-

– শরীরের অত্যধিক তাপমাত্রা,

-বমি বমি ভাব

– দুর্বলতা

– ঝিমুনি

– মাথা ব্যথা। 

রোগীর অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে গেলে আরও কিছু উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে। যেমন-

– চামড়ার রং লালচে হয়ে যাওয়া,

– মানসিক ভারসাম্যহীনতা,

– হাঁটতে অসুবিধা দেখা দেয়া,

– চোখের মণি বড় হওয়া,

– অসংলগ্ন কথাবার্তা বা আচরণ

– ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া,

– হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যাওয়া,

– খিঁচুনি

– বমি

– অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।

প্রাথমিক চিকিৎসাঃ

যেহেতু হিট স্ট্রোক মৃত্যু ঘটাতে পারে তাই এটি গুরুতর একটি রোগ। এর চিকিৎসাও দ্রুত হওয়া প্রয়োজন।

জরুরী পরিস্থিতে চিকিৎসকগণ দ্রুতই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এই রকম পরিস্থিতিতে প্রথমেই যেটা করতে হবে তা হলো রোগীর শরীর ঠাণ্ডা করা এবং খোলা বা ফাঁকা স্থানে নিয়ে যাওয়া। স্ট্রোকের তীব্রতা বা ধরনের উপর নির্ভর করে রোগীর সুস্থ হতে কয়েকদিন পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। যদি সঠিক চিকিৎসা করা না হয় তাহলে হিট স্ট্রোক রোগীর মস্তিষ্ক (brain), পেশী (muscles), কিডনী (kidney) এবং অন্যান্য অঙ্গগুলোকে দীর্ঘমেয়াদী মারাত্মক ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে এই স্ট্রোকটি। বিশেষজ্ঞগণ শুধুমাত্র শরীরের তাপমাত্রা কমানোর জন্য কিছু না করে পাশাপাশি পানি বা লিকুইড (liquid) জাতীয় খাবার গ্রহনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

প্রতিকারঃ

১) লিকুইড খাবার-

যারা রোদে কাজ করে বা এক ঘন্টার বেশি ব্যায়াম (exercise) করেন তাদের হিট স্ট্রোক এড়ানোর জন্য প্রচুর পরিমানে লিকুইড জাতীয় খাবার গ্রহন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পানি সবচেয়ে ভাল পথ্য। এর সাথে কম মিষ্টি জাতীয় স্পোর্টস ড্রিঙ্কস (sports drinks) অত্যন্ত উপকারী।

২) ব্যায়াম ভোরবেলায়-

তাপদাহ বিদ্যমান থাকলে ব্যায়াম বা এক্সারসাইজ অবশ্যই সূর্যোদয়ের আগে বা খুব ভোরে করতে হবে। অনেকেই রোদ উঠে গেলে বা বিকেলে ব্যায়াম করে থাকে। এটি শরীরে পানিশূন্যতা তৈরীর অনেক বড় একটি কারণ।

৩) অ্যালকোহল পরিত্যাগ করুন-

গরমের দিনগুলোতে অ্যালকোহল গ্রহন করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। কারণ, অ্যালকোহল বা সুগার ড্রিঙ্কসগুলো শরীরে ডিহাইড্রেশন (dehydration) বা পানিশূন্যতার সৃষ্টি করে।

অনেক সময় শরীরে লবণ বা মিনারেলসের ঘাটতি দেখা যায়। এই সময়ের জন্য সবচেয়ে উপকারী পদার্থ হলো ওরস্যালাইন (orsaline) এবং গ্লুকোজ। রোগীর মুখে খাওয়া সম্ভব না হলে শিরার মাধ্যমে স্যালাইন বা গ্লুকোজ দেওয়া হয়। কিন্তু হাইপারটেনশন (hypertension) বা উচ্চ রক্তচাপ (high blood pressure) রোগীদের ক্ষেত্রে সবসময় এটা নিরাপদ না ও হতে পারে। কারণ, স্যালাইনের সোডিয়াম রক্তচাপ বাড়াতে সাহায্য করে। এসকল রোগীর ক্ষেত্রে গ্লুকোজ, ডাবের পানি, ফলের রস ইত্যাদি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

শিশু ও বয়স্কদের জন্য পরামর্শঃ

সব বয়সী মানুষের ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোক এক রকম হলেও, বয়স্ক ও শিশুদের প্রতি আলাদা নজর রাখা জরুরী। খেয়াল রাখতে হবে যেন তাদের শরীরে কোনভাবেই পানিশূন্যতা দেখা না দেয়। যেহেতু ১-২ বছর বয়সী শিশুরা নিজেদের শারীরিক অসুবিধাগুলোর কথা বলতে পারে না। তাই গরমের দিনে তাদের বারবার পানি বা শরবত পান করাতে হবে। শরীরের তাপমাত্রা খুব বেশি বাড়তে দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে তাদের গোসল বা দিনে কয়েকবার ভিজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। খোলামেলা জায়গায় বা প্রচুর বাতাস আছে এমন জায়গায় বাচ্চাদের রাখতে হবে।

শিশুদের মতো বয়স্কদের জন্যও খোলামেলা স্থান বাছাই করা জরুরী। যাদের ডায়াবেটিস (diabetes)– এর সমস্যা রয়েছে তাদের শরবত বা মিষ্টি জুস না দিয়ে পানি, ডাবের পানি এগুলো দিতে হবে।

হিট স্ট্রোকের শিকার এই গরমে আমি বা আপনি যে কোন সময়েই হতে পারি। তৎক্ষণাৎ প্রতিরোধের বা মোকাবেলার উপায়গুলো জানা থাকলে আমরা খুব সহজেই এই পরিস্থিতি থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি এবং আমাদের সামনে কেউ আক্রান্ত হলে তার জীবন বাঁচাতেও ভূমিকা রাখতে পারি।
তাই আসুন হিট স্ট্রোক সম্পর্কে জানি এবং অন্যকে জানতে সহায়তা করি।

আরও পড়ুনঃ হিট স্ট্রোক আটকাতে পারে যে খাবারগুলো। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *