আমাদের রক্তে সুগার বা শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়াকে বলা হয় হাইপারগ্লাইসেমিয়া। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে সুগার বেড়ে যাওয়াটা পরিচিত একটি সমস্যা। টাইপ-১, টাইপ-২ বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস যে কোনো ক্ষেত্রেই হাইপারগ্লাইসেমিয়া দেখা দিতে পারে। হাইপারগ্লাইসেমিয়া এবং হাইপোগ্লাইসেমিয়া শব্দ দুইটি একই রকম মনে হলেও রোগীর জন্য এই দুইটি ক্ষেত্র একদম বিপরীত অর্থ বা সমস্যা বহন করে। রক্তে সুগার বা শর্করা বেড়ে গেলে তাকে যেমন হাইপারগ্লাইসেমিয়া বলা হয়। তার বিপরিতে রক্তে স্বাভাবিকের তুলনায় সুগার বা শর্করার মাত্রা কমে গেলে তাকে বলা হয় হাইপো-গ্লাইসেমিয়া।
ডায়াবেটিস নেই এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও বিশেষ অসুস্থতার ইতিহাস থাকলে যে কোনো সময় তার শরীরে হাইপারগ্লাইসেমিয়া দেখা দিতে পারে। এমন কিছু বিশেষ রোগের মধ্যে রয়েছে– হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক আর গুরুত্বর কোনো সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়া।
রক্তে সুগার বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ সমূহঃ
ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে হাইপারগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণগুলো সাধারণত কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরব ধীরে ধীরে দেখা দিতে পারে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় সুগারের পরিমাণ অতি উচ্চমাত্রায় পৌঁছানোর আগে কোনো লক্ষণই তাদের মাঝে দেখা দেয় না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাইপারগ্লাইসেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে কিছু লক্ষণ দেয়। আর সেগুলো হলো-
★ ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া,
★ অতিরিক্ত তৃষ্ণা পাওয়া,
★ কিছুক্ষণ পরপর মুখ শুকিয়া আসা,
★ শরীর শুকিয়ে যাওয়া,
★ ওজন কমে যাওয়া,
★ দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া,
★ শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি
★ পেট ব্যথা ও পেট মোচড় দেওয়া,
★ নিশ্বাসে মিষ্টি ফলের ন্যায় গন্ধ হওয়া,
★ বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া,
★ বুকে চাপ লাগা ও বুক ধড়ফড় করা,
★ অস্থিরতা অনুভব করা,
★ কাটা স্থান দ্রুত না শুকানো,
★ ঘা বা ইনফেকশন হলে সহজে ভালো না হওয়া,
★ মাঝেমাঝে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া,
★ বারবার ইনফেকশন হওয়া। যেমন- ছত্রাকের সংক্রমণ (Thrush), ত্বকের ইনফেকশন অথবা মূত্রথলির সংক্রমণ (Cystitis)।
★ প্রস্রাবে দুর্গন্ধ হওয়া। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শর্করার মাত্রা কমে গিয়ে সমস্যা বেড়ে যায়। যাকে বলা হয় Low Blood Suger বা Hypoglycemia.
হাইপারগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণগুলো যেহেতু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া নির্দেশ করতে পারে, সে জন্য ডায়াবেটিস নেই জানা থাকলেও এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে বা কোনো একটি লক্ষণ ১ সপ্তাহের বেশি টানা দেখা দিলে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে কি কারণে এই সমস্যাগুলো দেখা দিচ্ছে।
রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণসমূহঃ
নানা কারণে ডায়াবেটিস রোগীদের ব্লাড সুগারের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এসব কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
★ মানসিক চাপ,
★ রক্তে সুগারের পরিমাণ অতিরিক্ত কমে হাইপো-গ্লাইসোমিয়া হলে অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়া বা প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত চিকিৎসা নিলে,
★ নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ সেবন করলে ( যেমন: স্টেরয়েড),
★ যেকোনো অসুস্থতা (যেমন: ঠান্ডার সমস্যা),
★ ব্যায়াম না করলে,
★ অলস জীবন যাপন করলে,
★ অতিরিক্ত খাবার খাওয়া ( যেমন: ৩ বেলা খাবারের পাশাপাশি বিভিন্ন স্ন্যাকস খাওয়া),
★ প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত মিষ্টি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার খেলে,
★ ভুল ডোজে ডায়াবেটিসের ঔষধ সেবন করলে, বা ডায়াবেটিস ঔষধের কোনো ডোজ বাদ পড়লে।
উল্লেখ্য, বাড়ন্ত শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠার সময় কখনো কখনো হাইপারগ্লাইসেমিয়া দেখা দিতে পারে। তবে এটি সাময়িক সময়ের সময়ের জন্য হয়ে থাকে।
রক্তে সুগারের স্বাভাবিক লেভেলঃ
প্রথমবার কোনো ব্যক্তির ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পরে ডাক্তারের কাছ থেকে দুইটি বিষয় জেনে নেওয়াটা খুবই জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হচ্ছে–
১. রক্তে সুগারের মাত্রা কেমন
২. সুগার কোন মাত্রায় নামিয়ে আনতে হবে।
বর্তমান সময়ে ঘরে বসেই রক্তে সুগারের মাত্রা কত না মেশিনের বা গ্লুকোমিটারের সাহায্যে নিয়মিত পরীক্ষা করে জেনে নেওয়া যায়। আবার ডায়াবেটিস আছে বা ধরা পড়েছে এমন ব্যক্তি প্রতি ২-৩ মাস পরপর হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে এইচবিএওয়ানসি (HbA1c) পরীক্ষা করিয়ে মাত্রা নির্ণয় করে নিতে পারেন। HbA1c টেস্টের মাধ্যমে রক্তে সুগাড়ের গড় মাত্রা এবং সুগার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে কি না, তা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মূলত HbA1c এর মান ৬.৫% এর নিচে থাকলে রোগীর সুগার তথা ডায়াবেটিস স্বাবাবিক বা ভালো পর্যায়ে আছে এমনটা বিবেচনা করা হয়।
সবার ক্ষেত্রে রক্তে সুগারের লক্ষ্যমাত্রা এক থাকে না। তবে সাধারণত কিছু লক্ষ্যমাত্রাকে ব্লাড সুগারের স্বাভাবিক মাত্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আরও পড়ুনঃ রক্তে সুগার বেড়ে গেলে করণীয় কি?
গ্লুকোমিটারঃ
খালিপেটে ৪ থেকে ৭ মিলিমোল/লিটার এবং খাওয়ার ২ ঘন্টা পরে ৮.৫ থেকে ৯ মিলিমোল/লিটারকে স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এইচবিএওয়ানসি (HbA1c) টেস্টঃ
৬.৫% বা ৪৮ মিলিমোল/মোলের নিচে থাকলে স্বাভাবিক সুগার হিসেবে বিবেচিত হবে।
রক্তে সুগার বেড়ে গেলে কী হয়ঃ
ডায়াবেটিস চিকিৎসার প্রধান লক্ষ্যই হচ্চে ব্লাড সুগারের মাত্রা যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক মাত্রায় বা তার কাছাকাছি রাখা। তবে সঠিক চিকিৎসা ও সাবধানতা অবলম্বন করার পরেও ডায়াবেটিস রোগীদের কোনো না কোনো সময়ে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। সুগার বেড়ে গেলে বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া দেখা দিলে তা নির্ণয় করে চিকিৎসা নেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসা না করালে হাইপারগ্লাইসেমিয়া থেকে বিভিন্ন জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরী হতে পারে। এমনকি শরীরে ইনফেকশন হয়ে অঙ্গহানি এমনকি প্রাণনাশের মত ঘটনা ঘটতে পারে।
হঠাৎ হঠাৎ ডায়াবেটিস রোগীর সুগারের লেভেল কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। মাঝে মাঝে সামান্য সুগার বেড়ে গেলে এটি তেমন উদ্বেগের বিষয় নয়। কারণ মৃদু হাইপারগ্লাইসেমিয়া সহজ চিকিৎসা ও কিছু নিয়ম মানলে সেরে যায় বা ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে চলে আসে। এমনকি কখনো কখনো বিশেষ চেষ্টা ছাড়াই সুগারের লেভেল স্বাভাবিকে নেমে আসে। তবে রক্তে সুগারের মাত্রা যদি অতিরিক্ত বেড়ে যায় অথবা দীর্ঘ সময় ধরব উচ্চমাত্রায় থাকে, তাহলে এর পরিনতি মারাত্মক হতে পারে। রক্তে সুগারের মাত্রা অতি উচ্চমাত্রায় পৌঁছে গেলে প্রাণঘাতী কিছু জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এসবের মধ্যে রয়েছে-
ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিসঃ
ফ্যাট বা চর্বি ভেঙে শরীরে শক্তি উৎপাদনের প্রয়োজন হলে ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস হয়ে থাকে। চর্বি ভাঙনের ফলে দেহে কিটোন বডি নামক এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ তৈরি হয়। অতিরিক্ত কিটোন বডি শরীরে জমে গেলে ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস দেখা দিতে পারে। যা থেকে ডায়াবেটিক থেকে কোমায় চলে যেতে পারে। সাধারণত টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা হতে পারে।
হাইপারঅসমোলার হাইপারগ্লাইসেমিক স্টেটঃ
রক্তে সুগার অতি উচ্চমাত্রায় পৌঁছে গেলে শরীর অতিরিক্ত সুগার বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়া শুরু হলে দেহে মারাত্মক পানিশূন্যতা দেখা দেয়। আর এক্ষেত্রে পানিশূন্যতা পূরণ করা না হলে ডিহাইড্রেশনের আক্রান্ত হয়ে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এই হাইপারঅসমোলার হাইপারগ্লাইসেমিক স্টেট সৃষ্টি হতে দেখা যায়।
যদি মাসের পর মাস ব্লাড সুগার লেভেল সবসময়ই বেশি থাকে, তাহলে শরীরের বিভিন্ন অংশের চিরস্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। যেমন: চোখ, নার্ভ বা স্নায়ু, কিডনি, রক্তনালীসমূহ ইত্যাদি। এমনকি সারা জীবনের জন্য অঙ্গগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
তাই নিজের বা পরিবারের কারো যদি নিয়মিত হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা সুগার লেভেল বেশি থাকে, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য চিকিৎসা ও জীবনধারায় কিছু পরিবর্তন আনতে হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ ইন্সুলিন রেসিস্ট্যান্স কি?