হাইড্রোসেফালাস বা মাথা বড় হয়ে যাওয়া

হাইড্রোসেফালাস কিঃ

একটি স্নায়বিক ব্যাধির নাম হাইড্রোসেফালাস। মস্তিষ্কের গভীরে থাকা ভেন্ট্রিকলে (গহ্বরে) অস্বাভাবিক সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (CSF) জমা হওয়ার কারণে হাইড্রোসেফালাস হয়ে থাকে।
CSF এক ধরণের স্বচ্ছ, বর্ণহীন তরল, কুশন যা আমাদের মস্তিষ্ক এবং মেরুদন্ড রক্ষা করে থাকে। অতিরিক্ত CSF তৈরির ফলে মস্তিষ্কের অনুপযুক্ত কার্যকারিতা, মস্তিষ্কের ক্ষতি এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। অতিরিক্ত তরল মস্তিষ্কের ভেন্ট্রিকলকে প্রশস্ত করে এবং মস্তিষ্কের টিস্যুতে ক্ষতিকর চাপ সৃষ্টি করে। হাইড্রোসেফালাস শিশুর জন্মের সময়ে বা জন্মের পরপরই হতে পারে। আবার কোনো আঘাত বা ক্ষতির (স্ট্রক ইত্যাদি) ফলেও রোগটিতে যে কোনো মানুষ আক্রান্ত হতে পারে।

প্রতি ১ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ১১ জন হাইড্রোসেফালাসে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। তবে শিশুদের মধ্যে প্রতি লাখে ৮৮ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়।

হাইড্রোসেফালাসের লক্ষণ কী কীঃ

ব্যক্তিভেদে হাইড্রোসেফালাসের লক্ষণগুলো পরিবর্তিত হতে পারে। তবে বয়সের উপর উপর নির্ভর করে প্রতিটি রোগীর মাঝে লক্ষণগুলো আলাদা আলাদা হয়ে থাকে।
শিশুদের মাঝে যে সকল লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দেয়-
১. মাথার আকার দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া,
২. বিশাল বা অনেক বড় মাথা,
৩. হৃদরোগে আক্রান্ত,
৪. বমি হওয়া,
০৫. চোখ বাহিরের দিকে না তাকিয়ে ধারাবাহিকভাবে নিচের দিকে তাকানো,
০৬. চোখ ট্যারা হওয়া,
০৭. চোষা বা খাওয়ানোয় সমস্যা,
০৮. নিদ্রালুতা,
০৯. খিটখিটে ভাব।

বয়স্ক শিশু বা প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে যে লক্ষণগুলো দেখা যায়ঃ
১. বমি বমি ভাব,
২. মাথা ব্যথা,
৩. অস্পষ্ট বা দ্বিগুন দৃষ্টি,
৪. দৃষ্টি সমস্যা,
৫. নিদ্রালুতা,
৬. ভারসাম্যের সমস্যা,
৭. খিটখিটে ভাব,
৭. হাঁটা বা কথা বলায় জড়তা বা ধীরগতি।
৮. দ্রুত কথা বুঝতে না পারা,
৯. পড়ালেখা বা চাকরির কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়া,
১০. দরিদ্র সমন্বয়,
১১. আচরণ, চিন্তা প্রক্রিয়া বা স্মৃতিতে নেতিবাচক পরিবর্তন,
১২. মূত্রাশয়ের নিয়ন্ত্রণ হারানো এবং ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া,
১৩. জেগে থাকায় অসুবিধা হওয়া।

বয়স্কদের মধ্যে যে লক্ষণগুলো দেখা যায়ঃ

১. হাঁটার সমস্যা,
২. প্রগতিশীল মানসিক বৈকল্য এবং ডিমেনশিয়া,
৩. নড়াচড়ায় ধীরগতি দেখা দেওয়া
৪. দুর্বল সমন্বয় এবং ভারসাম্য হারানো,
৫. মূত্রাশয়ের নিয়ন্ত্রণ।হারানো এবং ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া,
হাইড্রোসেফালাস কত প্রকারঃ
জন্মগত বা উচ্চ পর্যায়ের হাইড্রোসেফালাস সাধারণত শিশুকে জন্মের সময় আক্রান্ত করে থাকে। এই পর্যায়ের হাইড্রোসেফালাস এক ধরণের জেনেটিক সিন্ড্রোম বা মেরুদন্ডের ডিসরাফিজমের একটি অংশ।
প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে ৪ ধরণের হাইড্রোসেফালাস দেখা দেয়। এগুলো হচ্ছে-
১. হাইপারসেক্রেটরি হাইড্রোসেফালাসঃ
হাইপারসেক্রেটরি হাইড্রোসেফালাস CSF এর অতিরিক্ত উপাদানের করণে হয়ে থাকে। এসব উপাদানের মধ্যে প্লেক্সাস প্যাপিলোমা থাকলে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে ব্রেইন টিউমার বা একটি কার্সিনোমার কারণেও এই ধরনের হাইড্রোসেফালাস হতে পারে। এই কার্সিনোমা বা টিউমার শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
২. সাধারণ চাপ হাইড্রোসেফালাসঃ
নরমাল প্রেসার হাইড্রোসেফালাস বা (NPH) মস্তিষ্কে রক্তপাত বা অস্ত্রপাচারের জটিলতার কারণে হতে পারে। এসময় CSF এর উত্থান ধীরে ধীরে ঘটতে থাকে, যা ভেন্ট্রিকলের চারপাশের টিস্যুগুলোকে সামঞ্জস্য করতে এবং মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে বেড়ে যাওয়া তরলের চাপ প্রতিরোধ করার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়। নরমাল প্রেসার হাইড্রোসেফালাস হাঁটা, মূত্রাশয় নিয়ন্ত্রণ এবং চিন্তাভাবনা ও যুক্তিতে সমস্যা সৃষ্টি করে। চিকিৎসা করানো না হলে সময়ের সাথে সাথে NPH এর লক্ষণগুলো আরও খারাপ হতে পারে। তবে কিছু ব্যক্তি চিকিৎসা ছাড়া সাময়িক কিছু সময়ের জন্য সুস্থ বা ভালো অনুভব করতে পারে।
৩. অবস্ট্রাকটিভ হাইড্রোসেফালাসঃ
যখন ভেন্ট্রিকেলগুলো অবরুদ্ধ হয়ে যায়, তখন এগুলোকে অ-যোগাযোগকারী (অবস্ট্রাকটিভ) হাইড্রোসেফালাস বলা হয়। কারণ এই সময় CSF এর প্রবাহ অবরুদ্ধ হয়ে থাকে।
৪. কানেক্টেড হাইড্রোসেফালাসঃ
হাইড্রোসেফালাস যোগাযোগ বা কানেক্টেড ভেন্ট্রিকল থেকে বের হয়ে আসার পরে যখন CSF প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় তখন তৈরি হয়ে থাকে। কানেক্টেড বা ‘যোগাযোগ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় কারণ, CSF এই সময়েও ভেন্ট্রিকলের মাধ্যমে সঞ্চালন করতে পারে এবং প্যাসেজগুলো বাধাহীন থাকে। ফলে বিশেষায়িত রক্তনালীতে প্রবাহ এবং CSF শোষণ হ্রাসের ফলেও ভেন্ট্রিকলগুলোতে CSF তৈরি হতে পারে।

হাইড্রোসেফালাস নির্ণয় পদ্ধতিঃ

হআইড্রোসেফালাস নির্ণয়ের জন্য স্নায়বিক কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ব্রেইনের কম্পিউটার টমোগ্রাফি (সিটিস্ক্যান), আল্ট্রাসাউন্ড এবং প্রয়োজনে MRI এর মত ইমেজিং টেস্ট করাতে পারেন।
হাইড্রোসেফালাসের অবস্থা নির্ণয়ের জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ডাক্তার আরও কিছু পরীক্ষা করাতে পারেন। পরীক্ষাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
★ স্পাইনাল ট্যাপ
★ ইন্ট্রাক্রানিয়াল প্রেসার মনিটরিং (ICP)
★ ফান্ডোস্কোপিক টেস্ট।

হাইড্রোসেফালাস কি নিজে থেকে ভালো হতে পারে:

যদি চিকিৎসা না করা হয় তবে এই রোগটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে সক্ষম হাইড্রোসেফালাস। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগটি ধরা গেলে এবং সঠিক চিকিৎসা নিলে এই রোগটি থেকে শিশু ও বয়স্কদের সুস্থ করে তোলার সম্ভাবনা থাকে।

হাইড্রোসেফালাসের চিকিৎসাঃ

হাইড্রোসেফালাস প্রতিরোধ বা নিরাময়ের কোনো উপায় না থাকলেও অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যেতে পারে।
অন্তর্নিহিত ইটিওলজির উপর ভিত্তি করে এই রোগের দুইটি পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা যেতে পারে। চিকিৎসা সমূহ হতে পারে-
★ অতিরিক্ত তরল সরাসরি ডাইভার্টিং করা,
★ পরোক্ষভাবে CSF বাধার কারণ নির্ণয় করে তা অপসারণ করা।
১. শান্ট ডিভাইসঃ
হাইড্রোসেফালাসের চিকিৎসার সবচেয়ে সাধারণ উপায় হল শান্ট ডিভাইস ব্যবহার করা। এই ডিভাইস মস্তিষ্ক থেকে অতিরিক্ত CSF দূরে সরিয়ে দেয়। শান্ট ডিভাইসটি একটি ক্যাথেটার এবং একটি ভালভ দিয়ে ত্বকের নিচে স্থাপন করা হয়। এটি মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে একটি ভেন্ট্রিকল থেকে শরীরের অন্য গহ্বরে অতিরিক্ত CSF নিষ্কাশন করে। শান্ট সিস্টেম ক্রমাগত CSF কে মস্তিষ্ক থেকে সরাতে থাকে, ইন্ট্রাক্রানিয়াল চাপকে স্বাভাবিক সীমার মধ্যে রাখতে সাহায্য করে।
কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ২টি পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়ে থাকে।
প্রথম পদ্ধতিটি হচ্ছে, CSF কে ডাইভার্ট করা। আর দ্বিতীয়টি হলো ব্রেন টিউমারের মত বাধার কারণ দূর করা।
শান্ট সিস্টেমটি সাধারণত রোগীর শরীরে সারা জীবনের জন্য রেখে দিতে হয়৷ কখনও কখনও জটিলতা বা সিস্টেম কাজ না করায় বা পাইপে জ্যাম বেঁধে যাওয়ার কারণে পুনরায় অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে।
২. এন্ডস্কোপিক থার্ড ভেন্ট্রিকুলোস্টমি (ইটিভি)
এই অপারেশনটি বিকল্প এক ধরনের অপারেশন যা শুধুমাত্র সীমিত রোগীর জন্য করা হয়ে থাকে। ETV মস্তিষ্ক থেকে CSF এর বহিঃপ্রবাহ বাড়িয়ে দেয়। এই পদ্ধতিটি তৃতীয় ভেন্ট্রিকলের নিচে ছোট একটি গর্ত তৈরী করে চাপ উপশম করতে CSF কে সরিয়ে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির অপারেশনের মাধ্যমে CSFএর উৎপাদনকে কমাতে কোরয়েড প্লেক্সাস ক্যাটারাইজেশনের প্রয়োজন হয়।

৩. কোরয়েড প্লেক্সাস ক্যাটেরাইজেশন:
কোরয়েড প্লেক্সাস ক্যাটেরাইজেশন এমন একটি পদ্ধতি যা মস্তিষ্কের পার্শ্বীয় ভেন্ট্রিকেলে থাকা CSF উৎপাদনকারী টিস্যু অর্থাৎ কোরয়েড প্লেক্সাস পোড়াতে বৈদ্যুতিক প্রবাহ ব্যবহার করে। এর পদ্ধতি CSF এর উৎপাদন কমাতে সহায়তা করে।
হাইড্রোসেফালাস ধরা পড়লে এটি রোগী ও পরিবারের ভীতিকর এক অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করতে পারে। তবে ডাক্তার রোগীর অবস্থা বুঝে প্রয়োজনীয় অপারেশনের মাধ্যমে মস্তিষ্কে সরঞ্জাম এবং সংস্থান সরবরাহ করতে পারেন। শিশুদের ক্ষেত্রে শিশু বিশেষজ্ঞ এবং প্রাপ্ত বয়স্করের ক্ষেত্রে নিউরোসার্জন, চক্ষু বিশেষজ্ঞ বা পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। আবার রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী এবং ভালো ও সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য শিশু বা প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই সকল ডাক্তারের সম্মিলিত চিকিৎসা দেওয়া লাগতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *