সায়াটিকা: এক যন্ত্রণাদায়ক রোগ

সায়াটিকা নার্ভে কোনো আঘাতের কারণে সৃষ্টি হওয়া বেদনাদায়ক এক রোগ হচ্ছে সায়াটিকা। এই রোগের উপসর্গের মধ্যে সবচেয়ে বড় লক্ষণটি হচ্ছে এক ধরণের অসাড় অবস্থা অনুষঙ্গী হয়ে পিঠের নিচের অংশে ব্যথা অনুভূত হওয়া। এবং ব্যথা পা বেয়ে নিচের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ব্যথা মূলত দুই ধরনের। একটি হচ্ছে স্নায়ুতান্ত্রিক ব্যথা যা নিউরোজেনিক পেইন হিসেবে বিবেচিত। এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রতিফলিত ব্যথা, যা রেফার্ড পেইন বলে বিবেচিত।

সায়াটিকার উপসর্গগুলো আচমকাই শরীরে প্রকাশ পায়। এবং এর প্রভাব অত্যন্ত কষ্টদায়ক হতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পিঠে প্রাপ্ত কোনো আঘাত অথবা দীর্ঘকাল নিষ্ক্রিয় থাকলে সায়েটিকায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। এছাড়াও আরো বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন: ভুল দেহভঙ্গী, মোটা বা স্থুলতা, স্নায়ুতাত্ত্বিক ব্যাধি, পেশীর খিচুনি, স্পন্ডিলাইটিস এবং স্লিপড ডিস্ক। এছাড়াও প্যান্টের পিছনের এক পকেটে মোটা মানিব্যাগ রেখে বসে থাকা বা জার্নির কারণেও মানুষ সায়াটিকায় আক্রান্ত হতে পারে বলে গবেষণায় জানা যায়। সায়াটিকা ৪ থেকে ৭ দিনের মধ্যে একা একাই ভালো হয়ে যায়। তবে, যদি উপসর্গগুলো অবিরত লেগে থাকে, তখন ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হওয়া জরুরী হয়ে যায়।

সায়াটিকার চিকিৎসা মূলত ব্যথানাশক ঔষধ, ম্যাসাজ এবং ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে করা হয়। গুরুত্বর পর্যায়ে অপারেশনের মাধ্যমে রোগ নিরাময় করতে হতে পারে। জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে এই রোগের উপসর্গগুলো নিরাময় করা যেতে পারে। তবে উপসর্গগুলো ভালো হওয়ার পারে যদি আবার খারাপের দিকে যায়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া খুবই জরুরী। যদি সায়াটিকার চিকিৎসা না করে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয় তাহলে জটিল সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে রোগী। এই জটিলতার মধ্যে থাকতে পারে ব্যথার পরিমাণ ও অবস্থান বৃদ্ধি এবং নার্ভের চিরস্থায়ী ক্ষতি।

সায়াটিকার উপসর্গঃ

বেশ কিছু উপসর্গের মাধ্যমে বুঝা যায় রোগী সায়াটিকায় আক্রান্ত। এসকল উপসর্গের মধ্যে রয়েছে-

♦ পিঠের নিচের অংশে, নিতম্বের হাড়ে, পায়ের পিছনে এবং নিতম্বের দুইটি গোলাকার মাংসল (বাটক) অংশে ব্যথা।

♦ এক পা বা পায়ের পাতায় ঘনঘন অসাড়তা।

♦ উভয় পায়ে জ্বালা করা।

♦ নিচের দিকে বিকীর্ণ ব্যথা অনুভব করা।

♦ এক পায়ে দুর্বলতা।

♦ পায়ের পাতায় যন্ত্রণাদায়ক সংবেদন বা নাড়াচাড়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়া।

♦ পা অথবা পায়ের পাতা নাড়াচাড়া করা, দাঁড়িয়ে থাকায় অথবা হাঁটায় অসুবিধা হওয়া।

এসকল উপসর্গ ছাড়াও আরো কিছু উপসর্গ দেখা যেতে পারে, যেগুলো দেখা দিলে জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতে হবে। এগুলো উপসর্গের মধ্যে রয়েছে-

 এক বা উভয় পায়েই দীর্ঘকালীন অসাড়তা, 

 পায়ে দুর্বলতা,

 চলাফেরা করার চেষ্টা করলে পায়ে ব্যথা অনুভব করা,

মলত্যাগে সমস্যা হওয়া বা মলত্যাগে নিয়ন্ত্রণ হারানো।

সায়াটিকার উপসর্গের মধ্যে বেশিরভাগই সীমিত সক্রিয়তা এবং এক ধরণের খোঁচা বা জ্বলনের সংবেদনের অনুভূতি হয়। সাথে গুরুত্বর ব্যথা যা পিঠ, পা এবং পায়ের পাতাসহ শরীরের নিচের অংশে কয়েক মিনিটের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

সায়াটিকার উপসর্গগুলো স্যাক্রাম বা ত্রিকাস্থিগত জোড়ের (শিরদাঁড়ার মূলদেশের তেকোনা হাড়) ত্রুটিপূর্ণ ক্রিয়ার অনুরুপ হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় নারীরা সায়াটিকার কারণে পিঠের নিচের অংশে ব্যথা অনুভব করতে পারে।

যখন রোগীর শরীরে সায়াটিকার উপসর্গ দেখা যায়, তখন অন্যান্য রোগ বা অন্য কারণে এই ব্যথা হচ্ছে কি না এবং যথাযথ রোগের লক্ষণ নির্ণয় করার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

চিকিৎসাঃ

যদি সায়াটিকা ৪ থেকে ৭ সপ্তাহের মধ্যে একা একা ঠিক না হয় তাহলে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসক পর্যবেক্ষণ করার পরে কোন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতে হবে সেই সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ প্রদান করবে। কয়েকটি পদ্ধতিতে সায়াটিকার চিকিৎসা করা হয়। এই সকল পদ্ধতি হচ্ছে-

★ ব্যথানাশক ঔষধঃ

রোগীর ব্যথা এবং প্রদাহ কমানোর জন্য চিকিৎসক পেইন কিলার সাজেস্ট করতে পারে। পেইন কিলারের পাশাপাশি আরও কিছু পদ্ধতির সংমিশ্রণে অন্যান্য মেডিসিন প্রেসক্রাইব করতে পারেন৷ নার্ভ বা সাস নিরাময় হওয়া পর্যন্ত এই ঔষধগুলো খাওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। এই ঔষধগুলো রোগীকে স্বল্প সময়ের জন্য ব্যথামুক্ত রাখতে পারে।

★ এপিডিউর‍্যাল ইঞ্জেকশনঃ

এই ইঞ্জেকশনগুলো সরাসরি রোগীর মেরুদন্ডের ভিতরে প্রয়োগ করা হয়। ইঞ্জেকশনগুলো মূলত রোগীর ব্যথা মুক্তির জন্য প্রয়োগ করা হয়।

★ ফিজিওথেরাপিঃ

সায়াটিকার সাথে যুক্ত ব্যথা এবং উপসর্গগুলো থেকে রোগীকে মুক্ত করতে ফিজিওথেরাপি অত্যন্ত কার্যকরী চিকিৎসা। ফিজিওথেরাপি ধীরে ধীরে ব্যথা নিরাময় করতে এবং স্নায়ুর সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করে। ফিজিওথেরাপির সাথে রোগীকে ব্যায়াম এবং ম্যাসাজের মধ্যে থাকতে হবে। কোনো রোগীর সায়াটিকা নির্ণিত হওয়ার প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ফিজিওথেরাপি শুরু করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ফিজিওথেরাপি মূলত ব্যথাকে শান্ত করতে এবং একই সাথে উপসর্গগুলোকে কার্যকরভাবে দমন করতে সাহায্য করে।

★ সার্জারীঃ

উপরে বর্ণিত চিকিৎসা নেওয়ার পরেও যদি ব্যথা খুব বেশি না কমে এবং রোগী ব্যথায় বেশ অস্বস্তিবোধ করে, এক্ষেত্রে চিকিৎসক রোগীকে সার্জারীর পরামর্শ দিতে পারেন। ডিকম্প্রেশন সার্জারী রোগীকে সায়াটিকা থেকে মুক্তি দিতে পারে। সাধারণত সার্জারী করার পরে রোগীর সুস্থ হতে ৬ সপ্তাহের মত সময় লাগে। সায়াটিকার জন্য সার্জারী যা স্লিপড ডিস্ক এর জন্য ঘটে থাকে তা আংশিক ডিসেক্টোমি হিসেবে পরিচিত।

জীবনধারার পরিবর্তন:

রোগীর অবস্থা এবং মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী রোগীর সায়াটিক স্নায়ুর ব্যথা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কন্ট্রোল করা খুব কঠিন নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগের ব্যথা কিছুদিনের মধ্যেই কমে যায় বা ভালো হয়ে যায়। ব্যথা কমানোর জন্য বেশ কয়েকটা উপায় আছে যা মেনে চললে সহজেই ব্যথামুক্ত থাকা যায়। এই উপায়গুলোর মধ্যে রয়েছে-

১. প্রতিদিন যতটা সম্ভব হালকা ব্যায়াম করতে হবে এবং রুটিন মাফিক কাজকর্ম করতে হবে।

২. ব্যথা প্রশমিত করার জন্য দ্রুত হাঁটা এবং ব্যাক স্ট্রেচ (পিঠ, কোমর এবং শরীরের নিচের অংশ প্রসারিত করার ব্যায়াম) করতে হবে।

৩. পিঠের নিচের অংশের পেশীগুলো শিথিল করার জন্য হিটিং প্যাড ব্যবহার করতে হবে। হিটিং প্যাড সহজলভ্য এবং এটি চলাফেরায় সাহায্য করতে দারুন কার্যকর। একটি হিটিং প্যাড একদিনে কয়েকবার ব্যবহার করা যায়।

৪. হিটিং প্যাড ব্যবহার করার পরে পেইন রিলিফ করে এমন মলম লাগাতে পারে। এই মলমগুলো পেশী শিথিল করে এবং পেশির প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে। হিটিং প্যাডের তাপ ক্রিমকে আরও ভালোভাবে শুষে নিতে এবং দ্রুত কাজ করতে সাহায্য করে।

৫. রোগী যদি পায়ে অসাড়তা অনুভব করে তাহলে অসাড়তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মাটির উপর পায়ের পাতাগুলো দ্বারা মৃদু আঘাত করতে পারে বা টোকা মারার চেষ্টা করতে পারে। এর পাশাপাশি পায়ের পাতা সমূহ চক্রাকারে ঘোরাতে পারে। এর ফলে আক্রান্ত রোগীর পায়ের অসাড়তা চলে যাওয়া শুরু করলে এক ধরণের খোঁচা বা হুল ফোটানোর মত ব্যথা অনুভব করতে পারে। এরপর রোগীর পা মৃদুভাবে নাড়াতে হবে। তবে জোরে বা হঠাৎ করে নাড়ানো যাবে না, এমনটা করলে পা শক্ত হয়ে যেতে পারে।

৬. ব্যথা থেকে তাৎক্ষনিক মুক্তি পেতে মাঝে মাঝে রোগী ব্যথানাশক ঔষধ বা ইঞ্জেকশন নিতে পারেন। তবে ঔষধ সেবন করার আগে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সেবন করা উচিত। বিশেষ করে যদি কেউ অন্য রোগের জন্য ঔষধ সেবন করে থাকেন তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করে ঔষধ সেবন করতে হবে।

৭. প্রসেস ফুড বা প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ প্রসেস ফুড রোগীর শরীরে প্রদাহ বাড়িয়ে দেয়। এসব খাবারের বিপরীতে সবুজ শাক-সবজি এবং ফলমূল খাওয়া উচিত। সবুজ শাক-সবজি শরীরের প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে। এছাড়াও শরীরের প্রদাহ কমাতে বাসায় তৈরি আদা গ্রীন টি খুব ভালো সহায়তা করে।

৮. যদি হিটিং প্যাড রোগীকে অস্বস্তিবোধ করায় এক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে উষ্ণ স্নান বা গরম পানি দিয়ে গোসল করাটা একটি ভালো পদ্ধতি হতে পারে।

৯. খুব বেশি নরম বিছানা এবং ফোমের বিছানা পরিহার করতে হবে। এ ধরণের বিছানাগুলো রোগীকে পিছন থেকে কোনো সাপোর্ট দেয় না। বরং মেরুদন্ডে বিশেষ করে মেরুদন্ডের নিচের দিকে চাপ সৃষ্টি করে ব্যথা বাড়িতে তুলতে পারে। নরম বিছানা পরিহার করে করে শক্ত বিছানায় ঘুমাতে হবে। তবে নিশ্চিত হতে হবে যে বিছানা যেন খুব বেশি শক্ত না হয়।

যেগুলো করা যাবে নাঃ

১. যে সকল স্থানে রোগী অসাড়তা অনুভব করেন সে সকল স্থানে বরফের সেক বা ঠান্ডা কম্প্রেস দেওয়া যাবে না।

২. দীর্ঘ সময় বসে থাকা বা শুয়ে থাকা যাবে না।

৩. খুব বেশি চাপ দেওয়ার কারণে নার্ভ থেকে পেশীর দিকেও ব্যথা ছড়িয়ে যেতে পারে। খুব ভারী কাজ বা শরীরে চাপ সৃষ্টি করা যাবে না।

৪. ব্যথার কারণে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়া যাবে না। প্যারাসিটামল পিঠের ব্যথায় কোনো সহায়তা করে না। তবে এটি অকারণে অতিরিক্ত খেলে রোগীর কিডনি নষ্ট হতে পারে। পাশাপাশি হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি থাকে।

৫. মোটা মানিব্যাগ ব্যবহার করা যাবে না। এবং মানিব্যাগ প্যান্টের পিছনের পকেটে না রেখে সামনের পকেটে রাখার চেষ্টা করতে হবে। যদি পিছনের পকেটে মানুব্যাগ রাখতে হয় এবং বসে কাজ করতে হয় তাহলে প্রতি ১ থেকে ১.৫ ঘন্টায় মানিব্যাগ এক সাইড থেকে অন্য সাইডের পকেটে স্থানান্তর করতে হবে।

মনে রাখবেন, যে কোনো রোগের জন্য মেডিসিন গ্রহণ করার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করার বিকল্প কিছু নেই। একই রোগে আক্রান্ত বিভিন্ন রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসকগণ রোগীর স্বাস্থ বিবেচনা করে ভিন্ন ভিন্ন চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। রোগীর কি পরিমাণে ঔষধ সেবন করতে হবে এবং কিভাবে অন্যান্য চিকিৎসা দিতে হবে তা একমাত্র চিকিৎসকরাই নির্ণয় করতে পারেন।

Leave a Comment