ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে যদি হাইপারগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে রক্তে বেড়ে যাওয়া সুগারের লেভেল নিয়ন্ত্রণে আনতে ডাক্তারের দেওয়া পরামর্শ মেনে চলাটা বাধ্যতামূলক। রোগীর করণীয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে রোগীর করণীয় কি এবং বর্জনীয় কি সেগুলো সম্পর্কে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। ঔষধের পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে, যা রোগীর ব্লাড সুগার কমাতে সহায়তা করবে। উপায়গুলো হচ্ছে-
১. খাবারের তালিকা পরিবর্তনঃ
যেসব খাবারে সুগার থাকে বা সুগার বাড়াতে সহায়তা করে সে সকল খাবাড় এড়িয়ে চলতে হবে। সুগার বাড়াতে পারে এসকল খাবারের মধ্যে রয়েছে কেক, মিষ্টি, মধু, বিভিন্ন চিনিযুক্ত পানীয়, কিছু ফল ইত্যাদি।
২. প্রচুর পরিমাণে পানি ও চিনিমুক্ত পানীয় পান করাঃ
প্রচুর পরিমাণে পানি পান করার মাধ্যমে অতি উচ্চমাত্রার হাইপারগ্লাইসেমিয়ার কারণে সৃষ্ট পানিশূন্যতার সমাধান হবে। সুগার ফ্রি বা চিনিমুক্ত পানীয় পান করতে হবে। চিনিযুক্ত পানীয় পা করলে সুগার লেভেল কমবে না। চা, কফি, শরবত ইত্যাদি পান করার সময়েও চিনি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩. ইনসুলিনের ডোজ পরিবর্তনঃ
ইনসুলিন ব্যবহারকারী ডায়াবেটিস রোগীদের সুগাল নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ইনসুলিনের ডোজ কমাতে বা বাড়াতে হতে পারে। এই বিষয়ে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে সুনির্দিষ্ট পরামর্শ গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক।
৪. নিয়মিত হাঁটাহাঁটি ও ব্যায়াম করাঃ
নিয়মিত হাঁটাহাঁটি এবং এ জাতীয় হালকা ব্যায়াম করলে তা রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে আনতে কার্যকর ভুমিকা রাখে। যাদের ওজন অতিরিক্ত বেশি, তাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের শরীরচর্চার মাধ্যমে ওজন কমিয়ে আনাটা খুবই জরুরী। ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকলে হাইপারগ্লাইসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
৫. নিয়মিত পর্যবেক্ষণঃ
ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত ব্লাড সুগার পরিমাপ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। অন্তত ৩ দিনে একবার হলেও ডায়াবেটিস চেক করা জরুরী। এছাড়া ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে রক্ত অথবা প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে কিটোন টেস্ট করা লাগতে পারে। আর ব্লাড সুগার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত কোনো নতুন লক্ষণ রোগীর শরীরে দেখা যাচ্ছে কি না সেদিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। নতুন লক্ষণ দেখা দিলে অন্য কোনো গুরুত্বর রোগ বা সমস্যা নির্দেশ করতে পারে।
কখন জরুরী চিকিৎসা সেবা নিতে হবেঃ
রক্তে সুগারের মাত্রা বেশি বা খুব বেশি হলে সাথে সাথে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। সুগারের মাত্রা খুব বেশি বাড়ার পাশাপাশি কিছু লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে। লক্ষণগুলো হচ্ছে-
★ বমি বমি ভাব বা বমি হলে,
★ শ্বাসপ্রশ্বাস গভীর ও দ্রুত হয়ে গেলে,
★ পেটব্যথা ও ডায়রিয়া হলে,
★ ঝিমিয়ে পড়া বা সজাগ থাকতে কষ্ট হলে,
★ পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে। যেমন: মাথাব্যথা, ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, হৃদস্পন্দন দ্রুত ও দুর্বল হয়ে যাওয়া।
★ ২৪ ঘন্টার বেশি সময় ধরে জ্বর থাকলে। অর্থাৎ শরীরের তাপমাত্রা ৩৮° সেলসিয়াস বা ১০০.৪° ফারেনহাইটের উপরে থাকলে।
এই লক্ষণগুলো হাইপারগ্লাইসেমিয়ার কারণে সৃষ্ট গুরুতর জটিলতা যেমন- ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস এবং হাইপারঅসমোলার হাইপারগ্লাইসেমক স্টেট এর সংকেত হতে পারে। এ সকল ক্ষেত্রে রোগীকে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা নেওয়া খুবই জরুরী।
রক্তে সুগার বেড়ে যাওয়া প্রতিরোধের উপায়ঃ
রক্তে সুগার বেড়ে গেলে ঘাবড়ানোর প্রয়োজন নেই। কিছু সহজ উপায় অবলম্বন করে গুরুত্বর বা দীর্ঘমেয়াদি হাইপারগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। উপায়গুলোর মধ্যে রয়েছে–
★ খাবার ও পানীয় বিষয়ে সতর্কতাঃ
খাবার ও পানীয় পানের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। অতিরিক্ত চিনিযুক্ত বা মিষ্টিজাতীয় খাবার রক্তের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। সুতরাং মিষ্টি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার গ্রহণে সচেতন হতে হবে। মাঝেমাঝে সামান্য পরিমাণে মিষ্টি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়াটাও জরুরী। না হলে সুগার নীল হয়ে যেতে পারে।
★ চিকিৎসা পদ্ধতি মেনে চলাঃ
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ঔষধ সেবন করতে হবে। ডাক্তার ইনসুলিন দিয়ে থাকলে নির্দিষ্ট মাত্রায় নির্দিষ্ট সময় নিতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চলে আসলে বা কমে গেলে ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত ইনসুলিন বন্ধ করে দেওয়া যাবে না বা কমানো যাবে না। ইনসুলিন বন্ধ করা বা ডোজ বাড়ানো ও কমাতে হলে ডাক্তার আপনাকে পরামর্শ দিবে।
★ অলস না হয়ে সক্রিয় হতে হবেঃ
শুয়ে বসে না থেকে যতটুকু সম্ভব সক্রিয় থাকার চেষ্টা করতে হবে। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তবে যারা ডায়াবেটিসের ঔষধ সেবন করে তাদের এবং যাদের ডায়াবেটিসের পাশাপাশি হার্টের সমস্যা আছে তাদের ব্যায়াম শুরু করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ কিছু ঔষধ খাওয়া অবস্থায় বারী ব্যায়াম অথবা অধিক শরীরচর্চার কারণে ঔষধের প্রভাবে সুগারের পরিমাণ অতিরিক্ত কমে সুগার নীল বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়ে যেতে পারে।
★ অসুস্থ অবস্থায় বাড়তি যত্নবান হতে হবেঃ
অসুস্থ অবস্থায় রোগীর বাড়তি যত্ন নিতে হবে। কারণ অসুস্থ অবস্থায় রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডাক্তার বিশেষ কিছু পরামর্শ প্রদান করতে পারেন। এবং তা মেনে চলার নির্দেশনা দিতে পারেন।
★ নিয়মিত সুগার পরিমাপ করাঃ
নিয়মিত রক্তের সুগার পরিমাপ করতে হবে। ডায়াবেটির ধরা পড়লে প্রথমে প্রতিদিন এবং পরবর্তীতে পারতপক্ষে প্রতি ৩ দিনে অন্তত একবার ডায়াবেটিস পরিমাপ করতে হবে। বাসায় থাকা গ্লুকোমিটারের সাহায্যেই এই পরীক্ষাটি করতে পারেন। সকালে খালিপেটে একবার এবং খাওয়ার ২ ঘন্টা পরে একবার ডায়াবেটিস চেক করতে হয়। যদি পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়, তাহলে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে তার পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
সুগার বেড়েছে বুঝবেন যেভাবেঃ
রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরে কী কী সমস্যা হয় সে সম্পর্কে কম-বেশি অনেকেই জানি। ডায়াবেটিস এমন এক রোগ যা ক্রমশ মানুষের অসুস্থতাকে বাড়িয়ে তোলে। পাশাপাশি নানা রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে সহায়তা করে রোগটি। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে ঔষধ সেবন, নিয়ম মেনে খাওয়া-দাওয়া এবং শরীরচর্চা করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে ঠিকই, কিন্তু এই রোগটিকে কোনোভাবেই পুরোপুরি নিরাময় করা যায় না। সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সর্বপ্রথম সুগাড় বেড়ে যাওয়ার এবং কমে যাওয়ার লক্ষণগুলো কি সেগুলো আগে চেনা প্রয়োজন। এই লক্ষণগুলো চিনতে পারলেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়া সম্ভব। আসুন জেনে নেই, রক্তে সুগার বেড়ে গেলে শরীরে কি কি লক্ষণ দেখা দেয়।
১) খুব অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠাঃ
খুব অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠা রক্তে সুগারের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম একটি লক্ষণ। রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরে পানীর পরিমান কমে যায় বা পানির অভাব দেখা দেয়। ফলে সৃষ্টি হয় ডিহাইড্রেশনের। ডিহাইড্রেশনের ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
২. ঘনঘন প্রস্রাবঃ
বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে গেলে তা কিডনির উপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করতে থাকে সুগার বের করে দেওয়ার জন্য। সেজন্য ঘনঘন প্রস্রাবের চাপ হয় এবং প্রস্রাব পায়।
৩) আঙুল অবশ হয়ে আসাঃ
হাত ও পায়ের আঙুল বা পুরো হাত অবশ বোধ করা রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। ডায়াবেটিস মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেলে এই লক্ষণটি শরীরে প্রকাশ পায়।
৪) ওজন কমে যাওয়াঃ
ডায়েট করা বা ব্যায়াম না করার পরেও অতিরিক্ত ওজন কমে যাওয়াটাও ডায়াবেটিসের অন্যতম একটি লক্ষণ।
৫) ঘনঘন পিপাসা পাওয়াঃ
যখন শরীর থেকে অতিরিক্ত সুগার বাইরে বের করার জন্য কিডনিতে চাপ পড়ে, তখন ঘনঘন প্রস্রাব পায়। এই সময় কিডনি শরীর থেকে ফ্লুইড নিতে থাকে। এর ফলে শরীরে পানীর ঘাটতি হতে থাকে। যার ফলে ঘনঘন পিপাসা পায়।
৬) দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়াঃ
শরীরে সুগারের মাত্রা বেড়ে গেলে তার কুপ্রভাব পড়ে রোগীর দৃষ্টিশক্তির উপরে। যার ফলে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে যেতে দেখা যায় অনেক রোগীর।
৭) ঘা শুকাতে দেরি হওয়া:
শরীরের কোনো অংশে কেটে গেলে বা ছিলে গেলে বা ফোঁড়া অথবা ইনফেকশন হলে শুকাতে অনেক বেশি সময় লাগাটাও সুগার বেড়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষণ।
উপরের এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবহেলা না করে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে লক্ষণগুলো ডায়াবেটিসের বা সুগারের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে প্রকাশ পেয়েছে কি না। অবহেলা করলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে অঙ্গ পচে যেতে পারে। এবং অঙ্গহানি বা মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। আবার অনেক সময় রোগীকে কোমায় চলে যেতেও দেখা যায় সুগারের তারতম্যের কারণে। অনেকেই মনে করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার কারণ হচ্ছে মিষ্টি খাওয়া। সেই ভাবনা থেকেই আবার অনেকে মনে করে তিনি তো মিষ্টি খান না, তাই তার ডায়াবেটিস হবে না, বা রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়বে না। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের সুগারের মাত্রা বেড়ে যায় এই কথাটা ঠিক। কিন্তু মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয় বা মিষ্টি না খেলে ডায়াবেটিস হবে না এই কথাটি একদমই ঠিক না।
আসুন নিজেদের প্রতি যত্নবান হই। রোগে আক্রান্ত হয়ে সচেতন হওয়ার চেয়ে রোগাক্রান্ত হওয়ার আগে সতর্ক থাকা জরুরী।
আরও পড়ুনঃ ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স কি?