রক্তদানে করনীয় ও বর্জনীয় বিষয়সমূহ সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করুন ।

আসুন যেনে নেই রক্তদান সম্পর্কে সঠিক তথ্য সমূহঃ

 

মানুষের জীবন বাঁচাতে রক্ত যে কত মূল্যবান তা বোঝা যায় কেবল রক্তের প্রয়োজন হলেই। এক ব্যাগ রক্ত বাঁচাতে পারে আপনার জীবন। তবে রক্তের সম্পর্ক থাকলেই যে কেউ রক্ত দেবে তা কিন্তু নয়। আজকাল অনেকেই অতি উৎসাহ থেকে অনেকে রক্তদান করে থাকেন। এছাড়া অনেকের জীবন বাঁচাতেও রক্ত দিতে অনেকে এগিয়ে আসেন। এখন রক্ত পাওয়া আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে গেছে। বিশেষ করে তরুণরা, খুব আগ্রহ নিয়ে অপরিচিতদেরকেও রক্ত দিয়ে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রক্তদানের ফলে রক্তদাতার শারীরিক কোনো ক্ষতি হয় না। রক্তের লোহিত কণিকার আয়ু ১২০ দিন। অর্থাৎ আপনি রক্ত দিন বা না দিন ১২০ দিন পর লোহিত কণিকা আপনা আপনিই মরে যায়। সেখানে জায়গা করে নেয় নতুন লোহিত কণিকা। রক্তের আর উপাদানগুলোর আয়ুষ্কাল আরও কম। সুস্থ, সবল, নিরোগ একজন মানুষ প্রতি #চার মাস অন্তর রক্ত দিতে পারে। রক্ত দেয়ার আগে যে বিষয়গুলো জেনে নেয়া প্রয়োজন

★ শারীরিক সুস্থতাঃ

রক্ত দেয়ার প্রথম শর্ত হল রক্তদাতাকে অবশ্যই শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে। কোনো ব্যক্তি যদি সুস্থ না থাকেন তিনি রক্ত দিতে পারবেন না।

★ সর্বনিম্ন বয়স ও ওজনঃ

রক্তদাতার বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে আঠারো বয়সের নিচে কেউ রক্ত দিতে পারবেন না। এছাড়া ওজন হতে হবে কমপক্ষে ছেলে ৫০ এবং মেয়ে ৪৮ কেজি ।

★ নিম্ন ও উচ্চ রক্তচাপঃ

যাদের নিম্ন বা উচ্চ রক্ত চাপের সমস্যা রয়েছে তারা রক্তদান করতে পারবেন না। রক্তদাতার রক্ত চাপের দিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। খুব বেশি বা খুব কম কোনটিই রক্তদানের ক্ষেত্রে সহায়ক নয়।

★অ্যান্টিবায়োটিক সেবনঃ

কোনো রোগের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক সেবনরত অবস্থায় থাকলে সেক্ষেত্রে রক্তদান করা উচিত নয়। অ্যান্টিবায়োটিক সেবনকারী রোগী রক্তদান করলে তিনি শারীরিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।

★ পিরিয়ড ও গর্ভাবস্থাঃ

মাসিক চলাকালীন সময়ে কোনো নারী রক্তদান করতে পারবেন না। কারণ এ সময় শরীর থেকে রক্ত প্রবাহিত হয় শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়া গর্ভাবস্থায় রক্তদান করতে পারবেন না।

★ দুর্ঘটনাঃ

রক্তদানের কাছাকাছি সময়ে কোনও বড় দুর্ঘটনা বা অস্ত্রোপচার হয়ে থাকলে রক্তদান না করা বাঞ্ছনীয় । কারণ এ সময় আপনি শরীরিকভাবে রক্ত দেয়ার জন্য সক্ষম নন।

★ রক্তের হিমোগ্লোবিনঃ

রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১১-এর নিচে হলে রক্ত দেওয়া ঠিক নয়। এতে করে হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, ক্লান্ত লাগা, চোখে ঝাঁপসা দেখা, মাথা ঘোরাসহ অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন।         এছাড়াও খেয়াল রাখতে হবে যে, এক ব্যাগ রক্তদানের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া দরকার। রক্তদানের পর দুই গ্লাস পানি বা জুস খেলে রক্তের জলীয় অংশটুকু পূরণ হয়ে যায়। এরপর পর্যাপ্ত পানি ও জুস পান করতে হবে, সেই সঙ্গে ৮ ঘণ্টা ঘুম। খাবারে কলিজা, বিভিন্ন ধরনের কচু, ডিম, দুধ রাখতে হবে।

 

★ রক্তদানের উপকারিতাঃ

রক্তদানের প্রথম এবং প্রধান কারণ একজনের দানকৃত রক্ত আরেকজন মানুষের জীবন বাঁচাবে। রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। রক্তদান করার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয় এবং রক্তদানের ২ সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্তকণিকার জন্ম হয়ে ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। বছরে ৩ বার রক্তদান আপনার শরীরে লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা বাড়িয়ে তোলার সাথে সাথে নতুন কণিকা তৈরির হার বাড়িয়ে দেয়। উল্লেখ্য রক্তদান করার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেহে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যায়। নিয়মিত রক্তদান করলে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। আরেক গবেষণায় দেখা যায়, যারা বছরে দুই বার রক্ত দেয়, অন্যদের তুলনায় তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। বিশেষ করে ফুসফুস, লিভার, কোলন, পাকস্থলী ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি নিয়মিত রক্তদাতাদের ক্ষেত্রে অনেক কম পরিলক্ষিত হয়েছে। চার বছর ধরে ১২০০ লোকের ওপর এ গবেষণা চালানো হয়েছিলো। নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে নিজের শরীরে বড় কোনো রোগ আছে কিনা তা বিনা খরচে জানা যায়। যেমন : হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি (এইডস)। প্রতি পাইন্ট (এক গ্যালনের আট ভাগের এক ভাগ) রক্ত দিলে ৬৫০ ক্যালরি করে শক্তি খরচ হয়। অর্থাৎ ওজন কমানোর ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রক্তদান ধর্মীয় দিক থেকে অত্যন্ত পুণ্যের বা সওয়াবের কাজ। পবিত্র কোরআনে সূরা মায়েদার ৩২ নং আয়াতে উল্লেখ আছে, ‘একজন মানুষের জীবন বাঁচানো সমগ্র মানব জাতির জীবন বাঁচানোর মতো মহান কাজ।    রক্তদান করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। রক্তদাতার যদি নিজের কখনো রক্তের প্রয়োজন হয় তাহলে ব্লাড ব্যাংকগুলো তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে রক্তের ব্যবস্থা করে দেয়।

 

★রক্তদানের পূর্বে ও পরে করণীয়ঃ
————————————————

প্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ ১৮ বছর বয়সের পর সুস্থ স্বাভাবিক সকলেই স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে পারেন। এবং পুরোপুরি সুস্থ সকলের রক্ত দেয়াই উচিত। আপনার দেয়া রক্তে হয়তো একজন অসুস্থ মানুষের জীবন বাঁচতে পারে। কিন্তু আপনি যদি নিজেই সম্পূর্ণ সুস্থ না হন তবে রক্ত দেয়ার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু শুধু রক্ত দিলেই তো চলবে না, রক্ত দেয়ার ফলে রক্তদাতার যেনো শারীরিক কোনো সমস্যা না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। রক্ত দেয়ার পূর্বে এবং পরে একজন রক্তদাতার বিশেষ কিছু কাজ করা উচিত নিজের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য। চলুন তবে দেখে নেয়া যাক কি কি কাজ করবেন।

 

★রক্ত দেয়ার পূর্বে করনীয়ঃ

১. আপনি যদি কোনো কারণে অসুস্থবোধ করে তবে সেদিনের মতো রক্ত দেয়া থেকে বিরত থাকুন,

২. রক্ত দেয়ার পূর্বে পুষ্টিকর খাবার খেয়ে নিন, কিন্তু তৈলাক্ত কিছু খাবেন না।

৩. রক্ত দানের পূর্বে প্রচুর পরিমাণে পানি ও পানি জাতীয় খাবার খাবেন।

৪. যেদিন রক্ত দেবেন তার আগের রাতে অনেকটা সময় ভালো করে ঘুমিয়ে নেবেন।

৫. ভরাপেটে খাওয়ার ৩০ থেকে ৬০ মিনিট পরে রক্ত দেয়া ভালো।

৬. খালি পেটে না দিয়ে হালকা খাবার খেয়ে রক্ত দেয়া ভালো।

 

★রক্তদানের পরে করনীয়ঃ

১) অনেকটা সময় শুয়ে থাকবেন। হুট করে উঠে বসবেন না বা উঠে দাঁড়াবেন না।

২) প্রচুর পরিমাণে পানি ও পানি জাতীয় খাবার গ্রহন করুন। এই ব্যাপারে অবহেলা করবেন না।
৩) আয়রন, ফোলাইট, রিবোফ্লাবিন, ভিটামিন বি৬ সমৃদ্ধ খাবার খাবেন। লাল মাংস, মাছ, ডিম, কিশমিশ, কলা ইত্যাদি ধরণের খাবারে এসব উপাদান পাবেন।
৪) কয়েক ঘণ্টার জন্য শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। এবং বেশ কিছুদিন সাধারণ সময়ের তুলনায় একটু কম পরিশ্রম করে বিশ্রাম নিন।
৫) রক্তদানের ৪ মাস পর নতুন করে রক্ত দিতে পারবেন। এর আগে পুনরায় রক্ত দেবেন না।
৬) রক্তদানের পরে কমপক্ষে ২৪ ঘন্টা তামাক জাতীয় , নেশা জাতীয় দ্রব্য , ক্যাফেইন জাতীয় খাবার ( চা, কফি, এনার্জি ড্রিঙ্ক) পরিহার করুন । এগুলো আপনার স্ট্রোক এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে .

 

কোন সময় ও কোন কারণে কতদিন রক্তদান থেকে বিরত থাকতে হবেঃ

☞ ১) কুকুরের কামড়ের ইনজেকশন যারা নিয়েছেন, তারা ইনজেকশন-এর কোর্স শেষ হওয়ার পর ১ বছর রক্তদান করবেন না।

☞ ২) বড় অপারেশন যাদের হয়েছে তারা ১ বছর পর্যন্ত রক্তদান করবেন না। ছোট বা মাঝারি অপারেশন হলে ৬ মাস পর্যন্ত রক্তদান অনুচিত।

☞ ৩) কোন কারণে যদি কেউ রক্ত গ্রহণ করে থাকেন, তবে তিনিও এক বছর রক্তদান করতে পারবেন না।

☞ ৪) জন্ডিস, ম্যালেরিয়া বা টাইফয়েড রোগ হলে, সুস্থ হওয়ার পর আরও ৬ মাস রক্তদান করবেন না।

☞ ৫) যারা হাসপাতালে গিয়ে দাঁত ফেলেছেন,নাক বা কানে ছিদ্র করিয়েছেন, বা শরীরে উল্কি/ট্যাটু করিয়েছেন, তারাও ৬ মাস রক্তদানে অক্ষম।

☞ ৬) গত ৬ মাসের মধ্যে যে মহিলার গর্ভপাত হয়েছে, বা যিনি বর্তমানে সন্তান- সম্ভবা, তিনিও রক্তদান করতে পারবেন না।

☞ ৭) যে মহিলার সন্তান এখনও মাতৃদুগ্ধ পান করে, তিনি রক্তদান করবেন না।

☞ ৮) যে মহিলা বর্তমানে ঋতুচক্রের মধ্যে আছেন (মাসের নির্দিষ্ট ৫/৬ দিন) তিনি রক্তদান করবেন না।

☞ ৯) যার কোন চর্মরোগ বা যৌনরোগ আছে, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পরও ৬ মাস পর্যন্ত রক্তদান করবেন না।

☞ ১০) যে ব্যক্তি বর্তমানে কোন ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাচ্ছেন,তিনি কোর্স শেষ না হওয়া পর্যন্ত রক্তদান করবেন না। এন্টিবায়োটিক শেষ হওয়ার পরেও ১৪ দিন রক্তদান থেকে বিরত থাকতে হবে।

☞ ১১) যিনি গত বারো ঘণ্টার মধ্যে সুরাপান (মদ) করেছেন, তিনি রক্তদান করবেন না। কোন ব্যক্তি যদি নিয়মিত সুরাপানে বা নেশা সেবনে (Drugs) অভ্যস্ত হন, তা হলে তার কাছ থেকে রক্ত গ্রহণ না করাই উচিৎ।

☞ ১২) যে ব্যক্তি একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সংসর্গে অভ্যস্ত, তার কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ অনুচিত। পতিতা পল্লীর লোকজন, জেলের কয়েদী বা দূরগামী ট্রাকের ড্রাইভারদের কাছ থেকে কখনোই রক্ত সংগ্রহ করতে নেই।

☞ ১৩) মানসিক ভাবে অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি বা মানসিক রোগীদের কাছ থেকে রক্ত গ্রহণ করা উচিৎ নয়।

☞ ১৪) একবার রক্তদান করে ১২০ দিনের মধ্যে রক্তদান করা অনুচিত। উপরোক্ত নির্দেশিকার বাইরেও কিছু কিছু প্রশ্ন কারো থাকতেই পারে। প্রতিটি রক্তদান শিবিরে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক উপস্থিত থাকেন। প্রশ্ন এবং সংশয়ের কথা সেই চিকিৎসকের কাছে সরাসরি জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিৎ। আসুন নিজে নিয়ম মেনে রক্তদান করি আর অন্যকেও নিয়ম মেনে রক্তদান করতে সাহায্য করি । আর, সচেতনতা ছড়িয়ে দেই সবার মাঝে , রক্তদাতা তৈরি করি প্রতিটি ঘরে ।

সচেতনতায়- roktobondho.com ওয়েবসাইট ।

Leave a Comment