যানবহনে বমি হয় কেন? এর প্রতিকার কি?

আজকের আলোচনায় থাকছে, মোশন সিকনেস কি, কেন হয় এবং পরিত্রাণের উপায় কি। 

অনেকেই গাড়িতে যাত্রা করলে অসুস্থ বোধ করেন। এই অসুস্থতা প্রথমে মাথা ঘোরানো দিয়ে শুরু করলেও শেষ হয় বমির মাধ্যমে। শারিরীক এই জটিল অবস্থাকে বলা হয় মোশন সিকনেস। এই অনুভূতিটি খুবই বিব্রতকর এবং বিরক্তিকর। চলুন আজ জেনে নেই কি করলে এই অনুভূতিটি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। সচরাচর মোশন সিকনেসে আক্রান্ত হলে আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ হয় সমুদ্রে। আর এই খারাপ হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে ভয়। এমন পরিস্থিতিতে ভয় পাওয়া যাবে না। যদি যাত্রাপথে ভয় বা অসুস্থ অনুভব করেন তাহলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করবেন৷ মনে রাখবেন নিজেকে যত স্বাভাবিক রাখতে পারবেন আপনার মস্তিষ্ক তত দ্রুত আপনার দেহে পজেটিভ সিগন্যাল পাঠিয়ে সিকনেস দূর করে দিবে। যাত্রাপথে ভয় না পেয়ে যাত্রাকে উপভোগ করার চেষ্টা করবেন। এতে দেখে বা মস্তিষ্কে নেগেটিভ কোন তথ্য আদান প্রদানের সুযোগ তৈরি হয় না।

গাড়িতে ভ্রমণকালীন অনেকের বমি হওয়ার কারণ কিঃ

বাসে, ট্রেনে, গাড়িতে, লঞ্চ, জাহাজ বা সমুদ্রে যে কোন বাহনে, এমনকি আকাশ পথে ভ্রমণের সময় আমাদের মধ্যে অনেকেই দুর্বল অনুভব করে থাকি। আমাদের অনেকের গা গুলিয়ে বমি আসতে চায়। এমন হয় কেন?

মানবদেহের শারিরীক গঠনকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় আমাদের কানের একেবারে ভেতরের অংশে গতি শনাক্তের জন্য বিশেষ কিছু কোষ থাকে। যেগুলোকে স্নায়ু কোষ বলা হয়ে থাকে। এই স্নায়ু কোষগুলোর কাজ গতি সনাক্ত করা। আমরা যখন চলাফেরা করি, আমাদের দেহের গতি এই এসব স্নায়ুকোষ মস্তিষ্ককে অনুভূতি দান করে।

যানবাহনে ভ্রমণের সময় আমরা যদি চোখ বন্ধ করে থাকি অথবা বই পড়ি, অথবা মোবাইল বা অন্য কোন কিছুতে ব্যস্ত থাকি তাহলে আমাদের চোখ আমাদের মস্তিষ্ককে বার্তা পাঠায় আমরা স্থির আছি। স্বাভাবিক কারণেই আমরা বই বা কোন বস্তুর দিকে তাকিয়ে থেকে কিংবা চোখ বন্ধ করে রেখে যাই করি না কেন, আমাদের চোখ ধরেই নেয় আমরা স্থির আছি। তখন আমাদের চোখ আমাদের মস্তিষ্ককে সিগনাল দেয় যে, আমাদের শরীরটা স্থির আছে। আমরা গতিশীল না। কিন্তু ওই যে কানের ভেতরের স্নায়ু কোষগুলো, যা আমাদের গতির অনুভূতির দান করে। সেগুলো স্পষ্ট টের পায় আমরা গাড়িতে ভ্রমণরত তথা গতিশীল অবস্থায় আছি। এই অন্তঃকর্ণ আমাদের মস্তিষ্ককে বার্তা পাঠায় আমাদের অবস্থান গতিশীল পর্যায়ে আছে।

শরীরের দুটি ভিন্ন অঙ্গ, আমাদের মস্তিষ্ককে দুই রকমের তথ্য পাঠানোর কারণে শরীরের ভেস্টিবিউলার সিস্টেম দ্বিধায় পড়ে যায় আমরা কি গতিশীল অবস্থায় আছি নাকি স্থির অবস্থায়!

একটি বিষয় বলে রাখা ভালো, এই ভেস্টিবিউলার সিস্টেমটিই মানবদেহের ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে। অর্থাৎ এই সিস্টেমের কাজই হচ্ছে মানব দেহের ভারসাম্য রক্ষা করা। কিন্তু যখন এই সিস্টেমটাই অন্তঃকর্ণ ও চোখের দু’রকম তথ্য পাঠানোর কারণে দ্বিধায় পড়ে যায়, তখন স্নায়ুবিক গরমিলের কারণে আমাদের মাথা ঘুরাতে শুরু করে। আর এই কারণেই যাত্রাকালীন সময়ে আমাদের মাথা ঘুরায়।

তাহলে প্রশ্ন হলো আমাদের বমি আসে কেন?

এর উত্তর হচ্ছে, মস্তিষ্কে দুই রকম বার্তা পৌঁছানোর কারণে স্নায়ুবিক গরমিল সৃষ্টি হয়। তথা মস্তিষ্কে এক ধরনের বিভ্রান্তি হয় যে আসলে কোন তথ্যটা সঠিক। আমাদের মস্তিষ্ক সব সময় আমাদের শরীরকে ভালো রাখতে চায়।
আপনারা সকলেই জানেন মস্তিষ্ককে বলা হয় মানবদেহের কম্পিউটার। মস্তিষ্ক সবকিছু ধারণ করে রাখে। আবার মস্তিষ্কই দেহের সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে থাকে এবং আমাদের আবেগ, অনুভূতি, আঘাতসহ সকল কিছুর অনুভব দিয়ে থাকে। আর যখন এই বিভ্রান্তি ঘটে অর্থাৎ মস্তিষ্কে দুই ধরণের তথ্য আসতে থাকে, তখন আমাদের মস্তিষ্ক ধরে নেয় আমাদের দেহে নিশ্চয়ই কোন একটি বিষক্রিয়া কাজ করছে। অর্থাৎ কোন না কোনভাবে আমাদের শরীরে বিষ বা বিষাক্ত পদার্থ ঢুকে গিয়েছে। অতঃপর মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নেয় দেহ থেকে বিষটি বের করে দিবে। যার একমাত্র উপায় বমি করা।

অত:পর আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের শরীরের ভিতরে এমন একটি বিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, যার কারণে আমাদের বমি আসতে বাধ্য। মূলত বমির আসল কারণটা হচ্ছে মস্তিষ্ক চায় এমন সমস্যায় ভুগতে থাকা ব্যক্তির পাকস্থলী খালি করে ফেলতে। পাকস্থলীতে যা কিছু আছে সব কিছু বের করে দিতে চায় আমাদের মস্তিষ্ক। যেন বিষটি সাথে সাথে দেহ থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু আদতে আমাদের শরীরে তো কোন বিষই ঢুকেনি। অর্থাৎ যাত্রাপথে বমি হওয়ার কারণই হচ্ছে মস্তিষ্কের এই ভুল ধারণা।

যাত্রাপথে যানবাহনে বমি, মাথা ঘোরানো বা অসুস্থতাকে সহজ ভাষায় বলা হয় মোশন সিকনেস। এখন কথা হচ্ছে মোশন সিকনেস কি সবার হয় ?

এর উত্তর হচ্ছে না। সবারই মোশন সিকনেস হয় না। যাদের অন্তঃকর্ণ এবং চোখ একদম ঠিক আছে শুধুমাত্র তাদেরই এই সমস্যাটি হয়

আবার অনেকের বংশগত কারণেও এই রোগ বা সমস্যাটি হয়ে থাকে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের এই সমস্যাটি বেশি হয়। আর যাদের অন্তঃকর্ণের সমস্যা রয়েছে তাদের সাধারণত এই সমস্যাটিতে পড়তে হয় না। তারা সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই যে কোন যানবাহনে যতদূর ইচ্ছে ভ্রমণ করে যেতে পারে। ভ্রমণ করতে তাদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা বোধ হয় না।

সাধারণ মানুষের মোশন সিকনেসের শিকার হওয়ার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি বাজে অনুভূতি হয় মাইগ্রেনে আক্রান্ত মানুষগুলোর। বমি, অসুস্থতা বা মাথা ঘুরানোর সাথে মাথা ও চোখে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে থাকে মাইগ্রেনে আক্রান্ত ব্যক্তির মোশন সিকনেসে আক্রান্ত হলে।

এই মোশন সিকনেস থেকে পরিত্রান পাওয়ার উপায় কীঃ

এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুবই সহজ। আমাদের অন্তঃকর্ণ বা স্নায়ু এবং চোখকে মস্তিষ্কে একই বার্তা পাঠাতে হবে। উভয় অঙ্গ যদি একই রকম বার্তা মস্তিষ্কে পাঠায় তাহলে মস্তিষ্ক কোন বিভ্রান্তির মধ্যে পড়বে না। একই তথ্য পাওয়ায় মস্তিষ্ক ধরে নিবে না যে, আমাদের দেহে কোন বিষক্রিয়া হচ্ছে। এতে করে মস্তিষ্ক বমির উদ্রেকও তৈরি করবে না। আর স্নায়ুবিক গরমিল না হওয়ার কারণে মাথাও ঘুরাবে না। আর এতে করে বমি বা অসুস্থতা বোধও হবে না।

যেভাবে আমরা চোখ এবং অন্তঃকর্ণের মাধ্যমে একই বার্তা মস্তিষ্কে পাঠাতে পারিঃ

খুবই সহজ একটি সমাধান আছে। অস্বস্তি বা অসুস্থতা বোধ করলে যানবাহনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকবেন।
এতে করে চোখ দেখবে আমরা গতিশীল। আর অন্তঃকর্ণ তো বুঝতেই পারবে আমরা গতিশীল অবস্থায় আছি। এতে উভয় অঙ্গই আমাদের মস্তিষ্কে একই বার্তা পাঠাবে। ফলে কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই আমাদের ভ্রমণটা উপভোগ্য হয়ে উঠবে।

মোশন সিকনেসের চিকিৎসা কিঃ

প্রথমেই বলে রাখি মোশন সিকনেস রোধে মেডিসিনের থেকে ঘরোয়া কিছু টোটকা আছে যা আপনাকে দ্রুত আরাম দিতে পারে। মেডিসিন এবং ঘরোয়া টোটকা উভয়ই ব্যবহার করতে পারেন।

যেকোন ধরণের মেডিসিন গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই গ্রহণ করবেন।

– মেডিসিনঃ

মোশন সিকনেস থেকে বাঁচতে কমন কিছু মেডিসিন আছে। এগুলো হচ্ছেঃ

★ Meclizine,

★Diphenhydramine,

★Dimenhydrinate,

★Scopolamine,

American Academy of Family Physicians (AAFP), scopolamine ঔষধটি ব্যবহারে ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কারণ এই ঔষধ, nausea ও vomiting রোধে বেশ কার্যকরী এবং এই ধরণের ঔষধে ঘুম ঘুম ভাবও হয় না। আবার এটি Skin patch এর ক্ষেত্রেও খুব ভালো কাজ করে।

Antihistamine জাতীয় ঔষধও এই সমস্যা রোধে বেশ কার্যকরী। কিন্তু এ জাতীয় ঔষধ, সেবনকারীর নিদ্রাভাব নিয়ে আসে।

আরেক ধরণের মেডিসিন আছে যাদের antiemetic বলা হয়। এগুলো মূলত nausea এবং vomiting এর চিকিৎসায় ব্যবহার হয়।

–ঘরোয়া টোটকাঃ

একই সাথে আরও কিছু করা যাবে। সেগুলো হচ্ছে,

★ ভ্রমণের আগে বমিনাশক ট্যাবলেট এবং গ্যাসের ঔষধ খাওয়া যেতে পারে। অনেকের গ্যাসের সমস্যা থাকার কারণে যাত্রাপথে বমি হতে পারে।

★ যাত্রা শুরুর একদম আগে ভারি কোন খাবার খাওয়া যাবেনা। ভারি খাবার খেলে অন্তত দেড় ঘন্টা আগে খেতে পারেন।

★ সাথে লেবু, কমলা বা লং রাখতে পারেন। বমি বমি ভাব এলে লেবু বা কমলার ঘ্রাণ বমি ভাব কাটাতে বেশ ভালো কাজে দেয়। যাত্রার শুরুতে মুখে লং রাখতে পারেন। এটি আপনার বমি রোধের পাশাপাশি মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে কাজ করে।

কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবেঃ

সাধারণত মোশন সিকনেসের কারণে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হয় না। ভ্রমণ শেষ হওয়ার সাথে সাথে মোশন সিকনেসও আর থাকে না। তবে ভ্রমণ শেষ হওয়ার পরেও যদি মাথাঘোরা, মাথাব্যথা, বুকে ব্যথা, বমি বন্ধ না হওয়া- এসকল লক্ষণ থেকে যায় বা অস্বস্তিবোধ হতে থাকে, তাহলে দেরি না করে ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। কারণ এমনটা মোশন সিকনেসের কারণে না হয়ে অন্য কারণে বিশেষ করে হার্টের সমস্যার করণে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আরও পড়ুনঃ সাড়েন কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে কি? 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *