মেনোরেজিয়াঃ কারণ, উপসর্গ, চিকিৎসা এবং পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর উপায়

মেনোরেজিয়া কি

সকলেই এইটা জানি নির্দিষ্ট বয়সে নারীদের প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিন পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়। আর এই পিরিয়ডের সময় নারীদের রক্তপাত হয়ে থাকে। তবে অনেক সময় এই রক্তপাতের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি হয়ে যায়। পিরিয়ডের সময় এই অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়াকেই মেনোরেজিয়া বলা হয়। সচরাচর নারীদের ২৮ দিন পরপর পিরিয়ড হয়ে থাকে। তবে কিছু সময় পিরিয়ড নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরেও হতে পারে। সচরাচর ২১ থেকে ৩৭ দিনের মধ্যে পিরিয়ড হলে ডাক্তার এটিকে স্বাভাবিক পিরিয়ড বলে গণ্য করে নেয়। তবে যদি রেগুলার এমনটা হতে থাকে, অর্থাৎ নির্দিষ্ট দিনের আগে পিরিয়ড হতে থাকে তাহলে অস্বাভাবিক পিরিয়ড হিসেবে বিবেচিত হয়। এমনটা ২-১ বার হলে তা স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করা হয়।
মেনোরেজিয়া হলে নারীর অতিরিক্ত রক্তপাত হয় এবং রক্ত জমাট বেঁধে যায়। এর ফলে দিনে ২-৩ বার ক্ষেত্র এমনকি ৪ বার বা তারও অধিক বার প্যাড বদলাতে হয়। আবার ক্ষেত্র বিশেষে প্রতি ঘন্টায় ১ বা ২ বারও স্যানিটারি প্যাড পরিবর্তন করতে হতে পারে। হরমোন পরিবর্তনের মত বেশ কিছু কারণে এই সময় অতিরিক্ত রক্তপাত হতে পারে। আর এই অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে এই রোগে আক্রান্ত নারীর রক্ত স্বল্পতা, ক্লান্তিভাব, শরীর ফ্যাকাসে হওয়া, দুর্বলতা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।

মেনোরেজিয়ার কারণঃ

মেনোরেজিয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। আর অনেকগুলো কারণের মধ্যে প্রধাণ ২টি কারণ হচ্ছে জরায়ু জনিত এবং হরমোন সংক্রান্ত সমস্যা।
এই দুইটি কারণ ছাড়াও অন্যান্য কারণগুলো হচ্ছে-
★ এমন জরায়ু টিউমার, যার সাথে ক্যান্সারের কোনো যোগ নেই,
★ জরায়ু বা সার্ভিকাল ক্যান্সার,
★ অনুপযুক্ত রক্তপাত,
★ অনুপযুক্ত গর্ভনিরোধক,
★ লিভার, কিডনি বা থাইরয়েড জনিত সমস্যা,
★ সন্তান জন্মদান,
★ অ্যাসপারিন জাতীয় ঔষধ সেবন করা,
★ গর্ভাশয়ের পেশিতে ফাইব্রয়েড বা পলিপ বা উভয়ের উপস্থিতি,
★ গর্ভাবস্থা সম্পর্কিত সমস্যা– একটোপিক প্রেগন্যান্সি বা গর্ভপাত অথবা কোনো কারণে নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর বাহিরে প্রতিস্থাপিত হলে,
★ পেলভিক অংশে কোনো রোগ (প্রজনন তন্ত্রে সংক্রমণ),
★ পেরিমেনোপজ অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই মেনোপজ বা পিরিয়ড হওয়া।

লক্ষণ ও উপসর্গঃ

মেনোরেজিয়ায় আক্রান্ত হলে রোগীর মাঝে বেশ কিছু লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যায়। আর সেগুলো হচ্ছে–
১. অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে বারবার স্যানিটারি প্যাড পরিবর্তন করতে হয়। অনেক সময় প্রতিঘন্টায় ১টি বা তার থেকে বেশি প্যাড পরিবর্তন করতে হয়।
২. পিরিয়ডের সময় জমাট বাঁধা রক্ত বের হওয়া।
৩. সাত দিনের বেশি পিরিয়ড স্থায়ী হওয়া।
৪. ব্লিডিং বা রক্তপাতের কারণে সাধারণ কাজকর্ম করতে সমস্যা হওয়া বা কাজ করতে না পারা।
৫. কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া,
৭. ক্রমাগত তলপেটে ব্যথা হওয়া,
৮. শ্বাসকষ্ট এবং ক্লান্তিভাব।

মেনোরেজিয়ার কষ্ট কমানোর উপায়ঃ

মেনোরিজিয়ার ব্যথা ও কষ্ট কমানোর বেশ কিছু উপায় আছে। এই পোস্টে কষ্ট কমানো যায় এমন ৫টি উপায় সম্পর্কে আলোচনা করবো।

১. হিটিং প্যাড আছে কোল্ড থেরাপিঃ
পিরিয়ডের সময় হিডিং প্যাড ব্যথা কমাতে বেশ কার্যকর। হিটিং প্যাডের উষ্ণতা পেশীর জন্য বেশ আরামদায়ক। এই প্যাড রক্ত চলাচল বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং তলপেটের ব্যথা কমিয়ে থাকে। আবার কোল্ড থেরাপিও একইভাবে কাজ করে থাকে। তবে কোল্ড কম্প্রেসার পেশীর টান বা ব্যথা কমাতে প্রয়োগ করা হয়। মেনোরেজিয়ায় আক্রান্ত নারীর শরীরের অবস্থা অনুযায়ী হিটিং প্যাড বা কোল্ড থেরাপি যেটি প্রয়োজন প্রয়োগ করতে পারে।

২. কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম নেওয়া:
পিরিয়ডের সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম শরীর ও মন উভয়ের জন্যই আরামদায়ক। পর্যাপ্ত বিশ্রাম রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে এবং পেশীকে রিল্যাক্স করে।

৩. মেন্সট্রুয়াল কাপঃ
মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্লিডিং-এর পরিমাণ কমায় না। তবে এটি বারবার বাথরুমে যাওয়া থেকে বাঁচায়। এই কাপ সিলিকন দিয়ে তৈরি করা হয়। এই মেন্সট্রুয়াল কাপকে যোনিপথে প্রবেশ করালে এর মধে পিরিয়ডের রক্ত জমা হতে থাকে। ট্যাম্পুন বা প্যাড ব্যবহারে অনেকেরই অস্বস্তি হয়। তবে এই কাপ ব্যবহারে কোনো রকম ব্যথা হয় না। যোনিতে এটি খুব সহজেই ফিট হয়ে যায়। মেন্সট্রুয়াল কাপ যোনির জন্য অনুকূল এবং এটি যোনির আর্দ্রতা স্বাভাবিক রাখে। এর ফলে অস্বস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এই কাপ একটানা ১২ ঘন্টা ব্যবহার করা যায়। এই কাপে কোনো ধরণের লিকেজ হয় না। আর এই কাপ প্যাডের মতই কার্যকর। অনেকের ক্ষেত্রে মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ কষ্টকর হতে পারে। এটি ভালোভাবে পরিষ্কার করে আবার ব্যবহার করা যায়। তবে এই কাপ ভালোভাবে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত না করে ব্যবহার করলে ইনফেকশন, টিউমার এমনকি ক্যান্সার জনিত সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে।
এই কাপ ব্যবহারে কোন রকম অস্বস্তি না হওয়ায় মহিলারা সব ধরণের কাজ করতে পারে। মনে রাখতে হবে পিরিয়ডের সময় ভারী কাজ বা পেটে আঘাত লাগে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।

৪. ব্যায়াম ও খাবারঃ
পিরিয়ডের ফলে দেহে রক্তের পরিমাণ কমে যায়। পিরিয়ডের পরে ভিটামিন ডি এবং আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে এগুলো রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পিরিয়ডের সময় ক্যামোমিল চা পান করলে পিরিয়ডের ব্যথা অনেকটা কমে যায়। আবার মাছ থেকে পাওয়া ওমেগা-3 ফ্যাটি এসিড পিরিয়ডের সময় প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। সামুদ্রিক মাছে বেশি মাত্রায় ওমেগা-3 পাওয়া যায়। আবার দেশি কিছু মাছেও পর্যাপ্ত ওমেগা-3 রয়েছে। যার মধ্যে পাঙ্গাশ, বোয়াল, চিতল, তেলাপিয়া, শিং মাছ, মাগুর মাছ ইত্যাদি উল্লেখ্যযোগ্য। সামুদ্রিক মাছে এলার্জি থাকলে সামুদ্রিক মাছ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এই এলার্জি মারাত্মক বিপদজনক এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
যোগব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি রক্ত প্রবাহকেও নিয়ন্ত্রণ করে এই ব্যায়াম। ব্যায়াম করার ফলে এন্ডোরফিনের মত ভালো হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোনগুলো পিরিয়ডের সময় পেশীর ব্যথা কমাতে সাহায্য করে এবং মানুষকে আরাম প্রদান করে।

নির্ণয় পদ্ধতিঃ

মেনোরেজিয়া রোগটি নির্ণয় করার জন্য নিন্মলিখিত টেস্টগুলো করার পরামর্শ দেওয়া হয়ঃ

★ পেলভিক টেস্টঃ
থাইরয়েড ও রক্তে লৌহের পরিমাণ (এনিমিয়ার জন্য) ঠিক আছে কি না এবং রক্ত জমাট বাঁধছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য রক্ত পরিক্ষা করতে হবে।

★ এন্ডোমেট্রিয়াল বায়োপসিঃ
এন্ডোমেট্রিয়াল বায়োপসির মাধ্যমে জরায়ুতে ক্যান্সার, টিউমার বা কোনো প্রকার অস্বাভাবিকতা আছে কিনা তা দেখা যাবে।

★ প্যাপ টেস্টঃ
শ্রোণীদেশ বা জরায়ুর কোষ স্ক্যান করে কোনো প্রকার অস্বাভাবিকতা আছে কিনা তা নির্ণয় করতে এই টেস্ট করতে দেওয়া হয়।

★ আল্ট্রাসনোগ্রামঃ
শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা, রক্ত প্রবাহ এবং দেহের কলাগুলো স্বাভাবিক পর্যায়ে আছে কিনা সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে দেওয়া হয়।

★ হিস্টিরোস্কপিঃ
কোনো প্রকার ফাইব্রয়েড, পলিপ বা এ ধরণের কিছু আছে কিনা দেখার জন্য এই টেস্ট করতে দেওয়া হয়।

★ সোনোহাইস্টেরোগ্রামঃ
জরায়ুতে কোনো সমস্যা আছে কিনা তা জানা যায় এই টেস্টের মাধ্যমে।

★ ডিলেশন এবং কিউরেটাজ (D&C):
এটি কম্বো ট্রিটমেন্ট। এর মাধ্যমে একত্রে পরীক্ষা এবং রক্তপাত নিয়ন্ত্রণের চিকিৎসা করা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে তার জরায়ু আস্তরণকে বাহিরে বের করে আনা হয়, এবং জরায়ুর পরীক্ষা করা হয়।

মেনোরেজিয়ার চিকিৎসাঃ

★ আয়রন সাপ্লিমেন্টঃ
আয়রন সাপ্লিমেন্ট দেহে লৌহের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। যার ফলে রোগী এনেমিয়া বা রক্ত স্বল্পতায় ভোগে না।

★ আইবুপ্রোফেনঃ
আইবুপ্রোফেন ব্যথা কমানো এবং রক্তপাত নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

★ অ্যান্টিফাইব্রিনোলাইটিক ঔষধঃ
এ জাতীয় ঔষধ রক্তপাত বন্ধ এবং পেশী শিথিল করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি ব্যথা কমাতে কাজ করে।

★ ইন্ট্রাইউটেরাইন কন্ট্রাসেপশন (I.U.D):
এই পদ্ধতি পিরিয়ড নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্ত ক্ষরণ কমানোর কাজ করে।

★ জন্মনিয়ন্ত্রণঃ
অনিয়মিত পিরিয়ড ঠিক করার জন্য জন্মনিরোধক ব্যবস্থা, ঔষধ, যোনির রিং অথবা প্যাচের মাধ্যমে রক্তপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

★ ডেসমোপ্রেসিন ন্যাসাল স্প্রেঃ
নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে রক্তপাতের সমস্যা থাকলে ডেসমোপ্রেসিন ন্যাসাল স্প্রে ব্যবহার করে রক্তপাত কমানো হয়ে থাকে।

★ অপারেটিভ হিস্টিরিওস্কপিঃ
অপারেটিভ হিস্টিরিওস্কপির মাধ্যমে ফাইব্রয়েড, পলিপ এবং আস্তরণকে কেটে বাদ দেওয়া হয়।

★ হরমোন থেরাপিঃ
হরমোন থেরাপি রক্তপাত কমানোয় কার্যকর ভূমিকা রাখে।

★ ব্লাড ট্রান্সফিউশনঃ

রোগীর অতিরিক্ত রক্তপাত হলে এবং রক্ত স্বল্পতা দেখা দিলে ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে রক্তপাত বন্ধ ও রক্তস্বল্পতা দূর করা হয়।

★ এন্ডোমেট্রিয়াল অ্যাব্লেশন বা রিসেকশনঃ
রোগীর জরায়ুর অবস্থা বিবেচনা করে এই পদ্ধতির মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ জরায়ুর আস্তরণ বাদ দেওয়া হয়।

★ হিস্টেরেক্টমিঃ
হিস্টেরেক্টমি হচ্ছে এক প্রকার অপারেশন। এই অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ুকে কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এই অপারেশনের ফলে চিরস্থায়ী মেনোপজ বা চিরস্থায়ী পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়। এবং নারী সন্তান গর্ভধারণের ক্ষমতা হারায়।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যঃ

★ মূলত ৭ দিনের বেশি পিরিয়ড হওয়া এবং এরপর অতিরিক্ত রক্তপার হলে একে মেনোরেজিয়া বলা হয়। মেনোরেজিয়া কতদিন চলতে থাকবে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। মূলত রোগীর শারীরিক অবস্থার উপর এর সময়কাল নির্ভর করে।
★ সকল প্রকার সতর্কতা অবলম্বন করার পরেও যদি ব্লিডিং বন্ধ না হয় এবং উপসর্গগুলো ক্রমাগত দেখা দিতে থাকে, তাহলে দেরি না করে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হওয়া জরুরী। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ এবং অতিরিক্ত বিলম্ব রোগীকে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন এমনকি রক্তশূন্য করে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে ডাক্তার রোগীর মানসিক চাপ, পিরিয়ডের সময় রোগীর জীবনযাত্রা, ওজন সংক্রান্ত সমস্যা, অন্তর্নিহির রোগ (যদি থাকে) ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তথ্য সংগ্রহ করবে। যদি এই বিষয়গুলো রোগের কারণ বা রোগের উপর প্রভাব বিস্তার করলে এসব তথ্য রোগের কারণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

আরও পড়ুনঃ পিরিয়ডের সময় যে খাবারগুলো খাওয়া যাবে না।

2 thoughts on “মেনোরেজিয়াঃ কারণ, উপসর্গ, চিকিৎসা এবং পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর উপায়”

  1. Pingback: প্যানিক অ্যাটাক কি? - রক্ত বন্ধন - Rokto Bondhon

  2. Pingback: সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত নয় তো আপনি - রক্ত বন্ধন - Rokto Bondhon

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *