মারবার্গ ভাইরাস ডিজিজ (MVD), যা পূর্বে মারবার্গ হেমোরেজিক ফিভার নামে পরিচিতি ছিল। এই রোগটি মানুষের জন্য মারাত্মক এবং গুরুত্বর একটি রোগ। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর হার প্রায় ৫০%। অর্থাৎ এই রোগে আক্রান্ত প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৫০ জনই মারা যায়। ভাইরাসের স্ট্রেন এবং কেস ম্যানেজমেন্টের উপর নির্ভর করে জানা যায় অতীতের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে এই মৃত্যুর হার ২৪% থেকে ৮৮% পর্যন্তও দেখা গেছে।
রিহাইড্রেশনের সাথে প্রারম্ভিক সহায়ক যত্ন এবং অতি যত্ন সহকারে চিকিৎসা করলে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই ভাইরাসটিকে ভাইরাসকে নিরপেক্ষ বা নিষ্ক্রিয় করার জন্য এখন পর্যন্ত অনুমোদিত কোনো চিকিৎসা আবিষ্কার করা যায় নি। তবে রক্তের উপাদান, ইমিউন থেরাপি এবং ড্রাগ থেরাপির একটি প্রচেষ্টা চলছে।
এই ভাইরাসটির জন্য Rousettus Aegyptiacus এবং Ptreopodidae পরিবারের বাদুরকে মূল কারণ বা বাহক বলে বিবেচনা করা হয়। পাশাপাশি দায়ী করা হয় অবৈধ, অনিয়ন্ত্রিত এবং একাধিক ব্যক্তির সাথে যৌন মিলনকে। এই ধরণের বাদুর ফলে কামড় দিলে বা ফলে লালা লাগালে সেই ফল যদি কোনো মানুষ খায় বা স্পর্শ করে তাহলে সেখান থেকে মানুষের দেহে এবং সেই মানুষ থেকে অন্য মানুষের মাঝে সংক্রমণ ছড়াতে থাকে।
মারবার্গের ইতিহাসঃ
মারবার্গ ভাইরাস প্রথমিকভাবে ১৯৬৭ সালে জার্মানির মারবার্গ, ফ্রাঙ্কফুর্টে এবং সার্বিয়ার বেলগ্রেডে একই সময়ে শনাক্ত করা হয়েছিল। মারবার্গ এবং ইবোলা ভাইরাস উভয়ই Filoviridae পরিবারের সদস্য (Filovirus)। যদিও বিভিন্ন ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট দুইটি রোগ চিকিৎসাগতভাবে একই রকম। উভয় রোগই বিরল এবং উভয় রোগেই প্রাদুর্ভাব ঘটাতে সক্ষম। এর এই দুই রোগেই মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
সর্বপ্রথম উগান্ডা থেকে আমদানি করা আফ্রিকান সবুজ বানরকে (সারকোপিথেকাস এথিওপস) ল্যাবে পরীক্ষা করার মাধ্যমে ভাইরাসটি আবিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে অ্যাঙ্গোলা, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো, কেনিয়া এবং আফ্রিকা (জিম্বাবুয়ে)-তে ভ্রমণকারী একজন ব্যক্তির শরীরে সনাক্ত করা হয়। পাশাপাশি উগান্ডায় প্রাদুর্ভাব এবং বিক্ষিপ্ত ঘটনাগুলোর রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করে ভাইরাসটিকে নির্ণয় করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে উগান্ডার রুসেটাস বাদুড় উপনিবেশ দ্বারা অধ্যুষিত একটি গুহা পরিদর্শনকারী কিছু ভ্রমণকারীদের অসুস্থতার দুইটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে এই রোগটি ছড়িয়েছে বা সংক্রমিত বলে রিপোর্ট করা হয়।
সংক্রমণ কিভাবে হয়ঃ
প্রাথমিকভাবে রুসেটাস বাদুড় দ্বারা অধ্যুষিত খনি বা গুহাগুলো এক্সপোজ করার জন্য জন্য যারা পরিদর্শন করেছেন তাদের মাধ্যমে মানব দেহে মারবার্গ ভাইরাস MVD সংক্রমণ ছড়ায়। এই ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। আবার কাটা চামড়া বা শ্লেষ্মার মাধ্যমে, সংক্রমিত মানুষের রক্ত, নিঃসরণ, অঙ্গ বা অন্যান্য শারীরিক তরল (বীর্য, মাসিকের রক্ত ইত্যাদি) এবং এই তরলগুলোর দ্বারা দূষিত উপকরণ ( বিছানাপত্র, পোশাক, টাওয়েল, ব্যবহৃত টিস্যু, প্যাড ইত্যাদি) দ্বারাও ছড়িয়ে পড়তে পারে। সন্দেহভাজন বা নিশ্চিত এমভিডি (MVD) রোগীদের চিকিৎসা করার সময় ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য কর্মীরা একাধিকবার সংক্রমিত হয়েছেন। রোগীদের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগের মাধ্যমেও এই সংক্রমণটি ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা পাওয়া যায়। দূষিত ইঞ্জেকশন সরঞ্জামের মাধ্যমে বা সুঁই-লাঠির আঘাতের মাধ্যমে এই রোগটি আরও মারাত্মক এবং গুরুত্বরভাবে আক্রান্ত হয়ে থাকে। দ্রুত রোগের অবনতি, আক্রান্তের সম্ভাবনা বৃদ্ধি এবং মৃত্যুর হার উচ্চতর হওয়ার জন্য দায়ী এই দূষিত ইঞ্জেকশন। মনে রাখতে হবে আক্রান্ত ব্যক্তিএ রক্তে যতক্ষণ পর্যন্ত মারবার্গ ভাইরাস থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই ভাইরাসটি সংক্রমণ ছড়াতে থাকে।
এছাড়া এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে এমন দেহের সাথে সড়াসরি জড়িত কাপড়, চাদর, কাফন এবং দাফন অনুষ্ঠানে থাকা অন্যান্য পদার্থের সংস্পর্শে আসলেও মারবার্গ রোগটি সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
মারবার্গের লক্ষণঃ
মারবার্গ ভাইরাসের ইনকিউবেশন সময়কাল (সংক্রমণ থেকে উপসর্গের সূত্রপাত পর্যন্ত ব্যবহার) ২ থেকে ২১ দিনের মধ্যে পরিবর্তিত হয়। এই ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট অসুস্থতা হঠাৎ করে শুরু হয়। তীব্র জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা এবং গুরুত্বর অসুস্থতা এই রোগের প্রধান লক্ষণ। পাশাপাশি পেশী ব্যথা এবং যে কোনো স্থানে ব্যথা করা রোগটির সাধারণ বৈশিষ্ট। এসব লক্ষণ দেখা দেওয়ার ৩য় দিনে গুরুত্বর পানিযুক্ত ডায়রিয়া, পেট ব্যথা এবং ক্রাম্পিং বা পেটে টান ধরা, বমিবমি ভাব এবং বমি শুরু হতে পারে। ডায়রিয়া এক সপ্তাহ যাবৎ চলতে পারে। এই পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তির চেহারাকে “ভূতের মত” আঁকাবাঁকা বৈশিষ্ট, চোখ ভিতরে ঢুকে যাওয়া, ভাবহীন মুখ এবং পাশাপাশি চেহারায় চরম অলসতার ভাব ফুটে উঠতে পারে। ১৯৬৭ সালে ইউরোপীয় অঞ্চলের প্রাদুর্ভাবে চুলকানি বিহীন ফুসকুড়ি লক্ষণ দেখা যায়। এবং চুলকানি বিহীন ফুসকুড়ি লক্ষণ দেখা দেওয়ার ২ থেকে ৭ দিনের মধ্যে বেশিরভাগ রোগীর মধ্যে মারবার্গ ভাইরাসের লক্ষণ ফুটে উঠেছিল।
মারবার্গে আক্রান্ত অনেক রোগীর ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে গুরুত্বর রক্তক্ষরণ হতে পারে। আবার রোগটি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছালে প্রায়শই রোগীর একাধিক স্থান থেকে এই রক্তপাত হতে পারে। এই রক্তক্ষণের পাশাপাশি বমি এবং মলের সাথেও রক্ত আসতে পারে। আবার প্রায়ই নাক, মাড়ি এবং যোনি থেকেও রোগীর রক্তপাত হতে থাকে। ভেনেপাংচার সাইটগুলোতে (যে সকল ভেন বা শিরায় ইঞ্জেকশন, ক্যানোলা ইত্যাদি প্রবেশ করানো হয়) স্বতঃস্ফূর্ত রক্তপাত এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা দেখা দিতে পারে। অসুয়াথতার গুরুত্বর পর্যায়ে রোগীদের তীব্রতর জ্বর বজায় থাকে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বিভ্রান্তি, বিরক্তি এবং দ্রুত ও অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে। অর্কাইটিস (এক বা উভয় অন্ডকোষে প্রদাহ) মারবার্গ ভাইরাস রোগের শেষ পর্যায়ে (১৫ দিন পরে) কিছু কিছু রোগীর মাঝে দেখা যায়।
ভাইরাসটি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছালে প্রায়শই লক্ষণ শুরু হওয়ার ৮ থেকে ৯ দিনের মাঝে রোগীকে মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায়। সাধারণত গুরুত্বর রক্তক্ষরণ এবং রোগী শকে চলে যাওয়া, এই দুইটি জিনিস মৃত্যুর আগে ঘটতে দেখা যায়।
আরও পড়ুনঃ মারবার্গ ভাইরাসে করণীয় কি?
রোগ নির্ণয়ঃ
চিকিৎসাগত দিক দিয়ে ম্যালেরিয়া, টায়ফয়েড, মেনিনজাইটিস, শিগেলোসিসসহ অন্যান্য ভাইরাল হেমোরেজিক জ্বরের মতো অন্যান্য সংক্রামক রোগ থেকে মারবার্গ ভাইরাস রোগকে (MVD) আলাদা করা কঠিন। যে লক্ষণগুলো মারবার্গ ভাইরাসের সন্দেহ সৃষ্টি করে সে লক্ষণগুলো রোগীর মাঝে দেখা গেলে এবং ভ্রমণ ইতিহাস জেনে ল্যাবে কিছু পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। পরীক্ষাগুলো হচ্ছে-
★ এন্টিবডি-ক্যাপচার এনজাইম-লিঙ্কড ইমিউনোসরবেন্ট অ্যাস (ELISA)।
★ এন্টিজেন-ক্যাপচার সনাক্তকরণ পরীক্ষা,
★ সিরাম নিরেপেক্ষ করণ পরীক্ষা,
★ রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (RT-PCR),
★ কোষ সংস্কৃতি দ্বারা ভাইরাস বিচ্ছিন্নতা, এবং
★ ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপি।
যেহেতু এই ভাইরাসটি সংক্রমণ ছড়ায়, তাই রোগীদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহের সময় সংগ্রহকারীকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নমুনাগুলো পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করার সময়ও সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে নমুনা পরিবহন করার সময় সমস্ত নমুনা ট্রিপল প্যাকেজিং সিস্টেম ব্যবহার করে প্যাকেজ করা উচিত।
মারবার্গ ভাইরাসের চিকিৎসা এবং অন্যান্য তথ্য সম্পর্কে আরও জানতে পারবেন পরবর্তী পোস্টে।