মারবার্গ ভাইরাসে সচেতনতা, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের উপায়

চিকিৎসা ও ভ্যাক্সিনঃ

এখন পর্যন্ত মারবার্গ ভাইরাসের (MVD) এর জন্য কোনো অনুমোদিত ভ্যাক্সিন বা ইন্টিভাইরাল চিকিৎসা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তবে সহায়ক যত্ন, মৌখিক বা শিরায় স্যালাইন বা লিকুইড মেডিসিন প্রবেশ করিয়ে রিহাইড্রেশন এবং প্রকাশ পাওয়া নির্দিষ্ট লক্ষণগুলো নির্ণয় করে সেই সকল লক্ষণের চিকিৎসা করা হলে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পাশাপাশি ভাইরাসের বিকাশ রোধ করতে মনোক্লোনাল এন্টিবডি (এমএবিএস) রয়েছে এবং এন্টিভাইরাল যেমন- Remdesivir এবং Favipiravir যেগুলো ইবোলা ভাইরাস ডিজিজ (EVD) এর জন্য ক্লিনিকাল স্টাডিতে ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো মারবার্গ ভাইরাস ডিজিজ (MVD) এর জন্যও পরীক্ষা করা যেতে পারে। অথবা সহানুমূতিশীল ব্যবহার/প্রসারিত এক্সেসের অধীনে ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ ইবোলা এবং মারবার্গ ভাইরাসের উপাদানগুলো অনেকটা একই ধরণের।

২০২০ সালের মে মাসে EMA Zabdeno (Ad26.ZEBOV) এবং Mvabea (MVA-BN-Filo) এন্টিভাইরাসকে ইবোলা ভাইরাস রোগে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে প্রয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এমভাবিয়ারে ভ্যাচিনিয়া আস্কারা বাভারিয়ান নর্ডিক (MVN) নামে পরিচিত একটি ভাইরাস রয়েছে, যা জায়ার ইবোপাবভাইরাস এবং একই গ্রুপের (ফিলোভিরিডে) অন্য তিনটি ভাইরাস থেকে ৪টি প্রোটিন উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে।ভ্যাক্সিনটি সম্ভাব্যভাবে মারবার্গ ভাইরাস ডিজিজের বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে। তবে ক্লিনিকাল ট্রায়েলে এই ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়নি বা কাজ করবে কি না তা জানানো হয়নি।

প্রাণিদের মধ্যে মারবার্গ ভাইরাসঃ

Rousettus Aegyptiacus বাদুড়কে মারবার্গ ভাইরাসের প্রাকৃতিক হোস্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলের বাদুড়ের আপাত রোগ নেই। মারবার্গ ভাইরাসের ভৌগলিক বন্টন বা ছড়িয়ে যাওয়া রুসেটাস বাদুড়ের পরিসরের সাথে ওভারল্যাপ হতে পারে। রুসেটাস বাদুড়কে প্রাকৃতিক হোস্ট হিসেবে বিবেচনা করা হলেও সর্বপ্রথম এই ভাইরাসটি মানুষের মাঝে সংক্রমণের উৎস ছিল উগান্ডা থেকে আমদানি করা আফ্রিকান সবুজ বানর সারকোপিথেকাস এথিওপস।
এছাড়াও ইবোলা ভাইরাসসহ শূকরদের পরীক্ষামূলক ইনোকুলেশন রিপোর্টের মাধ্যমে জানা যায় শূকরগুলো ফিলোভাইরাস সংক্রমণের জন্য সংবেদনশীল। এবং শূকরের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং মারবার্গ ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময় ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পিছনে শূকরকে পরিবর্ধক হোস্ট হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
কোনো গৃহপালিত প্রাণীর ফিলোভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সাথে সম্পর্ক রয়েছে বলে কোনো গবেষণার মাধ্যমে এখনো প্রমানিত হয়নি। তবে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে থাকলে সতর্কতার জন্য গৃহপালিত প্রাণীদেরও সম্ভাব্য পরিবর্ধক হোস্ট হিসেবে বিবেচনা করতে হতে পারে।

বাদুড়ের সংস্পর্শে বা বাদুড়ে কামড় দেওয়া ফলের সংস্পর্শের মাধ্যমে শূকরের সংক্রমণ এড়াতে আফ্রিকাসহ যে সকল দেশে এই ভাইরাস পাওয়া গেছে সেই সকল দেশের শূকরের খামারগুলোতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। এই ধরণের সংক্রমণ সম্ভাব্যভাবে ভাইরাসকে প্রসারিত বা পরিবর্তন করতে পারে। এবং MVD প্রাদুর্ভাবের কারণ বা ছড়ানোয় অবদান রাখতে পারে।

প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণঃ

ভালোভাবে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করতে বিভিন্ন হস্তক্ষেপ এবং প্রয়োগ খুবই জরুরী। এসব হস্তক্ষেপের মধ্যে রয়েছে কেস ম্যানেজমেন্ট, নজরদারি এবং যোগাযোগের সন্ধান, একটি ভালো পরীক্ষাগার এবং উচ্চ নিরাপত্তা, উন্নত পরিসেবা, নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ দাফন এবং সামাজিক সংহতি। সফলভাবে প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা অন্যতম চাবিকাঠি। মারবার্গ সংক্রমণের ঝুঁকির কারণ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং ব্যক্তিগত এবং পারিবারিকভাবে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সংক্রমণ কমানোর কার্যকর একটি উপায় হতে পারে। পাশাপাশি ঝুঁকি হ্রাস করে এমন বিভিন্ন পদক্ষেপের উপর ফোকাস করা উচিত। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে-

১. ফলের বাদুড় উপনিবেশে বসবাসকারী খনি বা গুহাগুলোতে দীর্ঘায়িত এক্সপোজার হওয়া উদ্ভূত বাদুড় থেকে মানুষে সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করা।
২. কাজ বা গবেষণা কার্যক্রম বা ফ্রুটস ব্যাট কলোনি দ্বারা বসবাসকারী খনি বা গুহায় পর্যটক পরিদর্শনের সময় মানুষদের গ্লাভস, পিপিই, মাস্ক পরিধান করা উচিত। এবং পরিদর্শন শেষে এগুলো পুড়িয়ে ফেলা উচিত।
৩. প্রাদুর্ভাবের সময় সমস্ত প্রানীজ পণ্য (রক্ত, মাংস, ভুড়ি, পা ইত্যাদি) খাওয়ার আগে ভালোভাবে পরিষ্কার করা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রান্না করা উচিত। মাংস বা অন্য কিছু পরিষ্কার বা ধুয়ার সময় মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহার করা জরুরী।
৪. সংক্রামিত রোগীদের বিশেষ করে তাদের শরীরের তরলগুলোর (রক্ত, পুঁজ, মলমূত্র, বীর্য ইত্যাদি) সাথে সরাসরি বা ঘনিষ্ট যোগাযোগ থেকে উদ্ভূত সম্প্রদায়ে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করতে হবে। টিস্যু, কাপড়, স্যালাইন সেট, কনডম ইত্যাদি পুড়িয়ে ফেলতে হবে বা লোকজনের চলাচল নেই এমন স্থানের মাটির নিচে ভালোভাবে পুঁতে ফেলতে হবে।
৫. মারবার্গ ভাইরাসে আক্রান্ত অবস্থায় রোগীদের সাথে ঘনিষ্ট শারীরিক সম্পর্ক এড়িয়ে চলতে হবে। দুইবার নেগেটিভ না আসা পর্যন্ত শারীরিক সম্পর্ক স্থাপণ করা যাবে না। রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পারেও অন্তত এক বছর শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত নয়। বা দুইবার নেগেটিভ আসার পরে এক বছর শারীরিক সম্পর্ক স্থাপণ করার সময় প্রটেকশন ব্যবহার করা জরুরী।
৬. বাড়িতে অসুস্থ রোগীদের যত্ন নেওয়ার সময় গ্লাভস, পিপিই এবং মাস্ক পরিধান করা বাধ্যতামূলক।
৭. হাসপাতালে বা বাসায় অসুস্থ আত্মীয়দের সাথে দেখা করার পরে বা যত্ন নেওয়ার পরে নিয়মিত হ্যান্ড ওয়াশ, স্যানিটাইজার ইত্যাদি দিয়ে হাত ধোয়াটা খুবই জরুরী।
৮. যে সকল এলাকায় মারবার্গ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে সেই সকল এলাকার সম্প্রদায়কে চিহ্নিত এবং রোগ নিশ্চিত করার চেষ্টা করা উচিত। পাশাপাশি সেই সকল এলাকার জনগণ মারবার্গ ভাইরাস সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত রয়েছে এবং প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে কি কি ব্যবস্থা নিতে হবে সেই বিষয়ে অবগত আছে কি না সেই বিষয়টি নিশ্চিত হতে হবে।
৯. মারবার্গে কারও মৃত্যু হলে মৃত ব্যক্তির তাৎক্ষনিক, নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ দাফন সম্পন্ন করতে হবে। পাশাপাশি মৃত ব্যক্তির পরিবার, হাসপাতালে থাকা পরিবারের সদস্য, সেবাদানকারী নার্স, ডাক্তার, স্টাফ মারবার্গে সংক্রমিত কারও সংস্পর্শে থাকতে পারে এমন ব্যক্তিদের শনাক্ত করে ২১ দিন তাদের আলাদা রেখে স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
১০. রোগের বিস্তার রোধ করার জন্য সুস্থ ব্যক্তিদের অসুস্থ রোগীদের থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে এবং রোগীদের যত্ন শুরু করতে হবে। রোগী এবং সুস্থ ব্যক্তি উভয়কেই স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে হবে এবং পরিষ্কার পরিবেশ পালন করাটাও খুব জরুরী।
১১. সম্ভাব্য যৌন সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করতে হবে। চলমান গবেষণার বিশ্নেষনের উপর ভিত্তি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সুপারিশ করে, মারবার্গ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরে বেঁচে যাওয়া পুরুষগণ উপসর্গের সূত্রপাত থেকে ১২ মাস বা তাদের বীর্যের রিপোর্ট দুইবার নেগেটিভ না হওয়া পর্যন্ত নিরাপদ যৌনতা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন করতে হবে। এই সময়ে ব্যবহৃত কনডমগুলো নিরাপত্তার জন্য পুড়িয়ে ফেলতে হবে। যেন সেমিনাল তরলের সংস্পর্শ রোধ করা যায়। আক্রান্ত মেয়েদের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
১২. শরীরের তরল যেমন- থুথু, লালা, কফ, সর্দি, বীর্য, মলমূত্র, রক্ত পুঁজ ইত্যাদির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। রোগীর ব্যবহৃত টিস্যু, কাপড় ইত্যাদি পুড়িয়ে ফেলতে হবে। পাশাপাশি রোগী এবং রোগীর সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিদের বারবার সাবান এবং পানি দিয়ে হাত ধুয়া উচিত।

মনে রাখবেন, রোগ আল্লাহ প্রদত্ত। কারও নিজ ইচ্ছায় রোগাক্রান্ত হওয়ার ক্ষমতা নেই। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে সুস্থ হয়েছে এমন পুরুষ এবং মহিলাকে বিচ্ছিন্ন করার সুপারিশ করে না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। এই রোগে আক্রান্ত এবং আক্রান্ত হওয়ার পরে সুস্থ হওয়া প্রতিটি ব্যক্তি, তাদের পরিবার বা অংশীদারকে সম্মান, মর্যাদা এবং সমবেদনা দেখানো আপনার আমার দ্বায়িত্ব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *