ভ্যারিকোস ভেইন কি এবং কেন হয়ঃ
ভ্যারিকোস ভেইন হচ্ছে রক্তনালীর একটি রোগ। রক্ত চলাচলে বাঁধাগ্রস্ত হয়ে ত্বকের নীচে তৈরি হওয়া ফোলা ও প্যাঁচানো শিরাকে বলা হয় ভ্যারিকোস ভেইন। এই রোগ শরীরের যেকোন অংশে দেখা দিতে পারে। তবে, সাধারণত রোগীর পায়ে ভ্যারিকোস ভেইন বেশি দেখা যায়।
মানব দেহের পায়ের শিরাগুলো দুই সারিতে বিভক্ত। এই দুই সারির মাঝে থাকে সংযোগকারী আন্তঃশিরা। এই প্রতিটি শিরার রয়েছে একমুখী ভ্বালভ। অর্থাৎ, রক্ত কেবল এক দিকে ভ্রমণ করতে পারে। রক্ত প্রবাহকালে কোন কারণে যদি শিরার রক্ত নিয়ন্ত্রণকারী ভালভ ঠিকমতো কাজ না করে, অথবা গাত্রগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন রক্ত বাঁধা পেয়ে পিছনের দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে। তখন রক্ত হৃদপিণ্ডে পৌঁছানোর বদলে শিরাগুলোতে সঞ্চারিত হতে থাকে। ফলস্বরূপ, রক্তনালিগুলো ফুলে ওঠে,নীল বা বেগুনী বর্ণ ধারণ করে এবং বড় হয়ে যায়। শিরার এই পরিবর্তনকেই ‘ভ্যারিকোস ভেইন’ বলা হয়।
ভ্যারিকাস ভেইনের লক্ষণঃ
১) গাঢ় বেগুনী বা নীল রঙের শিরা দেখা যায়।
২) শিরাগুলির আকার বড় হয়ে ফুলে যায়।
৩) সারা শরীরে ব্যথা এবং অস্বস্তির অনুভূতি।
৪) ত্বকে ক্ষতর সৃষ্টি হয়।
৫) পায়ে অসহ্য ব্যথা অনুভব হওয়া।
৬) প্রায়ই পায়ের মাংসপেশীতে টান ধরা বা খিঁচুনি হওয়া।
৭) পায়ের পাতায় বা পায়ের ত্বকে ইনফেকশনের লক্ষণ দেখা দেয় এবং পায়ে শক্ত মাংস পিন্ড দেখা দেয়।
৮) পায়ের ত্বকের চারপাশে ফুসকুড়ি ও লালচে ভাব দেখা যেতে পারে।
৯) দীর্ঘক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকার পরে মাত্রাতিরিক্ত ব্যথা অনুভব হওয়া।
ভ্যারিকোস ভেইনে আক্রান্তে ঝুঁকির কারণঃ
বেশ কিছু কারণে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কারণগুলো –
১) বার্ধক্যজনিত কারণঃ
বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ভ্যারিকোস ভেইনে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা দেয়। কারণ, বার্ধক্যজনিত কারণে শিরার ভালভ দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে রক্ত চলাচল বাঁধাগ্রস্ত হয়।
২) লিঙ্গঃ
মহিলাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্তের প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। গর্ভাবস্থায়, মাসিকের আগে বা মেনোপজের সময় মেয়েদের হরমোনের পরিবর্তন ঘটে। কারণ, মহিলাদের হরমোন শিরার প্রাচীরকে শিথিল করে দেয়। এছাড়াও, জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি সেবনের ফলে ভ্যারিকোস ভেইন হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
৩) পারিবারিক ইতিহাসঃ
যদি পরিবারের সদস্যদের ভ্যারিকোস ভেইন ছিল বা আছে এমনটা হয়ে থাকে। তবে আপনার এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
৪) স্থূলতাঃ
স্থূলত্ব বা অতিরিক্ত ওজনের কারণে শিরাগুলোতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। আর এর ফলে সৃষ্টি হতে পারে ভ্যারিকোস ভেইন।
৫) গর্ভাবস্থাঃ
যখন কোন মহিলা গর্ভবতী হোন, তখন দেহে রক্তের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর প্রভাবে গর্ভবতী মহিলার পায়ের শিরা ফুলে যেতে পারে।
৬) দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকাঃ
আপনি যদি দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন বা বসে থাকেন তবে রক্ত ভালভাবে প্রবাহিত হতে বাধাগ্রস্ত হয়। যার কারণে ভ্যারিকোস ভেইনের দেখা দিতে পারে।
রোগ নির্ণয়ঃ
এই রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে রোগের লক্ষণগুলোর উপর বিবেচনা করে টেস্ট দেওয়া হয়। চিকিৎসক প্রথমে শারীরিক পরীক্ষা এবং পা পরীক্ষা করে থাকেন। এরপর কয়েকটি ডায়াগনস্টিক টেস্টের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যার মধ্যে নিম্নলিখিত পরীক্ষা দুটি অন্তর্ভুক্ত থাকে –
১) ডপলার পরীক্ষাঃ
রোগীর রক্ত কীভাবে শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে তা পরীক্ষা করার জন্য একটি আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান করা হয়। শিরাতে রক্ত জমাট বাঁধা আছে কিনা তা নির্ণয়ের জন্যও এই পরীক্ষাটি করা হয়।
২) কালার ডুপ্লেক্স আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যানঃ
শিরায় কোন অস্বাভাবিকতা থাকলে তা খুঁজে পাওয়ার জন্য এই পরীক্ষাটি করা হয়। শিরায় কোন অস্বাভাবিকতা বা সমস্যা থাকলে উক্ত স্থানগুলো রঙিন আকারে দেখা যায়।
রোগটির চিকিৎসা না করালে কি সমস্যা হয়ঃ
১) ফুলে যাওয়া শিরার চারপাশে আলসার হতে পারে,
২) পায়ের ভিতরে শিরার গভীরতা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে,
৩) চলাফেরার ক্ষেত্রে সমস্যা বেড়ে যায়,
৪) ডায়াবেটিস রোগীদের এই রোগ থাকলে খুবই সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি পরবর্তীতে বড় ধরণের ইনফেকশন এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে,
৫) চিকিৎসা না করালে রক্তক্ষরণ বৃদ্ধি পেতে পারে।
৬) কিছু ক্ষেত্রে রোগীর পা,হাত,কোমড় ইত্যাদি স্থান অকেজো বা প্যারালাইজড হওয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে।
চিকিৎসাঃ
নিজের যত্ন নেওয়া এবং সংক্ষেপণ স্টকিংস হচ্ছে ভ্যারিকোস ভেইন-এর চিকিৎসা। যদি এই চিকিৎসায় রোগের অবস্থার উন্নতি না হয়, তাহলে চিকিৎসক নিম্নলিখিত বিকল্প চিকিৎসাগুলোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
★ স্কেলেরোথেরাপি (Sclerotherapy)
এটি একটি দ্রবণ পদ্ধতি। সাধারণত লবণের মাধ্যমে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়। এর মাধ্যমে সরাসরি শিরায় ইনজেকশনের পুশ করা হয়। এটি রক্তনালীকে নাড়া দেয় এবং রক্তকে স্বাস্থ্যকর শিরাগুলোর মাধ্যমে চলাচল করতে বাধ্য করে। দাগযুক্ত শিরাটি স্থানীয় টিস্যুতে পুনরায় সংশ্লেষিত হয়ে শেষে এটি ম্লান হয়ে যায়।
★ লেজারের চিকিৎসা (Laser treatment)
এই চিকিৎসা পদ্ধতি ছোট ভ্যারিকোস ভেইন বন্ধ করতে প্রয়োগ করা হয়। এবং এটি ধীরে ধীরে বিবর্ণ ও অদৃশ্য হয়ে যায়।
★ অ্যাম্বুলেটরি ফ্লেবেক্টোমি (Ambulatory phlebectomy)
এর মাধ্যমে ছোট ছোট শিরাগুলিকে ত্বকের পাংচারের মাধ্যমে নষ্ট করে ফেলা হয়।
★ ক্যাথেটার-সহায়তা পদ্ধতি (Catheter-assisted procedures)
পাতলা টিউব একটি বড় শিরাতে প্রবেশ করানো হয় এবং ক্যাথেটার টিপটি রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি বা লেজার এনার্জির মাধ্যমে উত্তপ্ত করা হয়। ক্যাথেটারটি বাহির করার সময় তাপের সাহায্যে শিরাটিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এর ফলে এটি ভেঙে যায়।
১) নিয়মিত শরীরচর্চা বা ব্যায়ামের অভ্যাস করুন। পায়ের রক্ত চলাচলকে স্বাভাবিক বা বৃদ্ধি করতে প্রতিদিন হাঁটতে হবে,
২) শরীরের ওজন কমাতে হবে এবং খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। কম লবণযুক্ত খাদ্য খাওয়ার অভ্যাস করুন,
৩) পা,কোমড়,হাত ও কুঁচকিতে অতিরিক্ত টাইট কিছু পরবেন না, যা রক্ত চলাচলে সমস্যা তৈরি কর,
৪) উঁচু হিলযুক্ত জুতা ও স্যান্ডেল পরিহার করুণ। সমান আকৃতির জুতা পড়তে হবে। যেন কাপ মাসলের ক্রিয়াশীলতা বৃদ্ধি পায়, এটি শিরার জন্য উপকারী,
৫) দীর্ঘ সময় একাধারে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকবেন না।
৬) বেশিক্ষণ পা ভাঁজ করে বসবেন না।
আসুন, সতর্ক থাকি। আমাদের মাঝে কারও এমন সমস্যা বা লক্ষণ দেখা দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে সুচিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থতা অর্জন করি।
আরও পড়ুনঃ পেশীতে টান ধরার কারণ ও প্রতিকার কি?