রিউম্যাটিক আর্থ্রাইটিস (Rheumatoid Arthritis):
রিউম্যাটিক আর্থ্রাইটিস এমন এক রোগ যা রোগীর হাঁটু, গোড়ালি, পিঠ, কব্জি বা ঘাড়ের জয়েন্টগুলিতে ব্যথা সৃষ্টি করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই রোগটি বয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়। তবে জীবনযাত্রার পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে অনেক যুবক যুবতীরাও এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস কেবলমাত্র জয়েন্টে ব্যথার মধ্যে সীমাবদ্ধ এমনটা নয়। যদি সময়মতো এই রোগের চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে এটি শরীরের জয়েন্ট এবং হাড়ের ক্ষতি সাধন করে। পাশাপাশি চোখ, ত্বক, ফুসফুসের মতো অন্যান্য অঙ্গকেও প্রভাবিত এমনকি নষ্ট পর্যন্ত করে দিতে সক্ষম।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ফলে জয়েন্টে ব্যথা, ফোলাভাব এবং পেশী শক্ত হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একটি স্ব-প্রতিরোধক রোগ। যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে স্বাস্থ্যকর কোষগুলোর ক্ষতি করতে শুরু করে।
আসুন আজ জেনে নেই রিউম্যাটয়েড বা রিউম্যাটিক
আর্থ্রাইটিসের লক্ষণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে।
আলোচনা শুরুর প্রথমেই একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে রাখুন,
বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করে, বৃদ্ধ বয়সে মানুষের বাতের সমস্যা দেখা যায়। বৃদ্ধ বয়সে বাতের যে ব্যথা হয় তাকে বলা হয় অস্টিও আর্থ্রাইটিস। কিন্তু রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস যে কোনও বয়সের মানুষেরই হতে পারে। এমনকি শিশুরাও আর্থ্রাইটিস রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যাকে বলা হয় জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস।
রিউম্যাটিক আর্থ্রাইটিস একটি অটো-ইমিউনো রোগ। এই রোগ একদিকে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করে শরীরে যে কোন ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। অন্যদিকে এই অটো-ইমিউনো রোগই শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং স্বাস্থ্যকর কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্থ করে দিতে থাকে ভিতরে ভিতরে। অর্থাৎ শরীরে অন্য ভাইরাস বা জীবাণুর অনুপ্রবেশ বন্ধ করে একাই রাজত্ব কায়েম করতে থাকে। ফলে দেহের বিভিন্ন অংশ এবং জয়েন্টগুলো অতিরিক্ত ফুলে যায় ও ব্যথা বা তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। যদি জয়েন্টে দীর্ঘক্ষণ ফোলা থাকে তবে তা জয়েন্টগুলোর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যা রোগীর জন্য খুবই বিপদজনক।
সকালে শরীরের যে কোন অংশের পেশী শক্ত হলে এটি হতে পারে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের কারণে। এই ফোলা এক থেকে দুই ঘন্টা স্থায়ী হয় এবং আক্রান্তের চলাচল অনুযায়ী আবার নিরাময় হয়। অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে শারীরিক দুর্বলতা, হালকা জ্বর, খিদে কমে যাওয়া, শুষ্ক মুখ- চোখ, শরীরে বিভিন্ন অংশে ফোলা ভাব ইত্যাদি। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্তের ঝুঁকি পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। একটি গবেষণা থেকে দেখা গেছে, আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭৫% রোগী মহিলা এবং তাদের বয়স ৩০-৫০ বছর।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে সনাক্তকরণের জন্য কোনো একক পরীক্ষা নেই। তবে রক্ত পরীক্ষা, জয়েন্ট এবং বিভিন্ন অঙ্গের পরীক্ষা এবং এক্স-রে বা আল্ট্রাসাউন্ডের সাহায্যে এই রোগটি নির্ণয় করা যায়। উচ্চ মাত্রার প্রদাহ শনাক্ত করার জন্য আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষা করা হয়। কিছু ভাইরাল সংক্রমণের কারণেও মানুষের শরীরে আর্থ্রাইটিসের মত লক্ষণ দেখা দিতে পারে। ফলে অনেকেই রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হয়েছে ভেবে ভুল করে থাকে। সুতরাং,বলা যায় এই রোগের সঠিক শনাক্তকরণের জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াই একমাত্র পথ।
এই রোগের চিকিৎসার জন্য সাধারণত একটি রোগ সংশোধনকারী অ্যান্টি-রিউম্যাটিক ড্রাগ (ডিএমএআরডি) দেওয়া হয়ে থাকে। এছাড়া, নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস (এনএসএআইডি) বা কম-ডোজ কর্টিকো-স্টেরয়েডগুলো ডিএমআরডি এর সাথে ব্যবহার করা যেতে পারে। ডিএমআরডি যদি রোগীর প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে একজন চিকিৎসক এই সম্পর্কিত ওষুধগুলো রোগীকে প্রেসক্রাইব করে থাকেন।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস চিকিৎসার লক্ষ্য ব্যথা বা প্রদাহের মতো সমস্যা হ্রাস করা। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যায় ভোগা থেকে মুক্তি দিয়ে এই রোগের প্রভাবে মৃত্যু রোধ করা। এক্ষেত্রে সকল রোগীর একই ধরণের চিকিৎসা কাজ করে না। অনেক রোগীর সমস্যা সমাধানে ডাক্তারের পরামর্শে তাঁদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও চিকিৎসা পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হয়।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের রোগমুক্তির কোন স্থায়ী সমাধান নেই। কারণ আক্রান্তের দেহে উচ্চ পরিমাণে ইউরিক অ্যাসিডের উপস্থিতি থাকে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ডায়েট সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতাও নেই। তবুও সুস্থতার জন্য অভিজ্ঞ ডায়েটেশিয়ানের পরামর্শ মেনে জীবন-যাপন করা যেতে পারে। এতে রোগ নিরাময় না হলেও ব্যথা থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের নিয়িমিত হালকা ব্যায়াম এবং অ্যারোবিকস করার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। সেই সাথে নিয়মিত হাঁটা, স্বাস্থ্যকর ডায়েট অনুসরণ করার পরামর্শ দেওয়া হয় যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ থাকতে হলে যাবতীয় হতাশা এবং অতিরিক্ত চাপ থেকে অবশ্যই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।
আরও পড়ুনঃ পেরিফিয়াল নিউরোপ্যাথি কি?