বিনাইন প্রস্টেটিক হাইপারপ্লাসিয়া (Benign Prostatic Hyperplasia) বা বিপিএইচ কিঃ
বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রস্টেট গ্রন্থি বড় হয়ে যাওয়া একটি সাধারণ বিষয়। প্রস্টেট বড় হয়ে গেলে রেচনতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়, যা মানুষের জন্য খুবই অস্বস্তিকর। এই সমস্যায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করা না হলে রোগীর মূত্রপ্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি করে। এর ফলে মূত্রাশয়, মূত্রনালী এবং কিডনিতে নানা ধরণের সমস্যা হয়ে থাকে।
এই রোগটিকেই বিনাইন প্রস্টেটিক হাইপারপ্লাসিয়া (Benign Prostatic Hyperplasia) বা BPH বলা হয়। বিনাইন প্রস্টেট এনলার্জমেন্ট (Benign Prostate Enlargement) এবং বিনাইন প্রস্টেটিক হাইপারট্রফি (Benign Prostatic Hypertrophy) নামেও এই রোগটি পরিচিত।
নিয়মিত ঔষধ সেবব, অপারেশন এবং থেরাপি ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। রোগীর অবস্থা নির্ণয়ের মাধ্যমে কোন চিকিৎসার প্রদান করে রোগীকে সুস্থ করা যাবে তা একজন মূত্ররোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বুঝতে পারেন।
রোগের কারণঃ
মানুষের প্রস্টেট গ্রন্থি মূত্রাশয়ের নিচে অবস্থিত। আমাদের প্রস্রাব যে নালীর মধ্য দিয়ে মূত্রাশয় থেকে মূত্রনালীতে পরিবাহিত হয় সেই নালীটি প্রস্টেটের ভিতর দিয়ে যায়। আর যখন প্রস্টের বড় হয়ে যায়, তখন এই নালীটিতে চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে মূত্র প্রবাহ ব্যাহত হয়। ফলে পর্যাপ্ত প্রস্রাব বের হতে পারে না।
অধিকাংশ পুরুষের ক্ষেত্রে প্রস্টেট বৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে হতে পারে। এই অবস্থায় মূত্রাশয় ও মূত্রপ্রবাহের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে। ঠিক কি কারণে প্রস্টেটের আকার বড় হয়ে যায় তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে একজন পুরুষের সেক্সুয়াল হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে পুরুষ এই রোগে আক্রান্ত হয় বলে বিশেষজ্ঞগণ জানিয়ে থাকেন।
রোগের লক্ষণঃ
এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে চিকিৎসক নিন্মলিখিত লক্ষণগুলো দেখতে পায়:
★ প্রস্টেটের বিভিন্ন সমস্যা (Prostate Symptoms)
★ প্রস্রাব আটকে যাওয়া (Retention of Urine)
★ ঘনঘন মূত্রত্যাগ (Frequent Urination)
★ প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া ( Blood in Urine)
★ অনৈচ্ছিক মূত্রত্যাগ বা প্রস্রাব আটকে রাখতে না পারা (Involuntary Urinatino)
★ রাতে অতিরিক্ত মূত্রত্যাগ (Excessive Urination at Night)
★ পুরুষত্বহীনতা (Impotence)
★ প্রস্রাব কম হওয়া (Low Urine Output)
★ অণ্ডথলি ফুলে যাওয়া (Swelling of Scrotum)
★ শুক্রাশয়ে ব্যথা হওয়া (Pain in Testicles)
★ মূত্রথলির উপসর্গ (Symptoms of Bladder)
কাদের ঝুঁকি বেশিঃ
কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এই সকল ব্যক্তিরা হচ্ছে–
১. যে সকল পুরুষের বয়স ৪০ এর কম তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে ৬০ এর অধিক বয়স এমন পুরুষের এই রোগে আক্রান্ত রোগীর হওয়ার হার এক-তৃতীয়াংশ। আর এই বয়সের মানুষের মাঝে এই রোগের মাঝারি থেকে গুরুত্বর লক্ষণ দেখা যায়। ৬০ থেকে ৮০ বা তার অধিক বয়সের পুরুষের মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষ বিনাইন প্রস্টেটিক হাইপারপ্লাসিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। এর এই বয়সের মানুষের দেহে এই রোগের বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়।
২. জেনেটিক অর্থাৎ বাবা বা বড় ভাইয়ের প্রস্টেটের সমস্যা থাকলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৩. গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত, এমন ব্যক্তিদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি।
৪. কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গদের এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। সেই তুলনায় এশিয়ার মানুষ এই রোগে কম আক্রান্ত হয়।
৫. অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অর্থাৎ স্থূলতার জন্য এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতে পারে।
যারা আক্রান্ত হতে পারেঃ
★ পুরুষদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নারীদের তুলনায় দ্বিগুণ বেশি।
★ শ্বেতাঙ্গদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। অপরদিকে কৃষ্ণাঙ্গ, হিস্পানিক এবং অন্যান্য জাতিদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণ কম।
প্রস্টেট বৃদ্ধির এই রোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে কিছু কাজ করা যেতে পারে। কাজগুলো হচ্ছে-
★ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানি এবং তরল খাবার গ্রহণ করায় কোনো বাঁধা নেই। তবে সন্ধ্যার পর থেকে, বিশেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার ২-৩ ঘন্টা আগে থেকে পানি বা তরল জাতীয় খাবার কম খেতে হবে। সম্ভব হলে সেই সময় থেকে তরল খাবার বাদ দিতে হবে। কারণ, ঘুমের মাঝে প্রস্রাবের চাপ আসলে অনেকেই অলসতার কারণে বিছানা থেকে উঠতে চায় না। ফলে মূত্রথলিতে প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং এমন করতে থাকলেচ মূত্রথলি বড় হয়ে যায়।
★ মদ্যপান ও ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এগুলো শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
★ প্রস্রাবের চাপ অনুভব করলে বেশিক্ষণ প্রস্রাব আটকে রাখা যাবে না।
★ নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে প্রস্রাব করার অভ্যাস তৈরি করতে হবে।
★ অ্যান্টিহিস্টামিনের ব্যবহার কমাতে হবে। সম্ভব হলে পরিহার করতে হবে।
★ গরম ও উষ্ণ জায়গায় থাকতে হবে। মনে রাখবেন ঠান্ডা আবহাওয়া প্রস্রাবের বেগকে ত্বরাণ্বিত করে।
★ নিয়মিত ব্যায়াম, খেলাধুলা বা যে কোনো ধরণের শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে।
★ ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবার পরিহার করে পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে।
কি কি পরীক্ষা করতে হবেঃ
প্রস্টেট বড় হয়ে গেলে ডাক্তার কিছু টেস্ট করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। টেস্টগুলো হচ্ছে-
★ ব্লাড ইউরিয়া নাইট্রোজেন, বি.ইউ.এন (Blood Urea Nitrogen, B.U.N)
★ ইউরিন কালচার (Urine Culture)
★ ইউরিন এনালাইসিস (Urine Analysis)
★ আল্ট্রাসনোগ্রাম এল/এ (USG L/A)
★ প্রস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন, পি.এস.এ (Prostate Specific Antigen, PSA)
★ ইলেক্ট্রোলাইটস, সেরাম (Electrolytes, Serum)
গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যঃ
বিনাইন প্রস্টেটিক হাইপারপ্লাসিয়া বা বি.পি.এইচ রোগের চিকিৎসা করা না হলে পরবর্তীতে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। মূত্রশয় সম্পূর্ণ খালি না হলে মূত্রনালীতে ইনফেকশন এবং পাথর হতে পারে। এছাড়া প্রস্রাব স্বাভাবিক গতিতে বের হতে না পারলে চাপে প্রস্রাবের সাথে রক্ত বের হতে পারে। একই সাথে এই রোগ হলে মানুষের প্রস্রাবের চাপ ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। ফলে অজান্তে বা অল্প চাপে প্রস্রাব বের হয়ে কাপড় ভিজে যেতে পারে। প্রস্রাব বেশিক্ষণ চেপে রাখলে কিডনিতে চাপ পড়ে এবং কিডনি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। তবে মূত্রাশয় এবং কিডনি নষ্ট হয়ে যায় এমন সংখ্যা বিরল।
B.P.H এ আক্রান্ত হলে সর্বপ্রথম রোগীর অবস্থা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ সেই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে হবে। এজন্য একজন অভিজ্ঞ ইউরোলোজিস্টের স্মরণাপন্ন হয়ে পরামর্শ নিতে হবে। যদি মূত্রত্যাগের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যা না হয়ে থাকে, তাহলে সাধারণত এক্ষেত্রে ডাক্তার কোনো চিকিৎসা না দিয়ে জীবন ধারা পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়া হয়। ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করা, খাবারে পরিবর্তন আনা এসবের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে মূত্রত্যাগের সময় যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে ঔষধ সেবন এবং প্রয়োজন হলে অপারেশনের মাধ্যমে রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা নিতে হয়। একই সাথে মদ্যপান একেবারেই নিষিদ্ধ এবং ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় পান করার পরিমাণ কমানোর পাশাপাশি রাতে তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ঔষধ গ্রহণের জন্য মূত্রাশয়ের পেশীগুলো সংকোচনের পরিমাণ হ্রাস পায়। এর ফলে এই রোগে আক্রান্ত অবস্থায় অ্যান্টিহিস্টামিনের ব্যবহার প্রস্রাব করার সময় ব্যাঘাত ঘটায়। সুতরাং, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ঔষধ সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে। মূলত এলার্জি এবং ঠান্ডাজনিত রোগ প্রতিরোধ করে এমন কিছু ঔষধে অ্যান্টিহিস্টামিন থাকে।
আরও পড়ুনঃ আপনার শরীরে এন্টিবায়োটিক কাজ করছে তো?
Pingback: Hydronephrosis (হাইড্রোনফ্রোসিস) লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা - রক্ত বন্ধন - Rokto Bondhon