নিকটাত্মীয়কে বিয়ে, উইলসন ডিজিস ছাড়াও কি কি রোগ হতে পারে সন্তানের

উইলসন ডিজিসঃ

উইলসন ডিজিস উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিরল একটি রোগ। যা আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক, লিভার এবং কিডনিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোতে কপার জমা করে দিতে পারে। এই রোগ বেশিরভাগ রোগীর ৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে ধরা পড়ে। তবে বয়স্ক অবস্থায়ও অনেক রোগীকে এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। প্রতি ৩০ হাজার মানুষের মধ্যে ১ জন ব্যক্তি এই উইলসন ডিজিসে আক্রান্ত বলে গবেষণায় জানা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬ হাজারের কম বেশি মানুষের এই রোগে আক্তান্ত।

একজন সুস্থ মানুষের লিভার দেহের অতিরিক্ত কপারকে ফিল্টার করে এবং প্রস্রাবের মাধ্যমে তা বের করে দেয়৷ কিন্তু উইলসন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের লিভার অতিরিক্ত কপারকে সঠিকভাবে অপসারণ করতে অক্ষম। ফলে এই অতিরিক্ত কপার লিভারের পাশাপাশি মস্তিষ্ক, চোখ এবং কিডনির আশেপাশে তৈরি হতে থাকে।
কপারের এই বৃদ্ধি বন্ধ বা এই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগ নির্ণয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসা বিলম্বিত করা বা চিকিৎসা না করানো অথবা চিকিৎসা চলতে চলতে বন্ধ করে দেওয়া রোগীর মস্তিষ্কের ক্ষতি, লিভার ফেইলর, কিডনি জনিত সমস্যা, চোখের ক্ষতির পাশাপাশি জীবননাশের কারণ হতে পারে।

লক্ষণঃ

উইলসন ডিজিস জন্মের সময় শিশুর শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। তবে লক্ষণ এবং উপসর্গ সাধারণত মস্তিষ্ক, লিভার, চোখ, কিডনি বা অন্যান্য অঙ্গে কপার তৈরি হওয়ার পরেই দেখা যায়। লক্ষণ এবং উপসর্গ রোগীর শরীরের অংশসমূহের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে, যা এই রোগ দ্বারা প্রভাবিত হয়। তবে উপসর্গের মধ্যে কিছু হচ্ছে–
★ ক্লান্তি বা বিষন্নতা,
★ কথা বলতে, খাবার বা ঢোক গিলতে সমস্যা হওয়া,
★ ত্বকের পাশাপাশি চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যাওয়া,
★ সোনালী-বাদামী চোখের বিবর্ণতা,
★ এসাইটিস,
★ বমি হওয়া,
★ কাঁপুনি হওয়া,
★ মুখ দিয়ে লালা পড়া,
★ মুখ হা হয়ে থাকা ও হা হয়ে থাকার পাশাপাশি বাঁকা হয়ে যাওয়া,
★ নাচের ভঙ্গিমায় হাত পা বাঁকা হয়ে যাওয়া,
★ পা ফুলে যাওয়া,
★ পা ও পেটে তরল বা ফ্লুইড জমা হয়ে যাওয়া,
★ চুলকানি,
★ হঠাৎ হঠাৎ পেশী শক্ত হয়ে যাওয়া,
★ ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন,
★ শ্রবণ বা ভিজুয়্যাল হ্যালোসিনেশন,
★ শারীরিক সমন্বয়ের সমস্যা,
★ বুদ্ধিমত্তা কমে যাওয়া ইত্যাদি।
আপনি বা বাসার কেউ যদি এমন কিছু উপলব্ধি করে থাকেন, তাহলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হওয়াটা জরুরী।

কারণসমূহঃ

উইলসন ডিজিস একটি হচ্ছে অটোসোমাল রিসেসিভ বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত রোগ। অর্থাৎ রোগটি বিকাশ করার জন্য রোগীকে অবশ্যই পিতামাতার নিকট থেকে ত্রুটিপূর্ণ জিনের একটি অনুলিপি উত্তরাধিকারসূত্রে পেতে হবে। শুধুমাত্র পিতা বা শুধুমাত্র মাতার নিকট থেকে একটি জিন গ্রহণ করলে কোনো ব্যক্তি এক রোগে আক্রান্ত হবে না। তবে পিতা অথবা মাতা যে কোনো একজনের থেকে কোনো ব্যক্তি এই জিন প্রাপ্ত হলে সেই ব্যক্তি অসুস্থ না হলেও একজন বাহক হয়ে থাকবে। এবং সেই ব্যক্তির স্ত্রীর শরীরে একই জিনের উপস্থিতি থাকলে সন্তান এই রোগে আক্রান্ত হবে। আর স্ত্রীর দেহে এই জিন না থাকলে সন্তানও বাহক হয়ে থাকবে।
আবার পিতামাতা ছাড়াও যদি ভাই বোন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে বা এই জিনের বাহক হয়ে থাকে তবে অন্য ভাই বা বোনেরও এই রোগে আক্রান্ত বা বাহক হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

রোগ নির্ণয়ঃ

উইলসন রোগ নির্ণয় করা চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। কারণ এই রোগটির লক্ষণ অনেকটাই হেপাটাইটিসের মতো। আবার লিভারের অন্যন্য রোগের লক্ষণের সাথেও এই রোগের লক্ষণের বেশ মিল রয়েছে। ফলে এটি উইলসন ডিজিস নাকি হেপাটাইটিস, বা লিভারের অন্য রোগ কি না তা প্রথমে নির্ণয় করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সময়ের সাথে সাথে লক্ষণগুলোও বকশিত হতে শুরু করে। ফলে ডাক্তার রোগ নির্ণয় করতে এবং নিশ্চিত হতে উপসর্গ এবং একাধিক টেস্টের রিপোর্টের সংমিশ্রণ ব্যবহার করে নিশ্চিত হতে পারেন ব্যক্তিটি উইলসন ডিজিসে আক্রান্ত।

যে সব টেস্টের মাধ্যমে ডাক্তার নিশ্চিত হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে-

রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষাঃ

রক্ত পরীক্ষাসমূহের মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তির লিভারের কার্যকারিতা নিরীক্ষণের পাশাপাশি রক্তে কপারকে আবদ্ধ করে এমন একটি প্রোটিনের স্তর এবং কপারের স্তর কতটা তা নির্ণয় করতে সহায়তা করে। পাশাপাশি ডাক্তার ২৪ ঘন্টার সময়কালে আপনার প্রস্রাবে নির্গত কপারের পরিমাণও পরিমাপ করার জন্য প্রস্রাব পরীক্ষা করতে দিতে পারেন।

বায়োপসিঃ
এই টেস্টের মাধ্যমে।ডাক্তার রোগীর ত্বকের মধ্য দিয়ে লিভারে একটি পাতলা সুঁই ঢুকিয়ে থাকেন। এরপর লিভার থেকে টিস্যুর একটি ছোট নমুনা নিয়ে অতিরিক্ত কপার নির্ণয় করার জন্য ল্যাবে পাঠিয়ে পরীক্ষা করানো হয়।

চোখ পরীক্ষাঃ
একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ একটি অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চ-তীব্রতার আলোর উৎস, যেমন একটি স্লিট ল্যাম্প কায়সার-ফ্লেসার রিংসমূহর জন্য রোগীর চোখ পরীক্ষা করবেন। মূলত চোখে অতিরিক্ত কপার আছে কি-না তা নির্ণয় করার জন্য এই পরীক্ষাটি করা হয়। উইলসন ডিজিস এক ধরণের ছানির সাথেও যুক্ত, যে ছানিটি সূর্যমুখী ছানি নামে পরিচিত। চোখ পরীক্ষা করার মাধ্যমে এই ছানি বা রোগটি নির্ণয় করা সম্ভব।

জেনেটিক পরীক্ষাঃ
উইলসন রোগে আক্রান্ত কি-না তার জেনেটিক মিউটিশন সনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের মিউটিশনসমূহ জানার জন্য পরিবারের সকল সদস্যর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে স্কিনিং করতে দেওয়া হয় এবং যেকোনো উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগেই অন্য সদস্যদের চিকিৎসা শুরু করতে পারেন।

উইলসন ডিজিস

চিকিৎসাঃ

ডাক্তার প্রথমে চিলেটিং এজেন্ট হিসেবে পরিচিত ঔষধগুলো রোগীকে সেবনের নির্দেশনা দিতে পারে। এই ঔষধগুলো কপারকে বাঁধতে সক্ষন এবং বিভিন্ন অঙ্গকে রক্তের প্রবাহ স্বাভাবিক করতে সহায়তা করে। এই কপার কিডনির মাধ্যমে ফিল্টার হয়ে থাকে, অত:পর তা প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়ে যায়।

ঔষধঃ
ডাক্তার যে কোনো উপসর্গ উপশম করার জন্য বিভিন্ন ঔষধ সুপারিশ করতে পারেন।

লিভার ট্রান্সপ্লান্টঃ
রোগীর লিভার যদি বেশি পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাহলে রোগীর লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করার প্রয়োজন হতে পারে। লিভার ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির লিভার কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এবং অন্য একজন সুস্থ ব্যক্তি যার লিভার, ব্লাড গ্রুপ ও টিস্যু রোগীর সাথে ম্যাচ করে তার লিভারের অর্ধাংশ বা কিছু অংশ কেটে নিয়ে রোগীর লিভারে প্রতিস্থাপন করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৃতদেহ থেকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লিভার নিয়ে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে জীবিত ও সুস্থ ব্যক্তিও লিভার ডোনেট করে থাকেন। তবে এই কাজটি রোগীর আত্মীয়দের নিকট থেকে করা হয়ে থাকে। লিভার ডোনেট করার ৮-১২ সপ্তাহের মধে পুনরায় ডোনারের শরীরের মধ্যে পূর্ণ হয়ে যায়।

জটিলতাঃ
উইলসন ডিজিসে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা না করালে এই রোগটি মারাত্মক হতে পারে। যা রোগীকে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত করার পাশাপাশি মৃত্যুর মখে ঠেলে দিতে পারে।  চিকিৎসা না করালে যে সকল জটিলতা দেখা দিতে পারে, তা হচ্ছে–

সিরোসিস:
উইলসন রোগের প্রভাবে যেহেতু রোগীর লিভারের কোষগুলো অত্যাধিক কপার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাই এই এই কোষগুলো নিজে নিজে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করে। যার ফলে লিভারের টিস্যুতে স্পট তৈরি হতে পারে। আর সেখান থেকে লিভার সিরোসিসের সম্ভাবনা প্রবল।

লিভার ফেইলর:

এই সমস্যাটি যে কোনো সময় ঘটতে পারে৷ আবার ধীরে ধীরেও রোগীর লিভার অকার্যকর হয়ে যেতে পারে৷ আর এমন হলে লিভার টিকিয়ে রাখতে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট একমাত্র চিকিৎসা হতে পারে।

কিডনির সমস্যা:
উইলসন ডিজিস রোগীর কিডনির ক্ষতি করতে সক্ষম। এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে অতিরিক্ত কপার জমা হলে কিডনি তা পুরোপুরি পরিশোধন বা ছেকে বের করতে পারে না। এর ফলে কিডনিতে পাথরের পাশাপাশি প্রস্রাবে অস্বাভাবিক সংখ্যক অ্যামিনো এসিড নির্গত হতে থাকে।

ক্রমাগত স্নায়বিক সমস্যা:
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কাঁপুনি, অনিচ্ছাকৃত পেশী নড়াচড়া করা, কথা বলায় অসুবিধার সাথে আনাড়ি চলাফেরার প্রবণতা দেখা যায়। চিকিৎসার মাধ্যমে এই সকল সমস্যার অনেকটা সমাধান করা গেলেও কিছু রোগী চিকিৎসা চালিয়ে গেলেও ক্রমাগত স্নায়বিক সমস্যাগুলো ভোগ করতে থাকেন।

মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাঃ
এর মধ্যে ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, বিষন্নতা, বিরক্তি, বাইপোলার ডিসআর্ডার এমনকি সাইকোসিসেও ভুগতে পারেন।

রক্তের সমস্যা:
রক্তের সমস্যার মধ্যে লোহিত রক্তকনিকা ধ্বংস বা হেমোলাইসিস আক্রান্ত হতে পারে। যা রক্ত স্বল্পতা বা জন্ডিস সৃষ্টি করতে পারে।

প্রতিরোধ:

উইলসন রোগ প্রতিরোধযোগ্য নয়। তবে যদি এই রোগটি প্রাথমিকভাবে নির্ণয় করা যায়, তবে রোগীকে সুস্থভাবে জীবন-যাপন করার জন্য চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব৷ আর উভয় বাহক বা নিকটাত্মীয়র মাঝে বিয়ে বন্ধ রাখাটাই একমাত্র প্রতিরোধ গড়তে পারে।

উইলসন ডিজিস ছাড়াও যে সকল রোগ হতে পারেঃ
নিকটাত্মীয়র মাঝে বিয়ে হলে উইলসন ডিজিস ছাড়াও আরও বেশ কিছু জটিল সমস্যার মধ্যে পড়তে পারে সন্তান। আর সেই সব সমস্যাগুলো হচ্ছে–
★ গর্ভপাত,
★ মৃত সন্তান প্রসব,
★ ১ বছর বয়সের মধ্যে সন্তানের অস্বাভাবিক মৃত্যু,
★ হঠাৎ অজানা কারণে শিশুর মৃত্যু,
★ শিশুর যথাযথ বৃদ্ধি না হওয়া,
★ শারীরিক ত্রুটি সংবলিত শিশু জন্মের সম্ভাবনা ৫ গুণ বেড়ে যায়,
★ শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম,
★ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম নেওয়া,
★ অজানা রোগে আক্রান্ত হওয়া,
★ মৃগী রোগ,
★ নানা ধরণের রক্তরোগে আক্রান্ত হওয়া। যেমন সিকেল সেল ডিজিস।
★ বিটা টাইপ থ্যালাসেমিয়া।

বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহকের সংখ্যা অনেক বেশি। অসতর্কতা, সচেতনলতার ও লজ্জার কারণে অধিকাংশ মানুষই থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না তা পরীক্ষা না করেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। যার ফলে দুই বাহকের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে হাজার হাজার শিশু। আবার আমাদের সমাজে নিকটাত্মীয় বিবাহের প্রচলনও রয়েছে। ফলে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু জন্মের ঝুঁকি অধিকাংশে বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যে সকল পরিবারে জন্মগত বিভিন্ন রোগের ইতিহাস রয়েছে, সেই সকল পরিবারে নিকটাত্মীয় বিয়ের ব্যাপারে খুব বেশি সতর্কতা অবলম্বন করাটা খুবই জরুরী।

আরও পড়ুন: ADHD রোগাক্রান্ত নয় তো আপনার শিশু?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *