থাইরয়েড কিঃ
থাইরয়েড এমন একটি রোগ যার প্রভাবে থাইরয়ে গ্রন্থি সঠিক পরিমাণে হরমোন তৈরি করতে পারে না।
একজন সুস্থ মানুষের থাইরয়েড সাধারণত হরমোন তৈরি করে, যা মানুষের শরীরকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে সহায়তা করে।
থাইরয়েড গ্রন্থিতে খুব বেশি পরিমাণে থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন হলে শারীরিক বিপাকীয় প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়। এর ফলে শরীর খুব দ্রুত শক্তি ব্যবহার করে। যাকে বলা হয় হাইপারথাইরয়েডিজম।
হাইপারথাইরয়েডিজম অর্থাৎ শরীর খুব দ্রুত শক্তি ব্যবহার করার ফলে শরীরে বিরুপ কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়। যার মধ্যে দ্রুত বা অল্পতেই শারীরিক ক্লান্তি অনুভব হওয়া, হৃদস্পন্দনের হার বেড়ে যাওয়া, দ্রুত ওজন কমে যাওয়া, নার্ভাস হয়ে পড়া ইত্যাদি উপসর্গ অন্যতম।
অপরপক্ষে, যখন থাইরয়েড গ্রন্থি খুবই কম বা পরিমানের তুলনায় অল্প থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন করে তখন তাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলে। এর ফলে শরীর যতটুকু শক্তি ব্যয় করা প্রয়োজন তার থেকেও অনেক কম শক্তি ব্যয় করে। এর প্রভাবেও শরীরে বিরুপ কিছু প্রভাব দেখা যায়। যার মধ্যে শরীরে শ্রান্তি আশা, ওজন বেড়ে যাওয়া, ঠান্ডা তাপমাত্রা সহ্য না হওয়া, ত্বক শুষ্ক হওয়া, ডিপ্রেশন ইত্যাদি উপসর্গ উল্লেখযোগ্য।
থাইরয়েডের এই প্রধান দুইটি প্রকারে মানুষ বিভিন্ন কারণে হতে পারে। আবার অনেকে পরিবারের মাধ্যমে অর্থাৎ উত্তরাধিকারসূত্রেও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
এই দুই প্রকার ছাড়াও আরও কয়েক প্রকার থাইরয়েড রয়েছে। থাইরয়েডাইটিস, গ্রেভস রোগ, হাইপারফাংশানিং থাইরয়েড নডিউল, হাশিমোটোর রোগ ইত্যাদি থইরয়েড গ্রন্থি সংক্রান্ত রোগ অন্যতম।
থাইরয়েড কি এবং শরীরে কি কি প্রভাব ফেলেঃ
থাথারয়েড একটি ছোট গ্রন্থি, যার অকার অনেকটা প্রজাপতির মত। এই গ্রন্থিটি গলার মাঝখানে অর্থাৎ ভয়েক্স বক্সের নিচে এবং শ্বাসনালীর (ট্রাকিয়া) চারপাশে আবৃত। এই গ্রন্থি একপ্রকার অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি। থাইরয়েড গ্রন্থি সাধারণত হরমোন তৈরির মাধ্যমে দেহের প্রায় সকল বিপাকীয় প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে থাকে।
থাইরয়েড হরমোনের মাধ্যমে যে সকল বিপাকীয় প্রক্রিয়াগুলো প্রভাবিত হয় সেগুলো হচ্ছেঃ-
১. হৃদস্পন্দনের হার,
২. শারীরিক ওজন,
৩. মৌল বিপাকীয় হার,
৪. পেশীর বল,
৫. কোলেস্টেরলের মাত্রা,
৬. হিমোগ্লোবিন বা রক্ত,
৭. শারীরিক তাপমাত্রা এবং অন্যান্য।
থাইরয়েডের প্রকারভেদঃ
থাইরয়েডের বেশ কিছু ধরণ রয়েছে। থাইরয়েডে আক্রান্ত রোগীকে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে জীবন-যাপন করতে হয়। থাইরয়েডের মধ্যে রয়েছে-
হাইপারথাইরয়েডিজমঃ
হাইপারথাইরয়েডিজম রোগীকে গ্রেভস রোগের দিকে ধাবিত করতে পারে। হাইপারথাইরয়েডিজমের বেশ কিছু লক্ষণ হয়েছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য–
★ অতিরিক্ত ঘাম হওয়া,
★ অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বা অ্যারিথমিয়া,
★ নার্ভাসনেস,
★ ওজন হ্রাস পাওয়া,
★ প্রসারিত চোখ।
হাইপোথাইরয়েডিজমঃ
হাইপারথাইরয়েডিজমের মত হাইপোথাইরয়েডিজমেরও কিছু লক্ষণ আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে দেখা যায়। এসব লক্ষণের মধ্যে রয়েছে–
★ ক্লান্তি,
★ ওজন বৃদ্ধি,
★ অস্বাভাবিক হাড়ের বিকাশ,
★ বিষণ্ণতা,
★ স্থবির বৃদ্ধি।
এই ধরণের থাইরয়েডে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে অটোইমিউন অ্যান্টিবডির উৎপাদন, যা থাইরয়েড গ্রন্থিকে আক্রমণ করে।
হাশিমোটো-এর থাইরয়েডাইটিসঃ
হাশিমোটো-এর থাইরয়েডাইটিস একটি অটোইমিউন ডিজঅর্ডার, যা থাইরয়েড গ্রন্থিতে প্রদাহ সৃষ্টি করে। গলগন্ড (একটি বর্ধিত থাইরয়েড গ্রন্থির কারণে ঘাড়ে ফোলা) এবং অন্যান্য উপসর্গের মাধ্যমে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
থাইরয়েড টিউমারঃ
থাইরয়েড নডিউলস এবং অ্যাডেনোমাস, ছোট ক্যান্সারহীন বৃদ্ধি কোষের স্তরে স্তরে শুরু হয়। যা থাইরয়েড গ্রন্থির অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠে রেখা তৈরি করে।
অ্যাডেনোমা নিজেই থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ করতে পারে। এবং এর ফলে হাইপারথাইরয়েডিজম হতে পারে । থাইরয়েড অ্যাডেনোমা চিকিৎসার মাধ্যমে অতিরিক্ত নোডিউল অপসারণের জন্য অস্ত্রোপাচার করতে হতে পারে।
থাইরয়েড ক্যান্সারঃ
যাদের মাথা, ঘাড় বা বুকে রেডিয়েশন বা বিকিরণ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে থাইরয়েড ক্যান্সার বেশি দেখা যায়৷ আবার এমন কোনো চিকিৎসা বা রেডিয়েশন দেওয়া হয় নি এমন রোগীও এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। থাইরয়েড ক্যান্সারের ৪টি প্রধান ধরণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে,
১. প্যাপিলারি থাইরয়েড ক্যান্সার,
২. অ্যানাপ্লাস্টিক থাইরয়েড ক্যান্সার,
৩. ফলিকুলার থাইরয়েড ক্যান্সার, এবং
৪. মেডুলারি ক্যান্সার।
মনে রাখবেন, বেশিরভাগ থাইরয়েড ক্যান্সারেরই সফলভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রোগীর চিকিৎসা শুরু করা যায়।
মহিলাদের মধ্যে থাইরয়েড ব্যাধিঃ
মহিলাদের থাইরয়েড হলে এই রোগ তাদের হরমোনের ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে। এছাড়াও বয়ঃসন্ধি, ঋতুস্রাব, গর্ভাবস্থা, উর্বরতা এবং প্রসবোত্তর সময়ে নানা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
থাইরয়েড রোগের কারণঃ
আগের জানিয়েছি যে থাইরয়েডের প্রধান ২টি ধরণ হাইপারথাইরয়েডিজম এবং হাইপোথাইরয়েডিজম। উভয় অবস্থাতেই রোগী অন্যান্য রোগের কারণে আক্রান্ত হতে পারে। এবং ঐ সকল রোগের প্রভাবে থাইরয়েড গ্রন্থির কাজকে প্রভাবিত হতে পারে।
হাইপোথাইরয়েডিজমের কারণঃ
★ থাইরয়েডাইটিসঃ
থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে গেলে বা প্রদাহ জনিত সমস্যা হলে তাকে থাইরয়েডাইটিস বলা হয়। থাইরয়েডাইটিস রোগীর থাইরয়েড উৎপন্নকারী হরমোনের উপর প্রভাব ফেলে এর উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে।
★ হাসিমোটো-এর থাইরয়েডাইটিসঃ
এটি থাইরয়েডের ব্যথাহীন একটি রোগ। হাশিমোটো-র থাইরয়েডাইটিস হচ্ছে এক ধরণের অটোইমিউন সিস্টেম। যার ফলে শরীরের কোষগুলো থাইরয়েডকে আক্রমণ করে থাইরয়েডকে ক্ষতিগ্রস্থ করে ফেলে। এই ধরণের থাইরয়েডে উত্তরোধিকার সূত্রে যে কোনো মানুষ আক্রান্ত হতে পারে।
★ প্রসব পরবর্তী থাইরয়েডাইটিসঃ
সন্তান প্রসবের পরবর্তী সময়ে ৫%-৯% মহিলাদের এই ধরণের থাইরয়েডে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এই ধরণের থাইরয়েড সাধারণত অস্থায়ী হয়ে থাকে। অর্থাৎ পরবর্তীতে ভালো হয়ে যায়।
★ আয়োডিনের অভাবঃ
থাইরয়েড গ্রন্থির হরমোন উৎপাদন করতে আয়োডিন প্রয়োজন হয়। আর শরীরে আয়োডিনের অভাব দেখা দিলে হরমোন পর্যাপ্ত উৎপাদন হয় না। এতে থাইরয়েড গ্রন্থি প্রভাবিত হয়। আয়োডিনের অভাবে বিশ্বে কয়েক মিলিয়ন মানুষ ভুগছে এবং এর ফলে মানুষ থাইরয়েডসহ নানা রোগে ভুগছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে।
★ অকার্যকর থাইরয়েড গ্রন্থিঃ
অনেক মানুষের জন্ম থেকেই থাইরয়েড গ্রন্থি সঠিকভাবে কাজ করে না। গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৪০০০ নবজাতকের মধ্যে ১ জন নবজাতক এই সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই বাচ্চাদের যদি চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে শিশুগুলো শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। সকল নবজাতকের থাইরয়েডের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে একটি স্কিনিং ব্লাড টেস্ট করা হয়।
হাইপারথাইরয়েডিজমের ধরণসমূহঃ
★ গ্রেভস ডিজজঃ
এই ধরণের থাইরয়েডিজম পুরো থাইরয়েড গ্রন্থি সক্রিয় হয়ে থাকে। এর ফলে থাইরয়েড গ্রন্থি খুব বেশি পরিমাণে হরমোন তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই সমস্যাটিকে বর্ধিত থাইরয়েড গ্রন্থি বা ডিফিউক টক্সিক গয়টারও বলা হয়ে থাকে।
★ নোডুলসঃ
থাইরয়েডের অভ্যন্তরে অত্যাধিক কার্যকরী নোডুলসের কারণে হাইপারথাইরয়েডিজম হতে পারে। একটি একক নোডুলকে স্বায়ত্তশাসিতভাবে কার্যকরী বা টক্সিট অটোনোমাসলি ফাংশনিং নোডুল বলা হয়। একাধিক নোডুলসহ একটি গ্রন্থিকে টক্সিক মাল্টি নোডুলার গয়টার বলা হয়ে থাকে।
★ থাইরয়েডাইটিসঃ
এই ধরণের ব্যধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি ব্যথা অনুভব করতে পারে আবার রোগীর কোনো প্রকার ব্যথা অনুভূতি নাও হতে পারে।
থাইরয়েডাইটিস থাইরয়েড সঞ্চিত হরমোন নি:সরণ করে থাকে। এই সমস্যাটি কয়েক সপ্তাহ এমনকি কয়েক মাস ধরে চলতে পারে।
★ অত্যাধিক আয়োডিনঃ
কোনো মানুষের শরীরে যদি খুব বেশি আয়োডিন থাকে, তখন থাইরয়েড গ্রন্থি প্রয়োজনের থেকেও বেশি থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে ফেলে। সাধারণত কিছু ঔষধ এবং কাশির সিরাপের মধ্যে অতিরিক্ত আয়োডিন পাওয়া যায়।
থাইরয়েডের লক্ষণঃ
থাইরয়েডে আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে নানা ধরণের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত থাইরয়েডে রোগের লক্ষণগুলো অন্যান্য কিছু রোগের লক্ষণের সাথে অনেকটাই মিল রয়েছে। আর এই কারণে লক্ষণগুলো থাইরয়েডের কি না এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া প্রাথমিক পর্যায়ে খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাইরয়েডের লক্ষণগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যা খুব বেশি থাইরয়েড হরমোন বা হাইপারথাইরয়েডিজম এবং খুব কর থাইরয়েড হরমোন বা হাইপোথাইরয়েডিজমের সাথে সম্পর্কিত।
অত্যাধিক সক্রিয় থাইরয়েডের (হাইপারথাইরয়েডিজম) লক্ষণসমূহঃ
এই ধরণের থাইরয়েডে সাধারণত-
* গলগন্ড বা বৃদ্ধি পাওয়া থাইরয়েড গ্রন্থি,
* ঘুমের সমস্যা হওয়া,
* উদ্বেগ, বিরক্তি এবং স্নায়ুদৌবল্য অনুভব হওয়া,
* পেশীর দুর্বলতা এবং পেশীতে কম্পন থাকা,
* ওজন কমে যাওয়া,
* তাপের প্রতি সংবেদনশীল বোধ করা,
* দৃষ্টিশক্তির সমস্যা হওয়া,
* চোখ জ্বালা করা,
* মহিলাদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত মাসিক হওয়া বা মাসিক চক্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার।
নিষ্ক্রিয় থাইরয়েড (হাইপোথাইরয়েডিজম) এর লক্ষণঃ
হাইপাইরথাইরয়েডিজমের মতো হাইপোথাইরয়েডিজমেরও বেশ কিছু লক্ষণ আছে, যা আক্রান্ত রোগীর মাঝে ফুটে উঠে। লক্ষণগুলো হচ্ছে-
* ক্লান্তি বোধ করা,
* বিস্মৃতি অনুভব করা বা কিছু ভুলে যাওয়া,
* চুল শুষ্ক ও মোটা হয়ে যাওয়া,
* অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি পাওয়া,
* কন্ঠস্বর কর্কশ হয়ে যাওয়া,
* ঠান্ডা তাপমাত্রায় অসহিষ্ণুতা অনুভব করা,
* মহিলাদের ঘন ঘন ও বেশি পরিমাণে মাসিক হাওয়া।
যাদের থাইরয়েডে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশিঃ
থাইরয়েডে যে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারে। পুরুষ, মহিলা, বৃদ্ধ, শিশু বা কিশোর যে কোনো মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আবার অনেকে জন্মগতভাবেও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশু জন্মগতভাবে সাধারণত হাইপারথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত হয়ে থাকে। বয়সের সাথে সাথে এই রোগটির বিকাশ ঘটতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে মেনোপজের পরে প্রায়শই এই বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। থাইরয়েড খুবই সাধারণ একটি রোগ। তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে এটি প্রাণঘাতী ক্যান্সারে রুপ নিতে পারে। United State এ আনুমানিক ২০ মিলিয়ন মানুষ থাইরয়েডে আক্রান্ত। বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায়, পুরুষের তুলনায় মহিলারা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। আর এর সংখ্যাটা ৫ থেকে ৮ গুণ বেশি।
যে সকল কারণে থাইরয়েডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশিঃ
থাইরয়েডে যে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারে এই কথাটা উপরেই উল্লেখ্য করা হয়েছে। তবে কিছু কারণে মানুষের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি হয়ে থাকে। আর এই কারণগুলো হচ্ছে-
★ পারিবারিক ইতিহাস অর্থাৎ উত্তরাধিকারসূত্রে মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। পরিবারের কেউ এই রোগে আক্রান্ত ছিল কি না সেই সম্পর্কে ম্যাক্সিমাম মানুষই অবগত নয়।
★ রক্ত স্বল্পতা, টাইপ-1 ডায়াবেটিস, লুপাস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, টার্নার সিনড্রম, সজোগ্রেনের সিন্ড্রোম এবং প্রাথমিক অ্যাড্রিনাল অপ্রতুলতা এই সকল রোগে আক্রান্ত এমন মানুষের থাইরয়েডে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
★ ষাটোর্ধ্ব পুরুষ এবং মহিলার এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
★ অতীতে থাইরয়েড আক্রান্ত হয়েছিল বা ক্যান্সারের (থাইরয়েডেক্টমি বা রেডিয়েশন) চিকিৎসা নেওয়া হয়েছে এমন ব্যক্তি এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
★ বেশি আয়োডিন আছে এমন ঔষধ সেবনের ফলে মানুষ থাইরয়েডে আক্রান্ত হতে পারে। অ্যামিওডারোন জাতীয় ঔষধে আয়োডিনের পরিমাণ বেশি থাকে।
কিভাবে থাইরয়েড প্রতিরোধ করবেনঃ
থাইরয়েড নিয়ে অনেকের ভুল ধারণা থাকে যে, থাইরয়েডের চিকিৎসা নেই বা এই রোগ নির্মূল করা সম্ভব না। থাইরয়েড নির্মুল করা না গেলেও একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাইরয়েডের সফল চিকিৎসা হয়ে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে থাইরয়েড নির্ণয় করা গেলে চিকিৎসক অ্যান্টি-থাইরয়েড ঔষধ, রেডিওঅ্যাক্টিভ আয়োডিন ট্রিটমেন্ট দিয়ে থাকেন। রোগের গুরুত্ব বিবেচনায় রোগীকে অপারেশনের মাধ্যমে সুচিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে।
কি কি উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবেঃ
নিন্মের উপসর্গগুলো দেখা দিলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
১. গলার ভয়েস বক্সের দুইদিকে পিন্ডের মত ফোলা অনুভব করলে।
২. অনেকক্ষণ ধরে গরম বা শীত অনুভূত হলে।
৩. নার্ভাস, হতাশা অনুভব করা, মুড সুইং বা মেজাজ পরিবর্তন হতে থাকলে বা ডিপ্রেশনে থাকলে।
৪. হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস পেলে।
৫. খুব বেশি শ্রান্তি ও ক্লান্ত অনুভব করলে।
থাইরয়েড প্রতিরোধে কিছু পরামর্শঃ
প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করুনঃ
প্রক্রিয়াজাত খাবারে অনেক ধরণের রাসায়নিক উপাদান থাকে। এসব উপাদান থাইরয়েড হরমোন তৈরী হওয়াকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। যে কোনো ধরণের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পরিহার করতে হবে। এসব খাবারে অতিরিক্ত তেল, লবণ ও চিনির পরিমাণ বেশি থাকে। যা দ্রুত শরীরের ওজন ও চর্বি বাড়িয়ে দিতে পারে।
সয়া পন্য এড়িয়ে চলুনঃ
সোয়া জাতীয় খাওয়া সীমিত করতে হবে। কারণ এই খাবারও থাইরয়েড হরমোন তৈরিকে প্রভাবিত করে। সয়াবিন, টফুর, সয়ার দুধ ইত্যাদি খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো।
ক্রুসীফেরাস সবজিঃ
থাইরয়েডে আক্রান্ত ব্যক্তি ফুলকপি, পাতাকপি, পালং শাক, ব্রকলি এসব একদমই পরিহার করতে হবে। কারণ এই জাতীয় শাক সবজিতে গায়ট্রোজেন নামক এক প্রকার উপাদান থাকে, যা থাইরয়েড গ্রন্থিকে আয়োডিন শোষনে বাঁধা দেয়। ফলে হাইপারথাইরয়েডিজম আরও বেড়ে যায়।
ধুমপান ও অ্যালকোহল পরিহারঃ
ধুমপান থেকে নির্গত টক্সিন থাইরয়েড গ্রন্থিকে খুব বেশি সংবেদনশীল করে তুলতে পারে। যা ধুমপায়ী ব্যক্তিকে থাইরয়েডে আক্রান্ত করতে সক্ষম। আবার অ্যালকোহলে থাকা উপাদানও থাইরয়েড হরমোনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সক্ষম।
মানসিক চাপমুক্ত থাকুনঃ
থাইরয়েডসহ স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের মত বড় বড় রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে মানসিক চাপ। তাই নিজেকে মানসিক চাপমুক্ত রাখুন। চাপমুক্ত থাকতে ইবাদাত করুন, ধ্যান করুন, যোগব্যায়ামের মাধমে নিজেকে সক্রিয় করুন। যে কোনো কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখুন। মনে রাখবেন, অসল ও কর্মহীন ব্যক্তি মানসিক চাপে বেশি ভোগে।
কি কি খাবেনঃ
কাজু বাদাম, চিনা বাদাম এবং সূর্যমুখীর বীজে সবচেয়ে বেশি কপার পাওয়া যায়। আর এই কপার থাইরয়েড রোগীর জন্য খুবই উপকারী। এছাড়া সবুজ শাক-সবজিতে প্রচুর পরিমাণে আয়রনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। খনিজের পাশাপাশি ভিটামিনযুক্ত খাবার খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। এসব খাবার থাইরয়েড আক্রান্ত রোগীর জন্য খুবই উপকারী। কাঁচা মরিচ, টমেটো, পিঁয়াজ, রসুন, মাসরুম, পনির ইত্যাদি খাবারগুলোয় ভিটামিন ও খনিজ উপাদান বিদ্যমান।
পরিশেষেঃ
চিকিৎসাযোগ্য ছোট গলগন্ডকে (বর্ধিত হওয়া গ্রন্থি) অবহেলা করার ফলে ম্যালিগন্যান্সি নামক প্রাণনাশক রোগে আক্রান্ত হতে পারে থাইরয়েডে আক্রান্ত ব্যক্তি। বেশির ভাগ সময়ে থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে বিচ্যুতি ঘটার কারণে মানুষ থাইরয়েডে আক্রান্ত হয়ে থাকে। যদিও কিছু থাইরয়েডে অপ্রীতিকর ও অস্বস্তিকর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। অনেকে জন্মগত, বংশগত বা প্রেগন্যান্সি পরবর্তী জটিলতার কারণে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে সঠিক রোগ নির্ণয় এবং সুচিকিৎসার মাধ্যমে বেশিরভাগ থাইরয়েডই কার্যকরীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
আরও পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় কোন খাবারগুলো বিপদজনক