৩১ মে ২০১৮।।
ব্যক্তিগত কাজে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ব্লাড ব্যাংকে গিয়েছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে দেখি ১৪-১৫ বছরের অত্যন্ত পাতলা গড়নের একটি মেয়ে হাতে টেস্ট টিউবে ব্লাড স্যাম্পল এবং রক্তের চাহিদাপত্র নিয়ে ব্লাড ব্যাংকের এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়ে বেড়াচ্ছে আর অবিরত কেঁদে যাচ্ছে। তার সাথে একটি ছেলে ছিল (তার খালাতো ভাই) বয়স ২০-২২ হবে।
মেয়েটিকে (বোন বলাটাই শ্রেয়) ডাক দিয়ে চেয়ারে বসতে বলি এবং জিজ্ঞেস করি ” আপু কি হয়েছে আপনার? ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে এভাবে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছেন কেন আর কাঁদছেন কেন? ”
মেয়েটি বলেন ” ভাইয়া আমার আম্মু অনেকদিন থেকে অসুস্থ, গতকাল তাকে মেডিকেলে এনে ভর্তি করিয়েছি। গতকাল বিকেলে আম্মু মেডিকেলের ওয়াশরুমে পড়ে যায় এবং পেটে আঘাত পায়। এরপর থেকে আম্মুর পেট ফুলে যেতে থাকে। সকালে এক্স-রে করার পর ডাক্তার বলেন পেটের ভিতর নাড়ি আর রগ ছিঁড়ে ব্লিডিং হচ্ছে। ইমার্জেন্সি ৬ ব্যাগ রক্ত না পেলে আম্মু বাঁচবে না। ভাইয়া আমি অনেকক্ষণ ব্লাড স্যাম্পল আর চাহিদাপত্র নিয়ে দৌঁড়াচ্ছি কিন্তু জমা দিতে পারছি না। ”
তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করি আপনার আম্মুর রক্তের গ্রুপ জানা আছে আপনার?
পাশ থেকে ছেলেটি উত্তর দেয়, ভাইয়া রোগী আমার খালা। অনেক আগে গ্রুপিং করিয়েছিলাম। মে বি O+ ব্লাড গ্রুপ ।
আমি তখন তাকে বলেছিলাম ভাইয়া এখানে মে বি কথাটা চলবে না। তখন বোনটির কাছ থেকে ব্লাড স্যাম্পল আর চাহিদাপত্র নিয়ে ব্লাড ব্যাংকে জমা দিয়ে ৫ মিনিটের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাই। ব্লাড গ্রুপিং করে তারা জানান ব্লাড গ্রুপ O+ না দুর্লভ ( O-)। টেনশনে পড়ে যাই তখন। সন্ধানী, বাঁধন, কোয়ান্টাম, বন্ধন, রেড ক্রিসেন্ট, স্বজন সহ যত ব্লাড ব্যাংক ছিল সব যায়গায় কল দিয়েছিলাম সেদিন। ইভেন মেডিকেল ব্লাড ব্যাংকে যতজন মানুষ উপস্থিত ছিল ( যতদূর মনে পড়ে সংখ্যাটা ২২ বা ২৩ জন) সবার ব্লাড গ্রুপ চেক করেছিলাম। যদি কারও ব্লাড গ্রুপ মেলে এই আশা নিয়ে। কিন্তু, কারও সাথে ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ করেনি সেদিন।
তবে একটা বিষয় জানতাম, নেগেটিভ ব্লাড গ্রুপ আত্মীয়দের মাঝে পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর সে জন্য রোগীর মেয়ের অর্থাৎ, সেই ১৪-১৫ বছরের বোনটির ব্লাড গ্রুপিং করি এবং মেয়েটির ব্লাড গ্রুপ দুর্লভ ও- পাওয়া যায়। মেয়েটি জানার পরে বারবার কান্নারত অবস্থায় অনুরোধ করতে থাকে ‘ভাইয়া আমি রক্ত দিব’। রক্ত না পেলে আমার আম্মু মারা যাবে। একবার সে আমার পা জড়িয়ে ধরেন, একবার ব্লাড ব্যাংকের কর্মচারীর পা জড়িয়ে ধরেন। সাথে কান্না জড়িত কন্ঠে তার আর্তনাদ ও আকুতি চলতেই থাকে। রক্ত কোথাও না পাওয়া যাওয়ার কারণে এবং রেয়ার গ্রুপ হওয়ায় বোনটির রক্ত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মাঝে আমি মেয়েটিকে নিয়ে বেশ কিছু ব্লাড ব্যাংকে গিয়েছিলাম এবং একটি ব্লাড ব্যাংকের ফ্রিজে দুই ব্যাগ ও- রিজার্ভ থাকতেও দেখেছি। কিন্তু সেদিন তারা রক্ত দেয়নি। 😥
বোনটির রক্তদানের বয়স এবং ওজন কোনটিই ছিল না রক্তদানের জন্য। রক্তদানের আগে ব্লাড ব্যাংকের একজন মহিলা কর্মচারীকে বোনটির কাছে পাঠাই ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন করার জন্য। কারণ প্রাপ্ত বয়ষ্ক প্রতিটি মেয়েকেই প্রতি মাসে বিশেষ একটি সময় পার করতে হয়। ব্লাড ব্যাংকের কর্মচারী আপুটি ফিরে এসে বলেন, ” ভাইয়া রক্ত নেওয়াই যাবে না। “মেয়েটি বিশেষ মুহূর্ত অতিবাহিত করছে। ক্ষতি হয়ে যাবে মেয়েটির। ”
রক্ত নেওয়া যাবে না শুনে বেড থেকে নেমে মেয়েটি আরও জোরে কান্না করতে থাকে এবং পা জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে “ভাইয়া আমাদের দেখার মত মা ছাড়া কেউই নেই, আব্বু আমাদের ঠিকমতো খোঁজও নেয় না। তিনি হাসপাতালেও আসেন নি। আমার ৬ বছর বয়সী একটা ভাই আছে। আম্মুর কিছু হয়ে গেলে আমাদের দেখার কেউ নেই। আমার রক্ত নেন ভাইয়া আমার কিছু হবে না।”
★ একটা কথা আছে না ” কিছু মুহূর্ত, সকল নিয়মকে পরাজিত করে দেয় “। সেদিন সেই মুহূর্তের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। নিজের সামনে বা নিজের মাধ্যমে ঘটে যাচ্ছিলো সবকিছু। অথচ কিছুই করতে পারছিলাম না। যেন এক নির্বাক দর্শক হয়ে গিয়েছিলাম পরিস্থিতির কাছে।
বয়স কম, ওজন নেই, তার উপরে বিশেষ মুহূর্তে আছে এমন একটি মেয়েকে রক্ত দিতে হচ্ছে চোখের সামনে। খুব খারাপ লেগেছিল সেই মুহূর্তটা।
রক্ত দেওয়ার পরে মেয়েটি সাথে সাথেই উঠে গিয়ে বলছিল ‘আমি আম্মুর কাছে যাবো’।। খারাপ লাগছিল মেয়েটির সেটি বুঝতে পারি নি। কিছুক্ষণ শুয়ে বিশ্রাম নিতে বলি। এরপর কিছুক্ষণ বিশ্রামে থেকে মেয়েটি তার আম্মুর কাছে চলে যায়।
রমজান মাস ছিল এবং জোহরের নামাজের সময় হয়ে আসছিল। আমি সেই বোনটির খালাতো ভাইয়ের কাছ থেকে তার মোবাইল নাম্বারটি নেই এবং বলি ভাইয়া আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। রক্তদাতা পেলে আপনার সাথে যোগাযোগ করবো ইনশা আল্লাহ। এরপর আমি বাসার চলে আসি এবং জোহরের নামাজের পরে ফেসবুকে নিজের একাউন্টে একটা পোস্ট করি। সাথে ব্লাড ডোনেশন করে এমন কিছু গ্রুপ সার্চ করে সেখানেও পোস্ট করি এবং বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংকে এবং সংগঠনে কল দিতে থাকি এক ব্যাগ রক্ত পাওয়ার আশায়। কেউ এগিয়ে আসেনি বা আসতে পারেনি সেদিন। শুধুমাত্র কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, ঢাকা থেকে কল রিসিভ করে এতটুকু আশ্বাস দিয়েছিল, ‘আমরা ডোনার পেলে আপনাকে জানাবো’।
পরবর্তীতে ইফতার করে মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে সেই ছেলেটিকে ( রোগীর ভাগিনা) রোগীর অবস্থা জানার জন্য। আর রক্তদাতা পেয়েছিল কি না সেটা জানার জন্য কল দেই। কারণ পোস্টে তার নাম্বার দেওয়া হয়েছিল ।
ছেলেটি কল রিসিভ করে বলেন ” ভাইয়া ব্যস্ততার কারণে আপনার সাথে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। ইন্টারনাল রক্ত ক্ষরণের ফলে আমার খালাটা বিকেলে মারা গেছে। আমরা আর একটি ব্যাগ রক্তও ম্যানেজ করতে পারিনি ভাইয়া। আপনি অনেক চেষ্টা করেছেন ভাইয়া “।
খুব খারাপ লেগেছিল কথাটা শোনার পরে। তার থেকে বেশি খারাপ লেগেছিল রোগীর মেয়েটা (যিনি রক্তদান করেছেন) কেমন আছে সে বিষয়ে জানতে চেয়ে।
ছেলেটি বলেন ” ভাইয়া আমার বোনটি রক্ত দিয়ে আসার পরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়, এখনও জ্ঞান ফিরেনি তার। ও মেডিকেলেই ভর্তি আছে। হয়তো ওর মাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারবে না। আমার খালার জন্য আর খালাতো বোনটার জন্য দোয়া করবেন ভাইয়া “।
খুবই খারাপ লেগেছিল কথাটা শোনার পরে। রাতের খাবার এমনকি সেহরিটাও খেতে পারি নি সেই রাত্রে। বারবার বিষয় মাথায় ঘুরছিল বেশ কিছু বিষয়।
★ একটা অল্প বয়সী মেয়ে। যার বয়স, ওজন কিছুই রক্তদানের জন্য উপযুক্ত নয়। তার উপর বিশেষ মুহূর্ত অতিবাহিত করছে মেয়েটি। এমন অবস্থায় রক্তদান করতে হলো বোনটিকে ?
★ এতগুলো ব্লাড ব্যাংক, এতগুলো সংগঠন, এত পরিচিত ও অপরিচিত মানুষ। এক ব্যাগ রক্ত ম্যানেজ করে দিতে পারলো না ? নিজেও এক ব্যাগ ম্যানেজ করতে পারলাম না।
★ একটি ব্লাড ব্যাংকের ফ্রিজে O- রক্ত স্টোর করে রাখা ছিল। এক ব্যাগ রক্ত দিলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত? অথচ তাদের আমন্ত্রণে আগে কতবার রক্ত দিয়েছি। কতজন ডোনার দিয়েছি এর আগে তাদেরকে।
★ কিছু কি করার নেই ? কিছুই কি করতে পারি না ? ফেসবুক কি শুধুই বিনোদন বা সময় কাটানোর জায়গা। অনেক মানুষই তো ফেসবুক ব্যবহার করে। তাদের মাধ্যমে কিছু করা যায় কি না চিন্তা করে গেছি সন্ধ্যার পর থেকে ফজরের নামাজ পর্যন্ত। ফজরের নামাজের পরে একটি বিষয় মাথায় আসে। কিছু করতে হবে , কিছু করতেই হবে। একটি গ্রুপ খুলবো যার মাধ্যমে রক্তদান এবং রক্তদাতা সংগ্রহের কাজ করে যাবো ইনশা আল্লাহ। গ্রুপের নাম কি দেওয়া যায় ? অনেক ভেবে মাথায় আসে রক্তদান করবো, রক্তদান করাবো এবং মানুষকে রক্তদানের মাধ্যমে আমাদের বন্ধনে আবদ্ধ করবো ইনশা আল্লাহ । সেই চিন্তা থেকেই ২০১৮ সালের ১ লা জুন বাদ জোহর রক্ত বন্ধন – Rokto Bondhon নামকরণের মাধ্যমে মানব সেবায় আমাদের এই পরিবারের পথচলা শুরু হয়।
অনেক ব্যর্থতাই হয়তো সফলতার পথ দেখিয়ে দেয়। হয়তো সেদিনের ব্যর্থতা, ব্লাড ব্যাংকগুলো থেকে বা সংগঠনগুলোর অবহেলা বা সাহায্য করতে না পারাটাই রক্ত বন্ধন পরিবারের পথ প্রদর্শক। হয়তো সেদিনের সেই ব্যর্থতাটা না হলে মানুষের রক্তের প্রয়োজনে পাশে থাকা হতো না এভাবে।
যতদিন কাজ করে যেতে পারবো দোয়া করবেন যেন সততার সাথে এবং সম্মানের সাথে মানুষের সেবায় কাজ করে যেতে পারি। কোন প্রকার অসৎ উদ্দেশ্য যেন মনে জাগ্রত হতে না পারে সেই দোয়া চাই আপনাদের কাছে। অসৎ কিছু মনে বাসা বাঁধার আগে যেন আল্লাহ পাক দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয় এই দোয়া করি এবং আপনাদের কাছে এই একটি দোয়া চাই।
জানি রক্ত কখনও কারও প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারে না। এটা একটা উসিলা মাত্র। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি, যেন ‘বাংলার মাটিতে রক্তের অভাবে কারও প্রাণ চলে গেছে এই অপয়া কথাটি মুছে ফেলতে পারি।”
অন্তত যেন “রক্ত পেলে রোগীটি বেঁচে যেত” এমন কথা বলতে বা এমন আফসোস করতে না পারে কোন মানুষ।
দিনশেষে এতটুকুই বলবো, রক্ত বন্ধন কোন গ্রুপ থেকে বিতাড়িত হয়ে, গন্ডোগোল করে বা অন্য সংগঠনের উপর রাগ বা মতামতে মিল না হওয়ায় বেরিয়ে এসে জন্ম নেওয়া কোন সংগঠন নয়। রক্ত বন্ধন পরিবার বর্ণিত কষ্টদায়ক বাস্তব ঘটনার যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে উদ্ভব হওয়া একটি পরিবার। এখানে অন্যায় এবং দুর্নীতির কোন আশ্রয় নেই। যতদিন বাঁচবো বা যতদিন রক্ত বন্ধন পরিবার থাকবে ইনশা আল্লাহ ন্যায়ের পক্ষে এবং সততার সাথে মানব সেবায় নিয়জিত থাকবে এই পরিবার।
চেষ্টা করেছি, চেষ্টা করে যাচ্ছি। হয়তো অনেকের উপকারে আসতে পেরেছে রক্ত বন্ধন পরিবার। অনেকেরই প্রয়োজনে আমরা সহায়তা করতে পারেনি। তবে আমাদের এই প্রচেষ্টা শুধুমাত্র সফল হতে পারে আপনাদের সহায়তার মাধ্যমেই। আপনার রক্তদান এবং আপনার আহ্বানে নতুন নতুর রক্তদাতার রক্তদানের মাধ্যমেই–
“রক্তের অভাবে একটি প্রাণ ঝরে গেছে”
এই অপয়া কথাটি বাংলার মানুষের মুখ থেকে মুছে ফেলা সম্ভব।
তাই, রক্তদানে যোগ্য এমন সকল ভাই-বোনের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাই। আসুন,
★রক্তদানে সক্ষম সকল ব্যক্তি রক্তদান করি,
★একটি প্রাণ বাঁচানোর উসিলা হই,
★ নিজে রক্তদান করি, অন্যকে রক্তদানে উৎসাহিত করি,
★ প্রতি চার মাস পরপর নিজের স্বাস্থ্য ঠিক আছে কি না নিশ্চিত হই,
সকলে সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন, নিরাপদে থাকবেন এই কামণা করি।