শিশুর এডিনয়েড হাইপারট্রফি রোগ

এডেনয়েড হাইপারট্রফি হচ্ছে একটি নিরব ঘাতক রোগ। ন্যাসোফ্যারিংক্সে থাকা একটি লিম্ফয়েড টিস্যুকে মূলত এডিনয়েড বলা হয়। ন্যাসোফ্যারিংক্স বলা হয় নাকের ঠিক পিছনের অংশ এবং আলা জিহ্বার ঠিক উপরের অংশটিকে। এই অংশটিকে সাধারণত বাহির থেকে সরাসরি দেখা যায় না। এই অংশটিকে যন্ত্রের মাধ্যমে দেখতে হয়।
এডেনয়েড বড় হয়ে গেলে এই পরিস্থিতিকে বলা হয় এডেনয়েড হাইপারট্রফি। এডেনয়েড হাইপারট্রফি হলে বাচ্চার শ্বাস প্রশ্বাসের অসুবিধাসহ আরও নানা ধরণের শারিরীক সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ২ থেকে ৩ জন শিশু এডেনয়েড হাইপারট্রফিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে।

এডেনয়েডের কাজ কিঃ

এন্টিবডি তৈরীর মাধ্যমে এডেনয়েড শিশুদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী করে থাকে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে ৪ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এডেনয়েড অপারেশনের মাধ্যমে সরিয়ে ফেললে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার খুব একটা পরিবর্তন হয় না।

এডেনয়েড হাইপারট্রফির লক্ষণ সমূহঃ

এডেনয়েড হাইপারট্রফির বেশ কিছু লক্ষণ শিশুর মাঝে দেখা যায়। এই লক্ষণগুলো দেখা মাত্র দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিতে হবে। লক্ষণগুলো হলো-

১. নাক বন্ধ থাকা। নাক বন্ধ থাকার কারণে এই সময় বাচ্চারা মুখ হা করে শ্বাস নেয়। এবং বাচ্চাদের খাওয়া দাওয়ায় সমস্যা হয়। এর প্রভাবে বাচ্চাদের শারীরিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়।
২. সাইনাসের প্রদাহ,
৩. নাক দিয়ে পানি পড়া,
৪. গলার স্বর পরিবর্তন: কন্ঠস্বর কিছুটা মোটা মনে।হয় এবং আনুনাসিক শব্দ উচ্চারণ করতে অসুবিধা হয়।
৫. বারবার কান পাকাপাকা,

স্বাভাবিক এডিনয়েড ও এডিনয়েড হাইপারট্রফির নমুনা।

৬. কানে পানি যাওয়া। পানি জমার কারণে শিশুদের শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া।
৭. নাক দিয়ে রক্ত পড়া।
৮. গলা ব্যথা ও কাশি হওয়া।
৯. খাবার গিলতে অসুবিধা হওয়া।
১০. কথা বলায় অসুবিধা হওয়া।
১১. পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে যাওয়া।
১২. অনুনাসিক জমাট বাঁধা।

এডেনয়েড হাইপারট্রফির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিসমূহঃ

১. শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া,
২. কানের পর্দা ভেতর দিকে চলে যাওয়া। এর ফলে কোলোস্টিটোমা তৈরী হয়, যা পরবর্তীতে ব্রেইন পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে।
৩. দীর্ঘদিন শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যার কারণে হার্ট ফেইলর হতে পারে।
৪. চেহারার আকৃতি পরিবর্তন হয়ে যাওয়া। নাক এবং উপরের ঠোঁট কিছুটা ছোট হয়ে যাওয়া এবং উপরের তালু উঁচু এবং গভীর হয়ে যেতে পারে।
৫. স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি ব্যহত হওয়া।

এডিনয়েড সমস্যার কারণঃ

এডিনয়েড সমূহ অনুনাসিক গহ্বরের পিছনে অবস্থিত ইমিউন সিস্টেমের একটি অংশ। এগুলো সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে থাকে। বিশেষ করে শিশুদের ইমিউন সিস্টেমের জন্য লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এডিনয়েড। যদিও এডিনয়েড বৃদ্ধির সঠিক কারণ সবসময় পরিষ্কারভাবে নির্ণয় করা এখনও সম্ভব হয়নি, তবে বেশ কিছু কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছে যা এডিনয়েড বৃদ্ধি বা এডিনয়েড জনিত সমস্যা সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারে। কারণগুলো হচ্ছে-

সংক্রমণঃ শিশু বারবার বা দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ, যেমন শ্বাসযন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাল সংক্রমণ, এডিনয়েড সমূহের প্রদাহ এবং এবং ফোলা ভাব সৃষ্টি হতে পারে। এই সকল সংক্রমেনের মধ্যে সাধারণ সর্দি, কানের সংক্রমণ বা সাইনাসের সংক্রমণ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
বয়সঃ প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে এডিনয়েড বড় হতে থাকে। সাধারণত ৫ বছর বয়স পর্যন্ত এডিনয়েড বৃদ্ধি পায়। এরপর ধীরে ধীরে এডিনয়েড সমূহ সঙ্কুচিত হতে শুরু করে। প্রাপ্ত বয়স্কদের দেহে এডিনয়েড বৃদ্ধি পাওয়ার হার খুবই রেয়ার ও নগণ্য।
এলার্জিঃ ধূলিকণা, পরাগ, ছাঁচ বা পোষা প্রাণীর লোম বা খুশকির মতো পদার্থে এলার্জি থাকলে তা এডিনয়েডকে বর্ধিত বা স্ফীত করতে সক্ষম।
দীর্ঘস্থায়ী সাইনোসাইটিসঃ সাইনাসের সংক্রমণ একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্থায়ী হলে সেই সংক্রমণের প্রভাবে এডিনয়েড বৃদ্ধি পেতে পারে।
ধুমপানের প্রভাবঃ প্যাসিড ধুমপান বা সেকেন্ডহ্যান্ড ধুমপানের (একাধিক ব্যক্তির একটি জিনিসেই ধুমপান বা একটি বস্তুকে কয়েকবার ধুমপান) ফলে এডিনয়েড হাইপারট্রফি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
গ্যাস্ট্রোসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD):
এসিড রিফ্লাক্সের প্রভাবে গলায় জ্বালাতন হতে পারে। এবং এডিনয়েডের প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে।

এডেনয়েড হাইপারট্রফির চিকিৎসাঃ

প্রাথমিকভাবে নাকের স্প্রে এবং মুখের কিছু ঔষধের মাধ্যমে এডেনয়েডের আকার কমানো এবং এই রোগের লক্ষণগুলো সাময়িকভাবে কিছুটা নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হচ্ছে। তবে পরিপূর্ণ বা চিরদিনের জন্য মুক্তি পেতে অপারেশনের মাধ্যমে এডেনয়েড অপসারণ করার বিকল্প অন্য কিছু এখনো আবিষ্কার হয় নাই।

অভিভাবকদের করণীয়ঃ

এডিনয়েড হাইপারট্রফির লক্ষণগুলো যদি কোনো শিশুর মধ্যে দেখা যায়, তাহলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের স্মরণাপন্ন হয়ে তার পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করানো উচিত। এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জরুরী। কারণ এডেনয়েড হাইপারট্রফিতে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন এই রোগে ভুগলে অপারেশনের পরেও এই রোগের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলো সারিয়ে তোলা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই অপেক্ষা বা অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করাটা খুব বেশি প্রয়োজন।

আরও পড়ুনঃ আপনার শিশু ADHD রোগে আক্রান্ত নয়তো। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *