মুসলিম উম্মাহর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনের একটি কোরবানির ঈদ। এই ঈদে নির্ধারিত কিছু গৃহপালিত পশু আল্লাহর হুকুমে কোরবানি করে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে। আর কোরবানি করা পশুর মাংস খাওয়ার পরিমাণও বেড়ে যায় আমাদের। শুধু মাংসই নয়, সাথে পোলাও, বিরিয়ানি, ভাতসহ নানা ধরনের ভারি খাবার খেয়ে থাকে মানুষ। আবার কোরবানির ঈদের পরপরেই আমাদের সমাজে বিয়ে ও নানান অনুষ্ঠানের হিড়িক পড়তেও দেখা যায়। আর এসকল অনুষ্ঠানে খাওয়া দাওয়ার ফলেই অনেকে সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগে থাকেন। আর এর ফলে কিছুদিন বেশ কষ্টের মধ্য দিয়েই যেতে হয় কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভোগা মানুষদের। এই সমস্যার কারণ কি? আর প্রতিরোধের উপায়ই বা কী? আজকের আলোচনায় থাকছে এই বিষয়।
কোষ্ঠকাঠিন্য কি?
কোষ্ঠকাঠিন্য বিষয়টি একএকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম অর্থ বহন করে। মূলত কোষ্ঠকাঠিন্য হচ্ছে খুব শক্ত মলত্যাগ হওয়া, সপ্তাহে ৩ বারের কম মলত্যাগ হওয়া আবার মলত্যাগে প্রচুর সময় ব্যয় হওয়াকে বোঝায়। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে পায়খানা করার পরেও মনে হয় মলাশয় বা পেট এখনও খালি হয়নি।
কোষ্ঠকাঠিন্য মূলত ২ ধরণের।
একটি হচ্ছে সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য এবং অপরটি ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য।
সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য:
কোন ব্যক্তির শরীরে যদি অল্প কিছুদিনের জন্য কোষ্ঠকাঠিন্যতার উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে তাকে বলা হয় সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য। এ ধরণের কোষ্ঠকাঠিন্যের উপসর্গ মূলত রোগীর শরীরে ৩ মাসের কম সময় পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে।
কোনো অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত পরিমাণে মাংস, পোলাও বা ভারী খাবার খেলে দেখা যায় ২-৩ দিন মলত্যাগ হচ্ছে না, বা খুব শক্ত আর অল্প মলত্যাগ হচ্ছে। তাহলে বুঝে নিতে হবে এমন উপসর্গ দেখা দেওয়া মানুষটি সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছে। এই উপসর্গ মানুষের মাঝে ৩ দিন থেকে ৩ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হলে এটিকে সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
আর যদি কোন মানুষের এই উপসর্গ ৩ মাসের বেশি সময় বা বছরের অধিকাংশ বা সবসময় বিরাজমান থাকে, তাহলে সেই মানুষটি ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্যে আক্রান্ত বলে বিবেচনা করা হবে।
অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সারা বছর সুস্থ থাকলেও কোরবানি ঈদ ও এর পরের কিছুদিন অতিরিক্ত মাংস এবং ভারী খাবার খাওয়ার কারণে মলত্যাগ হয় না। যার ফলে তার পেট ফুলে যায়, খাবার খেতে পারে না, সবসময় মনে হয় পেট ভরে আছে। অনেকেই মনে করে থাকেন, গ্যাসের সমস্যার কারণে এমনটা হচ্ছে। তবে এই ধারণাটা সঠিক নয়। মূলত সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। আর এর প্রভাবে পেটে গ্যাস সৃষ্টি হয়।
সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যে আক্রান্ত হওয়ার কারণ কীঃ
অ্যাকচু কনস্টিপেশন বা সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যতা মূলত ভুল জীবন-যাপন ও পুষ্টিকর খাবার না খাওয়ার কারণে হয়ে থাকে। হতে পারে-
★ নিয়মিত মলত্যাগ না করা বা মল আটকে রাখা,
★ নিয়মিত খাবার না খাওয়া,
★ আঁশযুক্ত খাবার এবং শাক-সবজি কম খাওয়া বা না খাওয়া,
★ পরিমিত না ঘুমানো,
★ IBS পজেটিভ বা পুরাতন আমাশয়ের সমস্যা থাকা,
★ চিন্তা বা অবসাদগ্রস্থ থাকা,
★ দৈনিক অত্যাধিক পরিমাণ প্রোটিন বা অতিরিক্ত মাংস খাওয়া,
★ ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যেমন: ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার, এন্টি ডায়েরিয়াল ড্রাগস, আয়রন ট্যাবলেট, এন্টি স্পাজমোডিক, এলুমিনিয়ামযুক্ত অ্যান্টাসিড সেবনের ফলে সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যতা দেখা দিতে পারে।
সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ কী কীঃ
১. মলত্যাগের সাধারণ রুটিনে পরিবর্তন ঘটা,
২. পেট ফুলে থাকা,
৩. পেটে ব্যথা থাকা বা থাকতে পারে
৪. কিছুক্ষণ পরপর বায়ু ত্যাগ করা,
৫. শক্ত মলত্যাগ,
৬. মলত্যাগের সময় মলাশয় ও পায়ুপথে ব্যথা,
৭. মলত্যাগের সময় জোর প্রয়োগ করতে হয় ও অনেক সময় ব্যয় হওয়া,
৮. পরিমাণে কম মলত্যাগ হওয়া,
৯. পেট ফুলে থাকা,
১০. খাবারে অরুচি,
১১. বমি বমি ভাব বা গা গোলানো অনুভব হতে পারে,
১২. দুশ্চিন্তা ও অবসাদগ্রস্ত মনে হতে পারে,
১৩. অস্বস্তি ও কম ঘুম হতে পারে,
১৪. উপরের কারণগুলোর প্রভাবে স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যঘাত ঘটা।
সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে যে সকল জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে-
কোষ্ঠকাঠিন্যকে অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ স্বাভাবিক মলত্যাগ করা না হলে আমাদের দেহে টক্সিন বা বর্জ্য পদার্থ জমা হতে থাকে। আর এর প্রভাবে নানা ধরণের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে-
১. এনাল ফিস্টুলা হতে পারে,
২. ইউরিনারি ইনকন্টিন্যান্স বা প্রস্রাবে অনিয়ম দেখা দিতে পারে।
৩. হেমোরয়েড বা পাইলস: এক্ষেত্রে পায়ুপথের আশেপাশের রক্তনালিগুলোতে প্রদাহ ও ব্যথা হতে পারে। ফলে মলত্যাগ করার সময় পায়ুপথ দিয়ে রক্ত বের হওয়া, ব্যথা হওয়া এবং পায়ুপথে চুলকানি হতে পারে।
৪. পর্যাপ্ত পরিমাণে মলত্যাগ না হওয়া কোলন ক্যান্সারের অন্যতম কারণ বলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রমাণ মিলেছে।
সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধের উপায়ঃ
সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করতে আপনাকে প্রথমেই ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে না। আপনি নিজেই এই সমস্যা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন। এজন্য আপনাকে কিছু কাজ ও খাবার গ্রহণ ও ত্যাগ করতে হবে। প্রতিরোধের উপায়গুলো হচ্ছে-
১. কিছুদিনের জন্য মাংস ও প্রোটিনযুক্ত খাবার ত্যাগ বা পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে,
২. প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করতে হবে,
৩. প্রতিদিন পর্যাপ্ত শাক-সবজি খেতে হবে,
৪. ফাস্টফুড ও রীচফুড জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে।
৫. বাহিরের ভাজাপোড়া খাবার পরিহার করতে হবে একেবারেই। বাসায় তৈলাক্ত খাবার রান্না করলেও পরিমাণে কম খেতে হবে,
৬. দৈনিক ১০০-১৫০ গ্রামের বেশি মাংস খাওয়া যাবে না,
৭. নিয়মিত ইসবগুলের ভুসি খেতে হবে,
৮. সম্ভব হলে প্রতিদিন আপেল খাবেন। আপেলে পর্যাপ্ত ফাইবার পাবেন,
০৯. যেদিন খাবারে মাংসের পরিমাণ বেশি থাকবে সেদিন শাক-সবজি, শসা, গাজর ও টমেটোও খাবেন বেশি করে,
১০. পাকা পেঁপে, পাকা তেঁতুল পায়খানা নরম করতে দারুণ কাজ করে। তবে যাদের লো প্রেসার ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে তেঁতুল খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করবেন,
১১. নিয়মিত ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে।
১২. এসময় কাচা কলার তরকারি খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন,
১৩. তিনবেলা এক গ্লাস পানিতে ২ টেবিল চামচ ইসবগুলের ভুসি পানিতে মিশিয়ে শরবত করে খান। এতে করে কোলনের মধ্যে কিছু পরিমাণ পানি রিটেনশন হবে এবং পায়খানা নরম হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত ইসবগুলের শরবত খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
“তবে আমাদের দেশে যে নিয়মে ইসবগুলের শরবত খাওয়ার প্রচলন আছে সেটি সঠিক নয়। ইসবগুলের ভুসি সরাসরি মুখে নিয়ে তারপর পানি পান করা বা পানিতে ইসবগুল মিশিয়ে সাথেসাথে পান করাটা হচ্ছে সঠিক নিয়ম। “
এভাবে ইসবগুলের ভুসি খেলে এটি পেটের মধ্যে গিয়ে নিজে ভিজার পাশাপাশি পায়খানাকে নরম করতে সাহায্য করে। চেষ্টা করবেন এই মিশ্রনে চিনির ব্যবহার না করতে। শুধু পানি ও ইসবগুল মিশিয়ে পান করাটাই শ্রেয়।
ঈদ বা যেকোন উৎসবে পরিমিত এবং সুষম খাবার গ্রহণ করুন। হঠাৎ করে অতিরিক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। হঠাৎ করে অতিরিক্ত খাবার খেলে শরীর খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে মাংস ও চর্বিযুক্ত খাবার খেলে হাই প্রেসার ও হার্টের সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। অল্প অল্প করে খাদ্য গ্রহণ করলে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকে। আপনার অসুস্থতা আপনার ও আপনার পরিবারের দুশ্চিন্তা ও আনন্দ মাটি করে দেওয়ার কারণ না হোক এটাই আমাদের চাওয়া। সকলের উৎসব হোক প্রানবন্ত ও আনন্দময়।