স্ট্রোক কী?
স্ট্রোক হচ্ছে মস্তিষ্কের রক্তনালীর একটি ভয়ানক রোগ। রক্তচাপের কারণে রক্তনালি ছিঁড়ে যাওয়া অথবা ব্লক হয়ে যাওয়াই স্ট্রোকের কারণ।
স্ট্রোক দু’ধরনের-
১. রক্তনালি ছিঁড়ে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। একে বলে হেমোরেজিক স্ট্রোক। এবং,
২. রক্তনালি ব্লক হয়ে গিয়ে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত রক্ত না যাওয়া এবং ওই অংশের শুকিয়ে যাওয়া। একে বলে ইস্কেমিক স্ট্রোক।
কেন স্ট্রোক হয়?
সাধারণত কিছু ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে অনেকদিন ধরে ধীরে ধীরে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, হাই-প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপ, হাই-কোলেস্টেরল এই রোগের কারণ। এগুলোর সাথে ধূমপান, পারিবারিক স্ট্রোকের ইতিহাস, হার্টের অসুখ যেমন- অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, রক্তজমাট বাঁধা অসুখ, ক্যান্সার, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ইত্যাদি আরও অনেক কারণে স্ট্রোক হতে পারে।
আবার অনেক সময় পূর্বের কোন রোগ বা লক্ষণ ছাড়াও হঠাৎ করেই স্ট্রোক করতে পারে যে কোন মানুষ।
হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, জন্মগত রক্তনালির গঠনগত সমস্যা, জন্মগত এনজাইমের সমস্যা, মেটাবলিক সমস্যা ইত্যাদিও স্ট্রোকের কারণের মধ্যে অন্যতম।
শুধু বয়স্কদের নয়, বর্তমানে তরুণ বা যুবকদেরও স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। এবং বর্তমানে যুবকদের স্ট্রোক হওয়ার পরিমাণও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্ট্রোকের লক্ষণঃ
সবসময় সবধরনের স্ট্রোকের লক্ষণ একই ধরণের হয় না। কী ধরনের স্ট্রোক হয়েছে, কী কারণে হয়েছে, মস্তিষ্কের কোন অংশে হয়েছে এসবের ওপর ভিত্তি করে লক্ষণ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে প্রাথমিক কিছু লক্ষণ থেকে বুঝা যায় রোগীটি স্ট্রোক করেছে। সেই লক্ষণগুলো হচ্ছে-
♦ শরীরের কোন একদিকে দুর্বলতাবোধ করা বা এক পাশের হাত বা পা নাড়াতে না পারা,
♦ হাত-পায়ে অবশ অবশ অনুভব করা,
♦ মুখ একদিকে বাঁকা হয়ে যাওয়া,
♦ মুখে খাবার বা পানি দিলে গড়িয়ে পড়ে যাওয়া,
♦তীব্র মাথা ব্যথা,
♦ কথা অস্পষ্ট বা বুঝা না যাওয়া,
♦ বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া,
♦ চোখে কম দেখা,
♦ কথা জড়িয়ে যাওয়া বা মুখে অসাড়তা ভাব,
♦ হাঁটাচলায় বেসামাল হয়ে যাওয়া,
♦ ব্যক্তি বা কোনকিছু চিনতে পারছে না ,
♦ আজেবাজে বা অস্বাভাবিক কথা বলা,
♦ হঠাৎ আচরণে অস্বাভাবিক পরিবর্তন। যেমন- অকারণে বিরক্ত হয়ে চিল্লাচিল্লি করা অথবা একদম চুপচাপ হয়ে যাওয়া,
♦ হঠাৎ খিঁচুনি বা ধপ করে পড়ে যাওয়ার ইত্যাদি।
এগুলো হওয়া মানেই যে স্ট্রোক এমনটি কিন্তু নয়। আরও অনেক কারণে এমন সমস্যা হতে পারে। তবে কারও মাঝে এ ধরনের কোন লক্ষণ দেখা দিলে রোগী স্ট্রোক করেছে বা করতে পারে এমনটা ধারণা করে দ্রুত চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতে হবে। আর অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
স্ট্রোক হলে করণীয়
সচেতনতা এবং প্রাথমিক কিছু কাজ রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা কমিয়ে দিতে পারে। পাশাপাশি স্ট্রোকের রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। পরিবারের কোন সদস্যের স্ট্রোক হলে ভয় লাগাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ সময় উদ্বিগ্ন ও ভীত না হয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে নিচে উল্লেখিত কাজগুলো করতে পারলে রোগীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে। কাজগুলো হচ্ছে-
♦ রোগীকে কাত করে শুয়ে দিতে হবে। এ পরিস্থিতিতে কোন ধরণের খাবার বা ওষুধ আক্রান্তের মুখে দেওয়া যাবে না। কারণ এসময় এগুলো শ্বাসনালিতে ঢুকে গিয়ে রোগীর আরো ক্ষতি করতে পারে।
♦ স্ট্রোকের সময় রোগীর রক্তচাপ অনেক বেড়ে যায়। এসময় অনেকেই প্রেসার কমানোর জন্য রোগীর মাথায় বা ঘাড়ে পানি বা ঠান্ডা পানি দিয়ে থাকেন। এই কাজটি রোগীর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ও মৃত্যুর কারণ। স্ট্রোকের কারণে এমনিতেই রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে স্নায়ু ফেটে রোগীর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। স্বাভাবিক মানুষের মাথায় প্রথমেই পানি দিলেও রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে মস্তিষ্কের রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয়। স্ট্রোকের সময় এমনটা করলে রোগীর মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি রক্ত ক্ষরণের পরিমাণও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আর এর ফলে মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার পরিমাণও বেড়ে যায়।
♦ মুখে জমে থাকা লালা, বমি এসব পরিষ্কার করে দিতে হবে।
♦ গায়ে থাকা জামা-কাপড় ঢিলা করে দিতে হবে বা খুলে দিতে হবে।
♦ রোগীকে অতি দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এবং হাসপাতালে যাওয়ার সময় মনে করে রোগীর আগের চিকিৎসার ফাইলপত্র (যদি থাকে) নিতে হবে।
এসময় রোগীকে কোন ধরনের ঔষুধপত্র নিজ থেকে দিবেন না। কারণ স্ট্রোক হেমোরেজিক না ইস্কেমিক আপনি জানেন না। ঔষুধ প্রদানে উপকারের বিপরীতে রোগীর ক্ষতি হতে পারে। মুখে কিছু খাওয়াতে যাবেন না, এমনকি পানিও না। কারণ এমন সময় খাবার ও পানি তার শ্বাসনালিতে আটকে যেতে পারে। এতে করে শ্বাসকষ্ট হতে পারে অথবা লাঙ্কে ইনফেকশন করতে পারে। যা রোগীর জন্য খুবই ক্ষতিকর।
আর গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ভাইরাল পোস্ট পড়েছেন “সুঁই দিয়ে আঙ্গুল ফুটো করে দিতে হবে ” এই কাজটি ভুলেও করবেন না।
এতে রক্তক্ষরণ থেকে রোগী আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে। আবার ক্ষতের জায়গায় ইনফেকশন হয়ে রক্তে ছড়িয়ে সেপটিসেমিয়া হয়ে যেতে পারে রোগীর। আবার রোগীর শরীরের ডিফেন্স মেকানিজমে রক্তনালি সংকুচিত হয়ে স্ট্রোকের ফলাফল আরও খারাপ হতে পারে।
স্ট্রোকের চিকিৎসায় হাড় ছিদ্র করে বারহোল সার্জারির কথা বলা হয়েছে। অনেকে এই চিকিৎসার সাথে হাতে সুঁই ফোটানোকে গুলিয়ে ফেলেছে। বারহোল করে মস্তিষ্কের জমাট রক্ত সরানো হয়। যা মস্তিষ্কের একটি অংশে চাপ বেঁধে থাকা রক্ত বের করে দেয়।
হাত, পা, কান ফুটো করে কয়েক লিটার রক্ত বের করেও মস্তিষ্কের এই জমাট রক্ত কমানো সম্ভব না। যদি বের করতেই হয় তবে মাথার হাড় ফুটো করতে হবে। আর এই বিষয়ে একমাত্র চিকিৎসকই সিদ্ধান্ত দিতে পারেন এবং দক্ষ সার্জনই এই কাজটি করতে পারেন।
★ যে সকল টেস্ট করাবেনঃ
স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে জরুরি ভিত্তিতে ব্রেইনের রেডিওলজিক টেস্ট, সিটিস্ক্যান, এমআরআই করতে হবে। ঘাড়ের রক্তনালির ডপলার, হার্টের সমস্যার জন্য ইকো পরীক্ষা করাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোগীর রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতাও পরীক্ষা করে নিতে হবে। আবার প্রয়োজনে এনজিওগ্রাম ও ইকোকার্ডিওগ্রাফি পরীক্ষাও করতে হবে।
★ চিকিৎসাঃ
স্ট্রোক হলে যেহেতু মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যায় এবং কম রক্ত প্রবাহ নিয়ে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না, সুতরাং আক্রান্ত ব্যক্তির তাৎক্ষণিক চিকিৎসা শুরু করতে হয়। ঔষুধ প্রয়োগ করে রক্তের চাপ, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতে হবে। রক্ত জমাট বাঁধা অবস্থা কাটিয়ে তোলার জন্য তাৎক্ষণিক চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
প্রাথমিক ধাপ কাটিয়ে ওঠার পর দীর্ঘদিন ফিজিওথেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। তাই স্ট্রোক হয়েছে বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বিলম্বে চিকিৎসা নিলে জটিলতা বাড়ে এবং রোগী মারাও যেতে পারে।
★ প্রতিরোধ ও করণীয়
♦ নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করতে হবে,
♦ কেউ হাই প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপের রোগী হলে চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত ঔষুধ খেতে হবে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঔষুধ বন্ধ করা যাবে না।
♦ ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে ত্যাগ করতে হবে।
♦ নিয়মিত হাঁটা ও হালকা ব্যয়াম করা শরীর ও হার্টের জন্য ভালো।
♦ দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করতে হবে।
♦ মানসিক চাপ পরিহার করে চিন্তামুক্ত থাকতে হবে।
♦ ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
♦ মনে রাখতে হবে, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশ কমে যায়।
জানুন:
-রুমেল রহমান
roktobondhon.com
Pingback: জন্ডিস আক্রান্ত? কিভাবে মুক্তি পাবেন - রক্ত বন্ধন - Rokto Bondhon