রক্তদাতা নয়, মানবতার আদর্শ কান্ডারী তিনি

কেন তাঁকে আদর্শ কান্ডারী বললাম ?

প্রথমেই বলি,

★ কাউকে ছোট করে দেখবেন না।

★ কারও পোশাক, চলাফেরা বা জীবন যাপন দেখে তাঁকে যাচাই করতে যাবেন না।

★ সকলের কথায় সমান গুরুত্ব দিবেন।

জানুন কে এই মানবতার কান্ডারী আর কি তাঁর পরিচয় ।। 

পরিচয়ঃ

নামঃ মোসাঃ টুলি বেগম

বয়সঃ ৪০

রক্তের গ্রুপঃ দুর্লভ বি নেগেটিভ

পেশাঃ ভ্যানে বাচ্চাদের খেলনা বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ।

কিভাবে পরিচয়ঃ 

রমজান মাসের এক রাতে এশার নামাজ পড়ে বের হয়েছি ঠিক তখনই জরুরী ভিত্তিতে এক্সিডেন্টে দুই পায়ের হাড় কয়েক টুকরো হয়ে যাওয়া রোগীর জন্য দুর্লভ O Negative রক্তের প্রয়োজনে কল আসে আমার কাছে।

রমজান মাসে রক্তদাতা পাওয়াটা একটু কষ্টকর হয়ে যায়। কারণ, সারাদিন রোযা রেখে রক্তদান করলে শরীর দুর্বল বা খারাপ হয়ে যাবে এমন ভ্রান্ত ধারণা অনেকের মাঝেই কাজ করে। ইমার্জেন্সি রক্ত লাগবে এমন তথ্যের ভিত্তিতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম এবং একের পর এক O Negative রক্তদাতাকে কল দিচ্ছিলাম। সকলের নিকট থেকে ভ্যাক্সিন নিয়েছি, সময় হয় নি, ঈদের পরে দিব বা গ্রামের বাসায় আসছি এমন উত্তর আসছিল।

ফোনকলে যখন ব্যস্ত ছিলাম টুলি খালা রাস্তার অপর পাশ দিয়ে আসছিলেন তার ভ্যানটি ঠেলে ঠেলে। জিজ্ঞেস করেন কি রক্ত লাগবে? আমি ততটা গুরুত্ব না দিয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে অনেক দূর চলে আসি। খালা আবার পিছ থেকে বলে উঠে কি রক্ত লাগবে? আমার সাথে থাকা বন্ধু তখন আমাকে বলে পিছন থেকে জিজ্ঞেস করছে কি রক্ত লাগবে? খালাকে প্রথম লক্ষ্য করি তখন। ততটা গুরুত্ব না দিয়ে বলি O Negative রক্ত।

তিনি সাথে সাথে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেন আমার স্বামীর রক্ত O Negative . তার নাম্বার দিচ্ছি কল দেন। যদিও তার স্বামীর রক্তের গ্রুপ ছিল O Positive . ভুল গ্রুপিংয়ের কারণে তারা জানতেন O Positive . এরমাঝে আমি আরেকজন রক্তদাতাকে কল দিলে তিনি রক্তদানে প্রস্তুত বলে জানান আমাকে।

এরপর খালা আমাকে যা বলেন এবং দেখান তাতে আমি বিস্মিত ও অবাক হয়ে যাই। আর দারুণ এক শিক্ষা পাই এখান থেকে। শিক্ষাটি হচ্ছে, ” কখনই কাউকে ছোট করে দেখা যাবে না। সে যত ছোট পেশায় কাজ করুন না কেন বা যেভাবেই জীবন যাপন করুন না কেন। ” আল্লাহ পাক প্রতিটি ব্যক্তিকেই কারও না কারও উপকারের জন্য তৈরি করে রেখেছেন। আমি কাউকে গ্রাহ্য না করলে সেই উপকার আমার কারণেই ব্যহত হয়ে থাকবে। ”

কেন এই শিক্ষা পেলাম জানেন ?

খালা আমাকে বলেন তাঁর রক্তের গ্রুপ দুর্লভ B Negative এবং তিনি একজন Active Citizen . এছাড়াও বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। অত:পর তিনি তার ব্লাড গ্রুপিং কার্ড দেখান। তিনি আরও জানান, তাঁর এক মেয়ের ব্লাড গ্রুপ দুর্লভ AB Negative, আরেকজনের AB Positive , দুই ছেলের এক ছেলের  দুর্লভ B Negative অপরজনের B Positive . আর নাতির রক্তের গ্রুপ দুর্লভ A Negative .  রক্তের প্রয়োজনে তাঁকে যেন কল দেই। তিনি রক্তদানে প্রস্তুত।

অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম সে রাতে তার দিকে। আর চিন্তা করছিলাম যাকে গ্রাহ্যই করিনি তার কার্যক্রম আমার থেকে কতটা উপরে এবং কতটা বিস্তৃত। শিক্ষা নিলাম আর জজ থেকে ফকির সকলের কথা সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করলাম।

আজ রক্তদানের পরে খালা আরও মহৎ একটি কাজ করেছেন সেই বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন। এটি শোনার পরে মনে হয়েছে আগের সব তথ্য বা কাজ এই মহৎ কজের কাছে অতি নগণ্য। তবে এই কাজটি কি তা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন। আমিও তাঁকে অনুরোধ করেছি, এই মহৎ কাজে যদি কখনও কোন প্রতিবন্ধকতা আসে বা কোন প্রয়োজন হয় আমাকে জানাতে। আমি সারাজীবন প্রস্তুত আছি সর্বোচ্চটা দিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াতে। 

কাকে রক্তদান করলেনঃ

পাবনার রোগীকে রেফার্ড করা হয়েছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পেটে বাচ্চার বয়স ৬ মাস বয়সে মারা যাওয়ায় বের করা হয়েছিল পাবনায়। কিন্তু পেটে থেকে গিয়েছিল গর্ভফুল। এভাবে দুই মাস অতিবাহিত হওয়ার পরে রোগীর ব্লিডিং শুরু হয়। ডাক্তার এক্স-রে ও আল্ট্রাসনোগ্রাম করে অবস্থা খারাপ বুঝে রাজশাহীতে পাঠিয়ে দেয়। রাজশাহীতে ভর্তি হওয়ার পরে ডাক্তার জরুরী ভিত্তিতে DNC অপারেশনের কথা বলেন। কিন্তু রক্তদাতা না পাওয়ায় অপারেশন পিছিয়ে দেয় পরপর দুইবার। দ্রুত DNC না করালে রোগীর জীবন সংকটাপন্ন এমন শঙ্কার কথাও জানায় ডাক্তার। ফোন করি টুলি খালাকে সন্ধার পরে। খুলে বলি বিষয়টা। তিনি বলেন, আমি মাল গুছিয়ে আসছি ১ ঘন্টার মধ্যে।

রক্তদানের সময় খালার পাশে আমাদের উপস্থিতি।

চলে আসেন ব্লাড ব্যাংকে। রক্তদান করেন রোগীটিকে প্রাণনাশের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে সুস্থ করার জন্য। আর রক্তদান করতে করতে বললেন ‘যখন শুনি মেডিকেলে কোন রোগী এসেছে কিন্তু পাশে থাকার মত কেউই নেই। চলে আসি মেডিকেলে। দিন রাত পাশে থাকি তাদের। শুধু আমিই না, আমার ছেলে আর মেয়েও চলে আসে আমার সাথে রোগীর সেবা করতে।

কতটা মহৎ ও মহান মনের মানুষ সেটা নিয়েই চিন্তা করছিলাম। চিন্তা করছিলাম কতটা উদার ও কর্মনিষ্ঠ হতে হবে আমাকে। আমার কাজ নিয়ে গর্ব করতে শুরু করেছিলাম। হয়তো অহংকারও। টুলি খালা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে এবং শিখিয়ে দিলেন আমি কতটা নগণ্য। কতখানি কাজ ও উদারতার ঘাটতি আমার মাঝে রয়েছে।

দোয়া করবেন যেন টুলি খালার মত একজন প্রকৃত স্বেচ্ছাসেবী এবং মানুষ হয়ে তবেই এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *