নিউরোব্লাস্টোমা নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি।

পূর্বের পোস্টে নিউরোব্লাস্টোমা কি এবং এর লক্ষণ ও কারণ সম্পর্কে লিখেছিলাম। আজ জানাবো এই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্পর্কে। আসুন জানার চেষ্টা করি এই রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে।

রোগ নির্ণয় ( Diagnosis): 

নিউরোব্লাস্টোমা রোগটি নির্ণয়ের জন্য ডাক্তারগণ কিছু পরীক্ষার দিয়ে থাকেন। এসব পরীক্ষার মাধ্যমেই নির্ণয় করা যায় আক্রান্ত শিশু নিউরোব্লাস্টোমায় আক্রান্ত কি না। পরীক্ষাগুলো হচ্ছে-

★ শারীরিক পরীক্ষা (Physical Test):

রোগীর লক্ষণগুলো জানার পরে লক্ষণের উপর নির্ভর করে ডাক্তার কিছু শারীরিক পরীক্ষা করবেন। শিশু বা আক্রান্ত বাচ্চার আচরণ এবং অভ্যাস সম্পর্কে পিতা-মাতাকে জিজ্ঞেস করবে। আচরণ ও অভ্যাস সম্পর্কে জানার পরে আরও কিছু পরীক্ষা করতে দিবেন।

★ রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা (Blood and Urine Tests):
আক্রান্ত শিশুর আচরণ ও অভ্যাস সম্পর্কে জানার পরে ডাক্তার শিশুর রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করার পরামর্শ করতে দিবেন। এই পরীক্ষাগুলো সন্তানের নিউরোব্লাস্টোমা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

★ ইমেজিং টেস্ট (Imaging Tests):

এমআরআই (MRI), সিটি স্ক্যান (CT Scan), এমজিবিজি স্ক্যান (MGBG Scan) এবং এক্স-রে (X-RAY) এর মত ইমেজিং টেস্টের মাধ্যমে আক্রান্ত শিশুর টিউমার, টিউমারের অবস্থান, টিউমারের আকার এবং টিউমার কোন পর্যায়ে আছে তা নির্ণয় করা হয়। আবার কোষগুলো টিউমারে রুপ নিয়েছে, নাকি পিন্ড হয়ে আছে সেটি নির্ণয় করা হয় এই ইমেজিং টেস্টগুলোলোর মাধ্যমে।

★ বায়োপসি (Biopsy):

শরীরে যদি কোন টিউমার পাওয়া যায়, তাহলে সেই টিউমারটি টিউমারে রুপান্তরিত হয়ে আছে, নাকি ক্যান্সারের দিকে ধাবিত হয়েছে তা নির্ণয়ের জন্য ডাক্তার বায়োপসি টেস্ট করতে দিবেন। বায়োপসির মাধ্যমে টিউমার বা ক্যান্সারের ধরণ নির্ণয় করা সম্ভব। আবার ডাক্তার টিউমারের পাশাপাশি সন্তানের বোনম্যারোর নমুনা সংগ্রহ করতে পারে। কারণ ক্যান্সার সন্তানের হাড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে কি না তা নির্ণয় করার জন্য অস্থিমজ্জা বা বোনম্যারোর টিস্যু পরীক্ষা প্রয়োজন।

যদি উপরের পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে নির্ণয় হয় সন্তানটি নিউরোব্লাস্টোমায় আক্রান্ত হয়েছে এবং সন্তানের শরীরে এই রোগ কতটা ছড়িয়ে পড়েছে, তাহলে তার উপর ভিত্তি করে সন্তানের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার আরও কিছু পরীক্ষা দিতে পারে।

এই পরীক্ষাগুলোকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। পর্যায়গুলো 0 থেকে IV পর্যন্ত নির্দেশিত হয়। শরীরে পর্যায় যত কম নির্ণয় হবে সন্তানের শরীরে ক্যান্সারের তীব্রতা তত কম বলে বিবেচনা করা হয়। চতুর্থ পর্যায়টিকে ক্যান্সারের সর্বোচ্চ পর্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এবং কোন সন্তানের শরীরে চতুর্থ পর্যায়ের ক্যান্সার ধরা পড়লে বুঝে নিতে হবে এটি শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পরেছে।

চিকিৎসা (Treatment):

আপনার সন্তান কোন পর্যায়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত বা কি ধরণের টিউমার তার কোন অঙ্গে অবস্থান করছে তার উপর নির্ভর করে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্বাচন করবেন।

আক্রান্ত শিশুর বয়স, স্বাস্থ্য, ক্যান্সারের পর্যায়, ক্যান্সারের সাথে জড়িত কোষগুলোর ধরণ, ক্রোমোজম এবং জিনগুলোর মাঝে কোন অস্বাভাবিকতা রয়েছে কি না সেগুলো নির্ণয় করে তার ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রদান করবেন।

চিকিৎসা প্রদানে নিন্মের পদ্ধতিগুলোর মধ্যে যে কোন একটি পদ্ধতির প্রয়োগ করা হতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে দুই বা তিনটি পদ্ধতিও প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে।

১. সার্জারী (Surgery)

শল্য চিকিৎসা এবং বিভিন্ন সরঞ্জামের মাধ্যমে শল্য চিকিৎসকগণ সার্জারীর মাধ্যমে ক্যান্সারের কোষগুলো অপসরণ করে থাকেন।

নিউরোব্লাস্টোমায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে যারা কম ঝুঁকিপূর্ণ তাদের টিউমার অপসারণের জন্য সাধারণত মাত্র একড়ি সার্জারী প্রয়োজন হয়।

আক্রান্ত সন্তানের টিউমারটি সম্পূর্ণরুপে অপসারণ করা সম্ভব কি না, তা টিউমারের আকার এবং টিউমারের অবস্থানের উপর নির্ভর করে। যদি টিউমারটি বা টিউমারগুলো ফুসফুস বা মেরুদন্ডের কাছের প্রাণবন্ত টিস্যু ও অঙ্গের সাথে সংযুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে এই টিউমারগুলো সার্জারীর মাধ্যমে অপসারণ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে। এতটা ঝুঁকিপূর্ণ যে সন্তান অপারেশনের টেবিলেই মৃত্যুবরণ করতে পারে।

যদি নিউরোব্লাস্টোমা অন্তর্বর্তী বা গুরুতর পর্যায়ে থাকে তাহলে সার্জনগণ সার্জারীর মাধ্যমে টিউমারটি অপারেশনের ঝুঁকি নিয়ে অপসারণের চেষ্টা করেন। সার্জারীর পরে রোগীকে কেমোথেরামি এবং রেডিয়েশন থেরাপির মত কিছু চিকিৎসার মাধ্যমে বাকি ক্যান্সারের কোষগুলো ধ্বংস করে ফেলার জন্য চেষ্টা করেন।

২. কেমোথেরাপি (Chemotherapy)

কেমোথেরাপি হচ্ছে এক ধরণের রাসায়নিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। শরীরে কেমোথেরাপি প্রয়োগের ফলে ক্যান্সারের কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। তবে দুর্ভাগ্যবশত শরীরে কেমোথেরাপি প্রয়োগের ফলে ক্যান্সারের কোষগুলোর পাশাপাশি অনেক স্বাস্থ্যকর কোষগুলোও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

কেমোথেরাপি ব্যবহারের ফলে চুলের গ্রন্থিকোষ এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেম (Gastrointestinal System) সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায়। ফলে শরীরে নানা ধরণের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যেমন, চুল পড়ে যাওয়া, গ্যাসের সমস্যা ইত্যাদি।

৩. রেডিয়েশন থেরাপি (Radiation Therapy)

রেডিয়েশন থেরাপি ক্যান্সারের কোষগুলো ধ্বংস করার জন্য এক্স-রে এর মতো উচ্চশক্তি বিম ব্যবহার করা হয়। কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং মধ্যবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ নিউরোব্লাস্টোমায় আক্রান্ত শিশুদের এই রেডিয়েশন থেরাপি প্রদান করা হয়। সাধারনত সার্জারী বা কেমোথেরাপির প্রয়োজন হয় না আক্রান্ত এমন শিশুদের রেডিয়েশন থেরাপি প্রদান করা হয়। আবার সার্জারী করা হয়েছে এবং কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছে এমন শিশুর জন্যও রেডিয়েশন থেরাপি প্রয়োগ করতে হতে পারে। ক্যান্সারের কোষগুলো যেন আবার শরীরে উৎপন্ন হয়ে না পারে এজন্যই সার্জারী এবং কেমোথেরাপি দেওয়া রোগীকে রেডিয়েশন থেরাপির আওতায় আনতে হতে পারে।

মনে রাখতে হবে যে স্থানে রেডিয়েশন থেরাপি প্রয়োগ করা হয় সেই স্থানের স্বাস্থ্যকর কোষগুলোও বিকিরণের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।

৪. ইমিউনোথেরাপি (Immunotherapy)

ঔষধ বা ড্রাগ প্রয়োগের মাধ্যমে ক্যান্সারের যে চিকিৎসা প্রদান করা হয় তাকেই বলা হয় ইমিউনোথেরাপি চিকিৎসা। এই ড্রাগগুলো ক্যান্সারের কোষের সাথে লড়াই করে আক্রান্ত সন্তানের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়ে প্রতিরোধক ব্যবস্থাকে সংকেত দিয়ে থাকে।

৫. অস্থিমজ্জা বা বোনম্যারো প্রতিস্থাপন (Bone Marrow Transplant)

মারাত্মক বা গুরুত্বর পর্যায়ে নিউরোব্লাস্টোমায় আক্রান্ত, এমন শিশুদের সর্বশেষ চিকিৎসা হচ্ছে বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন চিকিৎসা। এক্ষেত্রে এসকল শিশুদের অস্থিমজ্জা থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করা হয়। এই স্টেম সেলগুলো প্রক্রিয়াজাত করে সেলগুলো প্রতিস্থাপনের সময় প্রয়োজন হতে পারে। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের আগে আক্রান্ত শিশুর রক্ত থেকে স্টেম সেলগুলো নিয়ে তা ফিল্টার করে সংগ্রহ করা হয়। এরপর ফিল্টার করা স্টেম সেলগুলো পরবর্তীতে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করার জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। অত:পর আক্রান্ত শিশুর দেহে উচ্চমাত্রার কেমোথেরাপি প্রয়োগ করা হয়। উচ্চমাত্রার কেমোথেরাপি প্রয়োগের ফলে শিশুর দেহে অবস্থিত ক্যান্সারের কোষগুলো মরে যায়।

কেমোথেরাপি শেষ হওয়ার পরে সংরক্ষণ করে রাখা স্টেম সেলগুলো রোগীর মেরুদন্ডের ভিতর ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়। ফলে এই স্টেম সেলগুলো শরীরে নতুন এবং স্বাস্থ্যকর রক্ত কণিকা তৈরি করতে সক্ষম হয়।

চিকিৎসা জটিলতা (Treatment Complications):

নিউরোব্লাস্টোমা রোগী বেশ কিছু জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে। 

* ক্যান্সারের বিস্তারঃ

নিউরোব্লাস্টোমা শরীরের যকৃত, লেসিকা নোডস (Iymph Nodes), অস্থি মজ্জা, ত্বক এবং হাড়ের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে বা মেটাস্টেসাইজ (Metastasize) করতে পারে।

* মেরুদন্ডের কর্ড সংকোচনঃ

টিউমারগুলো মেরুদন্ডের কর্ডের উপর বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং কর্ডকে চাপ দিতে থাকে, ফলে চাপ লেগে মেরুদন্ডের কর্ড সংকোচিত হয়ে যেতে পারে। ফলে এটি মেরুদন্ডে ব্যথা এবং অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

প্রতিরোধ ( Prevention):

এখন পর্যন্ত নিউরোব্লাস্টোমা প্রতিরোধের কোন উপায় বা পদ্ধতি স্বীকৃতভাবে নির্ণয় করা যায় নি। তবে জীবন-যাপনে কিছু পরিবর্তন এনে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মনে করা হয়। পরিবর্তনের মধ্যে স্বাস্থকর ওজন বজায় রাখা, ধুমপান সম্পূর্ণরুপে ত্যাগ করা, স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করা ও অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিহার করা এবং রাত না জেগে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোকে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *