পৃথিবীর অন্যতম দুর্বোধ্য এবং দুর্লভ একটি রোগ বা ব্যাধির নাম মটর নিউরিন ডিজিজ (Motor Neuron Disease).
এই রোগটি অনেকের কাছে বা অনেক দেশে Lou Gehrig’s Disease নামেও পরিচিত। MND (Motor Neuron disease) বা মটর নার্ভের রোগ হচ্ছে একপ্রকার নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার বা স্নায়ুবিক রোগ। মেডিকেলের ভাষায় মটর নিউরন হচ্ছে মানব দেহের আজ্ঞাবাহী স্নায়ু একক, যা মাংশপেশীর ঐচ্ছিক কর্মকান্ডগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। কথা বকা, হাঁটা-চলা, খাবার গিলা বা গলঃধকরণ করা, দেহের সাধারণ নড়াচড়া করানো ইত্যাদি হচ্ছে মাংশপেশীর সাধারণ কর্মকান্ডের অন্তর্ভুক্ত। যখন কেউ মটর নিউরন ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হয়, তখন এই রোগ মানুষের কথা বলা, হাঁটা-চলা, খাবার গিলা, শরীরের বিভিন্ন অংশের নড়াচড়া করা ইত্যাদির উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং এসবের কার্যক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয়। এই রোগটি আমাদের ব্রেন এবং স্পাইনালকর্ডের নার্ভগুলোকে আক্রান্ত করে এবং ধীরে ধীরে এসব স্নায়ুর কার্যক্ষমতা কমে যেতে থাকে। যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। আবার এই রোগের প্রভাবে রোগী মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করতে পারে। প্রকৃতভাবে এই রোগটি প্রোগ্রেসিভলি বা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। অর্থাৎ, ধীরে ধীরে রোগটি মানুষের দেহে এর প্রভাবের হার বৃদ্ধি করতে থাকে। আর এর তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের জড়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অর্থাৎ রোগী ধীরে ধীরে বিকলাঙ্গ বা প্যারালাইজড হতে থাকে। শুধু প্যারালাইজের মধ্যেই এই রোগীর তীব্রতা সীমাবদ্ধ থাকে এমনটা নয়। প্যারালাইজের পড়েও রোগীর দেহে এর তীব্রতা বাড়তে থাকে, এবং এক সময় এই রোগের প্রভাবে রোগী ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।
মটর নিউরন ডিজিজের ধরনঃ
বিভিন্ন ধরনের মটর নিউরন ডিজিজ রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে–
ALS বা অ্যামায়োট্রফিকল্যাটেরাল স্কেলরোসিস,
PBP বা প্রগ্রেসিভ বুলবার পলসি,
PLS বা প্রাইমারীল্যাটেরাল স্কেলরোসিস,
PMA বা প্রোগ্রেসিভ মাস্কুলার অ্যাট্রফি ইত্যাদি অন্যতম।
এসবের মধ্যে অ্যামায়োট্রফিকল্যাটেরাল স্কেলরোসিস
ALS (Amyotrophic Sclerosis) Upper Motor Neuron বা দেহের উপরের অংশের মটর নিউরনের পতন এবং Lower Motor Neuron Degeneration বা শরীরের নিচের অংশের মটর নিউরনের পতনের কারণ।
এছাড়া মটর নিউরন ডিজিজ বা মটর নার্ভের রোগ ঘরনার Primary Sclerosis বা প্রাথমিক স্কেলরোসিস (PLS) Pseudo Bulbat palsy রোগ দেহের উপরের মটর নিউরনকে আক্রান্ত করার অন্যতম কারণ। আর প্রোগ্রেসিভ মাস্কুলার অ্যাট্রফি Progressive Muscular Atrophy (PMA) বা প্রগতিশীল পেশীবহুল ক্ষয়িষ্ণুতা Progressive Bulbar Palsy (PBP) বা প্রগতিশীল বাল্বার পালসি দেহের নিচের অংশের মটর নিউরন পতনের বিভিন্ন কারণ।
বিদেশি চিকিৎসা বিষয়ক পত্রিকা ‘মেডিকেল নিউজ টুডের’ তথ্য অনুযায়ী, যে কোন সময়ে এবং যে কোন বয়সে মানুষ এই বিরল ও গুপ্তঘাতক রোগটিতে আক্রান্ত হতে পারে। তবে আমাদের দেশে ৪০ বছরের অধিক বয়সী মানুষের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সের ব্যক্তিরা এই রোগে আক্রান্তের ঝুঁকিতে থাকে সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও সেনা সদস্য, নৌ সদস্য, বিমান বাহিনীর সদস্য, বিজিবি, আনসার ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পাশাপাশি পেশাদার ফুটবলার, রেসলার, বক্সার এবং দৌড়বিদদেরও এই বিরল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল।
পারিবারিক ইতিহাস জনিত কারণ, উত্তরাধিকার সূত্রে, পরিবেশ, আবাসস্থল, ভাইরাস, ধুমপান ও নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন ইত্যাদির প্রভাবেও মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
চিকিৎসা ও লক্ষণঃ
এই রোগের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নি৷ আবার যে সকল চিকিৎসা দেওয়া হয় সেগুলোকে শুধুমাত্র পরীক্ষার জন্য বা এক্সপেরিমেন্টাল বললেই চলে। এখন পর্যন্ত যে সকল চিকিৎসা দেওয়া হয়, সেগুলো রোগীকে সুস্থ্য করে তুলবে বা অবস্থার উন্নতি ঘটাবে এমনটা কেউ বলতে পারে নি। তবে এই রোগের প্রতিকার ও চিকিৎসা বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা এবং গবেষণা চলমান রয়েছে। আশা করা যায়, আধুনিক গবেষণার মাধ্যমে দ্রুতই এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারবে বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ।
বর্তমানে রোগীর কিছু লক্ষণ দেখে রোগটির চিকিৎসা প্রদানের চেষ্টা করছেন ডাক্তার। রোগটির কিছু লক্ষণ ও প্রতিকারের উপায় নিন্মে আলোচনা করছি।
১) অস্বস্তি ও ব্যথাঃ
অস্বস্তি এবং ব্যথা সরাসরি MND অর্থাৎ Motor Neuron Disease এর কারণে না-ও হতে পারে। অন্য কোন কারণে মানুষের অস্বস্তিবোধ বা ব্যথা হতেই পারে। আবার MND এর প্রভাবেও মানুষ অস্বস্তিবোধ এবং ব্যথায় ভুগতে পারেন। সুতরাং, ব্যথা বা অস্বস্তিবোধ হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথা কমানোর বা অস্বস্তিবোধ দূর করার ঔষধ খেতে হবে।
২) পেশী ব্যথাঃ
এই রোগের অন্যতম একটি লক্ষণ হচ্ছে দেহের বিভিন্ন স্থানের পেশীতে ব্যথা হওয়া। থাই, কাপ মাসল, কোমর, পিঠ, হাত ইত্যাদি স্থানের পেশীতে ব্যথা অনুভব হতে পারে কোন রকম আঘাত ছাড়াই। এক্ষেত্রে বিছানা বা চেয়ারে বসা বা শুয়ে থেকে অবস্থান পরিবর্তন ব্যথা উপশমের চেষ্টা করা যেতে পারে। যদি এই পদ্ধতি অবলম্বন করে কাজ না হয়, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে তার পরামর্শ অনুযায়ী পেশী শিথিল করার ঔষধ সেবন করতে হবে।
৩) শক্ত জয়েন্টঃ
অনেকেরই দেখা যায় শরীরের বিভিন্ন জয়েন্ট শক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ সহজে জয়েন্টের অংশগুলো ভাঁজ করতে পারে না। এটিও মটর নিউরন ডিজিজের অন্যতম একটি কারণ। যদি কারও জয়েন্ট ভাঁজ করতে কষ্টকর হয়ে যায়, তাহলে হালকা ব্যায়াম করে জয়েন্ট ফ্রি করে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় একজন ফিজিওথেরাপিস্টের স্মরণাপন্ন হয়ে তার কাছ থেকে উপযুক্ত ব্যায়াম দেখে ও শিখে নিয়ে নিয়মিত ব্যায়াম করে জয়েন্ট স্বাভাবিক করে নেওয়া।
৪) অসংযমঃ
এ ধরণের লক্ষণ বা সমস্যাকে সাধারণত মটর নিউরন ডিজিজ বা MND এর লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তবে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে রোগীর মাঝে এই লক্ষণটি দেখা যায়। এই সমস্যার সমাধানে আকুপেশনার থেরাপিস্ট এবং মটর নিউরন ডিজিজের নার্সের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৫) অন্ত্র বা পেটের সমস্যাঃ
পেটের সমস্যা দেখা দিলেই যে তা মটর নিউরন ডিজিজের কারণে হয়েছে এমনটা ধরে নেওয়া যাবে না। সাধারণ পেটের সমস্যা থেকে সরাসরি মটর নিউরন ডিজিজ বা MSD হয় না। যেমন: কোষ্ঠকাঠিন্য। মানুষের কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিলে সমস্যা সমাধানে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসা না নিয়ে দীর্ঘদিন বসে থাকলে এই সমস্যা থেকে মানুষ ধীরে ধীরে MND বা মটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত হতে পারে।
৬) কাশি ও বিষম অনুভূতিঃ
কাশি বা বিষম স্বাভাবিক একটি বিষয়। এই সমস্যায় যে কোন সময় যে কোন মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। তবে এই বিষয়টি যদি ঘনঘন হতে থাকে, তাহলে আপনাকে একটু সতর্ক হতে হবে। খাদ্য গ্রহণ, কথা বলা ও যোগাযোগে সমস্যা হলে দ্রুত একজন স্পীচ এন্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট (SLT) এর স্মরণাপন্ন হয়ে তার পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
৭) লালা ও শ্লৈষ্মিকঃ
প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মাঝে হটাৎ করেই দেখা যায় ঘুমের সময় বা শুয়ে থাকলে মুখ থেকে লালা বের হচ্ছে। আবার অনেকের শরীরের বিভিন্ন ছিদ্র থেকে শ্লৈষ্মিক পদার্থও বের হতে দেখা যায়। এ সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে তার পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করতে হবে।
৮) শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাঃ
শ্বাস-প্রাশ্বাসের সমস্যা এই বিরল রোগের অন্যতম একটি লক্ষণ। তবে শ্বাস জনিত সমস্যা হলেই যে মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে এমনটা ভাবা যাবে না। বিভিন্ন কারণে মানুষের শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে। হার্টের সমস্যা, অ্যাজমা, এলার্জি জনিত কারণসহ আরও বেশ কিছু কারণেও শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে। শ্বাসের সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে। যদি অন্যান্য কারণে আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা না হয়, তাহলে এটি MND বা মটর নিউরন ডিজিজের কারণেই হতে পারে।
মটর নিউরণ ডিজিজে আক্রান্ত ব্যক্তিকে রোগ নির্ণয়ের পড়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে দেখা যায়। যেহেতু এই রোগের এখন পর্যন্ত কোন চিকিৎসা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি এবং বিরল একটি রোগ, তাই এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শেষ পরিনতি মৃত্যুই। তবে এই রোগে আক্রান্ত হলে বা আক্রান্ত ব্যক্তিটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে তাকে অবহেলা বা ঘৃণা করা আমাদের উচিত নয়। এটি ছোঁয়াচে কোন রোগ নয়।
আক্রান্ত ব্যক্তিকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগের আগে পর্যন্ত মনোবল ধরে রাখতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা আপনার আমার দ্বায়িত্ব। এই দুঃসময়ে বা শেষ সময়ে পরিবার, পরিচিত এবং রাষ্টীয়ভাবে আক্রান্ত ব্যক্তির পাশে দাঁড়ানো আমাদের দ্বায়িত্ব। হয়তো জেনে অবাক হবেন পরিবার ও রাষ্ট্রকে পাশে পাওয়ায় নিজের মনোবল ধরে রেখে বিশ্বকে জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন পদার্থ বিজ্ঞানের বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। যার অনেক গবেষণা বিশ্বকে এনে দিয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।