দাঁতে শিরশির ও ব্যথা অনুভূতি ? জেনে নিন সেন্সিটিভিটির কারণ ও প্রতিকার কি ।

সঠিকভাবে মুখ পরিষ্কার না করায় প্রায়ই আমাদের মুখের নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। মুখের বিভিন্ন রোগের মধ্যে বেশি দেখতে পাওয়া যায় দাঁত ও মাড়ির বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। আজ আলোচনা করব দাঁতের শিরশির অনুভব বা সেনসিটিভিটি নিয়ে।

দাঁতের শিরশির অনুভূতি সম্পর্কে আলোচনার আগে আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন আমাদের দাঁতের গঠন সম্পর্কে। চিকিৎসাশাস্ত্রে বলা হয় ইন্টারইন্টরিয়ম পিরিয়ড বা প্রেগনেন্সি থেকে দাঁতের ডেভেলপমেন্ট আরম্ভ হয়। এটি মূলত ৩টি লেভেল থেকে হয়ে থাকে।

১. এক্টোডাম,

২. মেজোডাম এবং

৩. ইন্ডোডাম

আমরা সবাই জানি, একটি শিশুর ছয় মাস বয়স থেকে দাঁত ওঠা শুরু হয় এবং আড়াই বছরের মধ্যে দুধের দাঁত ওঠা সম্পূর্ণ হয়ে যায়। এই দুধ দাঁত পড়তে শুরু করে ৬ বছর থেকে। এই প্রক্রিয়া মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৬ বছর পর্যন্ত এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর পর্যন্ত চলে। ডেন্টিশিয়ানে এই প্রক্রিয়াকে এডাল্ট এরিশন বলা হয়। সে অনুযায়ী আমাদের পার্মানেন্ট দাঁতগুলো ৬ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যেই উঠে যায়। এ প্রক্রিয়ায় মাড়ির দাঁত সবার শেষে উঠে।

দাঁত ওঠার পরে বিভিন্ন কারণে দাঁত ক্ষতিগ্রস্ত হলে দাঁতের ক্ষয়রোগ শুরু হয়। এই ক্ষয়রোগ দাঁতের তৃতীয় স্তর পালভে পৌঁছালে আমরা যে সমস্যাটির সম্মুখীন হই সেটি হচ্ছে পালপাইটিস বা দাঁতে শিরশির অনুভব। এর কারণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ( ডিন) অধ্যাপক ডা. আলী আজগর মোড়ল কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। আসুন জেনে নেই কি সেই পরামর্শ-

১. দাঁতের মজ্জার প্রদাহ বা পালপাইটিসঃ

দাঁতের পালভের যে কোনো ইনফ্লামেশনকেই চিকিৎসা শাস্ত্রে দাঁতের পালপাইটিস বলা হয়ে থাকে। আমাদের প্রতিটি দাঁত একটি স্ট্রাকচারে সাজানো আছে। এই দাঁতের স্তর মোট তিনটি। সবার ওপরের আবরণকে বলা হয় এনামেল। এর পরের স্তরে থাকে ডেন্টিন এবং সবশেষ স্তরে পালভ। পালভ আর ডেন্টিনের রুটের অংশটিকে বলা হয় সিমেন্টাম। এই পালভ হলো ডেন্টিন আর সিমেন্টামের মাঝখানে চারদিকে আবদ্ধ অবস্থায় থাকা দাঁতের মজ্জা। কোন কারণে পালভে যদি ইনফেকশন বা ইনফ্লেমশন হয় তখনই তাকে দাঁতের পালপাইটিস বলা হয়ে থাকে।

পালপাইটিসের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে, এর এতো সিবিআর পেইন হয় যে একটা মানুষ পালপাইটিসের ব্যথায় আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে অবাক করা ব্যাপার হলো, নরমাল যে ব্যথানাশক ওষুধ বাজারে পাওয়া যায় এই ঔষুধগুলো খেয়েও সাধারণত পালপাইটিসের ব্যথা ভালো হয় না। এর জন্য অবশ্যই আপনাকে একজন অভিজ্ঞ ডেন্টাল সার্জনের কাছে যেতে হবে। ডেন্টাল সার্জন পালভের বিশেষ অংশে কিছু কাজ করার পরেই একজন রোগী এ ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে পারে।

২. প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো কীঃ

এই রোগের প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গই হচ্ছে আপনার প্রচণ্ড ব্যথা হবে। কিন্তু এই ব্যথা হওয়ার আগে রোগীর মধ্যে আরেকটা লক্ষণ দেখা যায়। আর সেটি হলো দাঁত শিরশির করা।

৩. কীভাবে নির্ণয় করা যায়ঃ

যখনই আপনার প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব এবং সেই সঙ্গে দাঁত শিরশির অনুভূতি থাকবে তখনই আপনি এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এটি বুঝে নিতে হবে। এই অবস্থায় দাঁতের ভেতরের সেল বা টিস্যুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। কোন কিছু খেলে রোগী অস্বস্তি বোধ করে। এমনটা হলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব একজন ডেন্টিস্টের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

৪. সমস্যা সমাধানে চিকিৎসা প্রক্রিয়া কিঃ

আমাদের দেশে অনেক রোগীই বাসায় পালপাইটিস পেইনে ব্যথানাশক ঔষুধ খেয়ে থাকে। এতে কোনভাবেই ব্যথা উপশম হয় না। ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসা। সমস্যা সমাধানে প্রধানত দুই ধরনের চিকিৎসা রয়েছে।

★ যখন রোগীর পালভ বেশি ইনভল্ভ হয়ে যায় তখন রোগীকে সেইভ পালভ থেরাপি দিতে হয়। এই থেরাপি শুধু অভিজ্ঞ ডেন্টিস্টরাই দিতে পারে।

★  যদি ইনফেকশন দাঁতের মজ্জার অনেক গভীরে চলে যায় সেক্ষেত্রে রুট ক্যানেল ট্রিটমেন্ট দিতে হয় রোগীকে। শুধুমাত্র এই ট্রিটমেন্টের মাধ্যমেই রোগীর দাঁতকে রক্ষা করা যেতে পারে। সেই সাথে রোগীর ব্যথাও অনেকটা কমানো যেতে পারে এই পদ্ধতিতে।

স্বাস্থ্য বিষয়ক পোস্ট পেতে রেজিষ্ট্রেশন করুন নিচের লিংকেঃ


https://roktobondhon.com/registration


৫. ঘরোয়া উপায়ে প্রতিকারগুলো কি কিঃ

প্রতিকারের মধ্যে প্রথম করণীয় হচ্ছে আপনাকে ওরাল হাইজিন মেন্টেন করতে হবে। আপনার মুখের ভেতরের এনভায়রনমেন্টকে সুন্দর রাখতে হবে। এর জন্য আপনাকে প্রতিদিন দুবেলা ব্রাশ করতে হবে। সকালে একবার এবং রাতে একবার। আমরা এই ক্ষেত্রে একটু ভুল করে থাকি। আমরা ঘুম থেকে উঠে সকালে নাশতা খাওয়ার আগেই ব্রাশ করি। যা মোটেও উচিত নয়। রাতে ব্রাশ করে ঘুমালে সকালের নাশতা খাওয়ার পরই আপনার দাঁত ব্রাশ করতে হবে।

খাবারের সঙ্গে দাঁতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কেননা খাবার খাওয়ার জন্য আমরা আমাদের দাঁতগুলোই ব্যবহার করে থাকি। তাই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে দাঁতের ওপরে যেন কোন দাগ না পড়ে। যখনই কোন কালো স্পট দেখা যাবে তখনই একজন সার্জনের স্মরণাপন্ন হতে হবে আমাদের। একজন অভিজ্ঞ ডেন্টিস্টের মাধ্যমে কালো স্পটগুলো তুলে ওখানে ফিলিং করে নিলেই আপনার দাঁতের পালপাইটিস পর্যন্ত এই অসুখটা গড়াবে না।

৬. রোগ প্রতিরোধে সহায়ক টিপসগুলো কীঃ

এই রোগ প্রতিরোধে ছয় মাস পরপর একবার করে রুটিন চেকআপ করা উচিত। এই রুটিন চেকআপ ৬ মাসে করতে না পারলে অন্তত ১ বছর পরপর অবশ্যই চেকআপ করা উচিত। সেই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে দাঁতের ভেতরে যেন কোন ক্যাভিটি বা কালো স্পট না পড়ে।

৭. এই রোগে দাঁত ফেলে দেওয়া কি বাধ্যতামূলকঃ

উত্তর ‘না’। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগের চিকিৎসা আছে। ইন পালপাইটিস হলে বা এ জাতীয় সমস্যায় দাঁত অর্ধেকেরও বেশি ক্ষয় বা ভেঙে গেলেও রুট ক্যানেল ট্রিটমেন্ট করে অথবা ক্যাপ বসিয়ে দাঁত রক্ষা করা সম্ভব।

৮. এই রোগে অ্যান্টিবায়োটিক কতটা কার্যকরীঃ

যদি কোন ইনফেকশন না থাকে তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক কোন কাজই করে না। কারণ এখানে সরাসরি ব্লাড সাপ্লাই নেই। তবে দাঁতের বাইরের কিছু ইনফেকশনে কখনও কখনও অ্যান্টিবায়োটিক কিছুটা কাজ করে থাকে।

৯. গর্ভাবস্থায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসা কীঃ

গর্ভাবস্থায় রুট ক্যানেল ট্রিটমেন্ট করতে কোন সমস্যা নেই। গর্ভাবস্থায়ও দাঁতের রুট ক্যানেল করা যায়। এটি নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত।

১০. লেজার ট্রিটমেন্ট সম্ভবঃ

হ্যাঁ, লেজার দিয়ে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব। দাঁতের ভেতরের রুট ক্যানেল ট্রিটমেন্টে ভেতরের মজ্জাটা ফেলে দিতে হয়। এই মজ্জা ফেলে দেওয়ার জন্য দাঁতের রুট ক্যানেলগুলো ক্লিন করতে হয়। আর এর জন্য লেজার ব্যবহার করা হয়।

১১. মেডিকেটেড টুথপেস্ট কতটা উপকারীঃ

আসলে মেডিকেটেড টুথপেস্ট সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা শুধু অভিজ্ঞ চিকিৎসকরাই বলতে পারে কোন রোগীর এই টুথপেস্টের প্রয়োজন হবে। এই টুথপেস্ট কোন কোন রোগীর ক্ষেত্রে অবশ্যই উপকারী তবে সবার ক্ষেত্রে নয়।

১২. খাদ্যাভাস কতটা দায়ীঃ

খাদ্যাভাস এই রোগের জন্য অবশ্যই দায়ী। কেননা খাবারের সঙ্গে ব্রাশের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। খাবারের পরই দাঁত ব্রাশ বা কুলকুচি করে নিশ্চিত করতে হবে যেন দাঁতে কোন খাবার কণা না লেগে থাকে। পাশাপাশি রাতের বেলা স্টিকি বা আঠালো ফুড, মিষ্টি জাতীয় খাবার বা যেসব খাবার খেলে সহজেই দাঁতের সঙ্গে লেগে যায় সেসব এড়িয়ে চলতে হবে। আর খেলেও খাবার খাওয়ার পরপরই দাঁত ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে।

১৩. টুথ সেনসিটিভিটি একেবারেই নির্মূলযোগ্য নয়, এই কথা কতটা সত্যঃ

এই কথাটি মোটেও সত্য নয়। কেননা টুথ সেনসিটিভিটি অবশ্যই নির্মূলযোগ্য। সেনসিটিভিটি একটা ডিজিজ কনডিশন তাই এর ট্রিটমেন্ট করলে অবশ্যই এটি নির্মূল করা সম্ভব।

১৪. বেশি শক্ত ব্রাশ ব্যবহার করা কতটা যুক্তিযুক্তঃ

ব্রাশের ধরন দাঁতের গঠন ও মাড়ির ওপর নির্ভর করে। তাই ডেন্টিস্টরা রোগীভেদে সফট, মিডিয়াম অথবা হার্ড ব্রাশ সাজেস্ট করে থাকেন। যেমন রোগীর দাঁতের মাড়ি ও মিউকসা যদি দুর্বল থাকে সেক্ষেত্রে রোগীকে সফট বা মিডিয়াম ব্রাশ ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে হার্ড ব্রাশ ব্যবহার না করাই ভালো। কারণ এটি দাঁত বা মাড়িকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝতে হবে। নিয়মের মাধ্যমে চলার মাধ্যমেই দাঁত সুস্থ রাখা সম্ভব। তাই আসুন, প্রতিদিন দাঁতের যত্ন নেই।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment