টেস্টিকুলার টর্শন গুরুতর এবং বিরল একটি রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির অণ্ডকোষ তার নির্দিষ্ট অবস্থান থেকে সরে যায় এবং রক্ত চলাচল প্রবাহ নষ্ট হয়ে যায়। এই রোগে আক্রান্ত হলে একগুয়ে হয়ে বসে না থেকে বা অপেক্ষা না করে অতি দ্রুত চিকিৎসা নিতে হয়। যদি দ্রুত চিকিৎসা বা অপারেশনের মাধ্যমে অণ্ডকোষে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক না করা হয় (ছয় ঘণ্টার মধ্যে), তাহলে অস্ত্রোপচার করে অণ্ডকোষটি অপসারণ পর্যন্ত করতে হয়।
টেস্টিকুলার টর্শন কিঃ
টেস্টিকুলার টর্শন হচ্ছে একটি বেদনাদায়ক, অত্যন্ত গুরুতর অসুখ, যার ফলে আক্রান্ত পুরুষের টেস্টিকুলারে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে শুক্রাণুযুক্ত কর্ড পেঁচিয়ে যায় এবং এর ফলে অণ্ডকোষে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এটি অত্যন্ত গুরুতর এবং মারাত্মক একটি রোগ। যদি অবিলম্বে চিকিৎসা না করা হয় তাহলে ছয় ঘণ্টার মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তি অণ্ডকোষ হারাতে পারেন। অর্থাৎ কেটে বাদ দিয়ে দিতে হতে পারে।
কে বা কারা টেস্টিকুলার টর্শনে আক্রান্ত হতে পারেঃ
টেস্টিকুলার টর্শন বিরল রোগ হলেও অত্যন্ত গুরুতর ও মারাত্মক একটি রোগ। ২৫ বছরের কম বয়সী প্রতি ৪০০০ পুরুষের মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তবে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোরের মধ্যে এই রোগে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। একটি পরিসংখ্যানে এই বয়স সীমার ৬৫% কিশোরের মাঝে এই রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি আছে বলে দেখা যায়।
জন্মের প্রথম বছরের মধ্যে নবজাতক এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আবার ২৫ বছরের বেশি পুরুষগণও আক্রান্ত হতে পারে টেস্টিকুলার টর্শন রোগে। যদিও ২৫ বছরের পরে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বিরল।
টেস্টিকুলার টর্শন সাধারণত একটি স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা। অর্থাৎ, যে কোন পুরুষ আক্রান্ত হতে পারে এই রোগে।
অণ্ডকোষ হল লিঙ্গের নীচের থলিতে থাকা প্রজনন অঙ্গ। যা হরমোন এবং শুক্রাণু তৈরি করে। অতএব, এই রোগে আক্রান্ত হলে লজ্জায় বা গোড়ামিতে চিকিৎসা না করালে রোগীর প্রজনন ক্ষমতা প্রভাবিত এমনকি নষ্ট হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
টেস্টিকুলার টর্শনের কারণ কীঃ
টেস্টিকুলার টর্শনের আক্রান্তের সাধারণত নির্দিষ্ট কোন কারণ নেই। যদিও অন্ডকোষে আঘাত পাওয়াকে এই রোগের কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে তা অনুমানের ভিত্তিতে।
টেস্টিকুলার টর্শনের আরেকটি কারণ হিসেবে “বেল ক্ল্যাপার” বিকৃতি নামক একটি অবস্থাকে সন্দেহ করা হয়। বেশিরভাগ পুরুষের মধ্যে, একটি অণ্ডকোষ মোচড় দিতে বা অবস্থান পরিবর্তন করতে সক্ষম নয়। কারণ এটি অণ্ডকোষের থলি বা চামড়ার সাথে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত থাকে। একজন পুরুষ যদি বেল ক্ল্যাপার বিকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, তাহলে তার অণ্ডকোষগুলো অণ্ডকোষ থলিতে ঝুলে থাকে এবং থলির মধ্যে মধ্যে হাততালির মতো অবাধে দুলতে পারে। ফলে অতি সহজেই অন্ডোকোষ যে কোন সময় নিজ অবস্থান থেকে সরে যেতে পারে। এই বিকৃতিটি উভয় অণ্ডকোষকে প্রভাবিত করে থাকে। যদিও অণ্ডকোষ উভয় পাশে একবারে ঘুরে যাওয়া বা টর্শন হওয়া খুবই রেয়ারলি হয়ে থাকে।
টেস্টিকুলার টর্শনের লক্ষণ কী কীঃ
টেস্টিকুলার টর্শনের প্রধান একটি লক্ষণ হলো গুরুতর টেস্টিকুলার ব্যথা হঠাৎ শুরু হওয়া। আক্রান্ত ব্যক্তি জেগে থাকা বা ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায়, এমনকি দাঁড়িয়ে থাকা বা বসে থাকা অবস্থায় অণ্ডকোষে মৃদু থেকে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করবে। টর্শন প্রায় সবসময় শুধুমাত্র একটি অণ্ডকোষকে প্রভাবিত করে। সচরাচর বাম অণ্ডকোষটি এই রোগে আক্রান্ত হওয়া লক্ষণীয়ভাবে লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের মধ্যে বাম অণ্ডকোষে আক্রান্ত এমন রোগী খুব বেশি পাওয়া যায়। মনে রাখবেন একটি অণ্ডকোষে হঠাৎ তীব্র ব্যথা আঘাত বা দুর্ঘটনার কারণে হয় না।
অণ্ডকোষের একপাশ ফুলে যায় এবং অত্যন্ত বেদনাদায়ক ব্যথা অনুভূত হয় । এবং আক্রান্তের অণ্ডকোষে একটি পিণ্ডও লক্ষ্য করা যায়।
আপনি বা আপনার সন্তান যদি এই উপসর্গগুলোর মধ্যে কোনটিতে ভুগছেন বা ব্যথা অনুভব করেন তবে দেরি না করে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
টেস্টিকুলার টর্শন নির্ণয় পদ্ধতিঃ
টেস্টিকুলার টর্শন সাধারণত শারীরের বাহ্যিক কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়ে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণসমূহের বর্ণনা এবং রোগীর চিকিৎসার ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে একজন ইউরোলজিস্টটের মাধ্যমে এই রোগটি নির্ণয় করা হয়ে থাকে। অবস্থার তীব্রতার উপর ভিত্তি করে দ্রুত রোগ নির্ণয় করা অত্যাবশ্যক। যেন আক্রান্ত ব্যক্তি বিলম্বের ফলে তার অণ্ডকোষ না হারায়। যদি প্রাথমিকভাবে একজন ইউরোলজিস্ট না পাওয়া যায়, তবে ডপলার সিগন্যালিংসহ রোগীর স্ক্রোটাল আল্ট্রাসনোগ্রাফি করতে হবে। এর মাধ্যমে টেস্টিকুলার টিস্যুর মধ্যে রক্ত প্রবাহের উপস্থিতি নির্ধারণ করা হয়।
এক্স-রে বা আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা ছাড়া অন্যান্য পরীক্ষাগুলো শুধুমাত্র তখনই করা হয়, যখন রোগীর অন্ডকোষে বা অন্ডকোষের আশেপাশে অস্বাভাবিক কোন লক্ষণ দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে, প্রস্রাব পরীক্ষা এবং আল্ট্রাসাউন্ড এরিয়ায় (অন্ডকোষ এবং আশেপাশে) রক্ত প্রবাহের মাত্রা পরীক্ষা করা যেতে পারে।
টেস্টিকুলার টর্শনের চিকিৎসা পদ্ধতিঃ
টেস্টিকুলার টর্শন অবশ্যই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা করা উচিত। যদিও ডাক্তার ম্যানুয়ালি আক্রান্ত কর্ডটি উল্টানোর বা স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারেন। যদি কর্ডটি আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা সম্ভন না হয় সেক্ষেত্রে, অস্ত্রোপচারই এর রোগ থেকে মুক্তির একমাত্র চিকিৎসা। টেস্টিকুলার টর্শন অস্ত্রোপচারের সময়, সার্জন অণ্ডকোষটি উল্টে ফেলেন। অত:পর অন্ডকোষ এবং আক্রান্ত কর্ডে রক্ত প্রবাহের মাত্রা পুনরায় স্বাভাবিক করবেন। এবং ভবিষ্যতে যেন পুনরায় টর্শনে আক্রান্ত না হয় সেজন্য অভ্যন্তরীণ স্ক্রোটাল প্রাচীরের সাথে অন্ডকোষ সেলাই করে দিয়ে সুরক্ষিত করবেন।
সার্জন সাধারণত অণ্ডকোষের অস্ত্রোপচার করেন। কখনও কখনও রোগীর অবস্থাভেদে কুঁচকির মধ্যে একটি ছিদ্র করতে হয়। ভবিষ্যতে রোগী যেন টর্শনে পুনরায় আক্রান্ত না হয় সেজন্য আক্রান্ত অণ্ডকোষটি স্বাভাবিক অবস্থানে নিয়ে আসবেন। কারণ একটি বেল ক্ল্যাপার সাধারণত অণ্ডকোষের উভয় পাশেই থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, অস্ত্রোপচার ছয় ঘণ্টার বেশি বিলম্বিত হলে, বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই অণ্ডকোষটি অপসারণ করতে হবে। অর্থাৎ কেটে বাদ দিয়ে দিতে হয়। আর ১২ ঘন্টা পরে হাসপাতালে আসা রোগীর ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশেরও বেশি রোগীর ক্ষেত্রেই অন্ডকোষ অপসারণের ঘটনাটি ঘটে থাকে ।
আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত অণ্ডকোষটি অপসারণ করার জন্য এবং অন্য অণ্ডকোষটিকে সেলাই করার জন্য একটি অস্ত্রোপচার করা হবে। যেন পরবর্তীতে অন্য অন্ডকোষের কডও পেঁচিয়ে না যায় বা টর্শনে রুপ না নেয়।
দুর্ভাগ্যবশত, টেস্টিকুলার টর্শনসহ অনেক নবজাতকই জন্মগ্রহণ করে। না জানার কারণে বা প্রকাশ করার ক্ষমতা না থাকার কারণে প্রায়শই বাচ্চাগুলোর অন্ডকোষ নষ্ট হয়ে যায় এবং অনেক বেশি সময় ধরে রক্ত প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় অন্ডকোষের টিস্যু মরে যায় যায় (ইনফার্কটেড হয়ে যায়)।
পরিশেষে বলি, যদি টেস্টিকুলার টর্শন আক্রান্ত ব্যক্তির অবিলম্বে চিকিৎসা করা হয় (সর্বোত্তম ব্যথা শুরু হওয়ার ছয় ঘন্টার মধ্যে) তাহলে রোগীর অণ্ডকোষটি রক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু ছয় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে রক্ত প্রবাহ বন্ধ থাকলে অণ্ডকোষ তার কার্যক্ষমতা হারাতে পারে। ফলে রোগীকে বাঁচানোর জন্য একমাত্র উপায় থাকে অন্ডকোষটি কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া৷ আর এমনটা হলেরোগী চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলে তার পুরুষত্ব । এই কারণে, টেস্টিকুলার টর্শনের প্রথম লক্ষণগুলো দেখা দিলেই দেরি না করে অতি দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।
–Rumel Rahman