হঠাৎ করে আমাদের চারপাশে অনেক মানুষ জন্ডিসে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকেই বিষয়টিকে হালকাভাবে নিচ্ছে আবার অনেকেই আতংকে পড়ে যাচ্ছে যখন রিপোর্ট দেখে বলছে আপনি জন্ডিসে আক্রান্ত। কি করবো, কিভাবে চলবো, কি খাবো কি খাবো না এসব নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করে চলেছে প্রতিনিয়ত অনেকেই। তো পোস্টে এই বিষয়েই কিছুটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো
জন্ডিসের আক্রান্ত ব্যক্তিকে যে কাজগুলো করতেই হবে সেগুলো হচ্ছে রোদ পরিহার, হাঁটাচলা ও ভারী কাজ, মসলা জাতীয় খাবার এবং বাহিরের খাবার একেবারে পরিহার করে বিশ্রাম, বিশ্রাম এবং বিশ্রামে থাকা। মনে রাখবেন এ অবস্থায় রোদ/তাপ/গরম এবং পরিশ্রম আপনার লিভারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে আপনার মৃত্যু নিশ্চিত করতে সক্ষম।
আসুন এবার জেনে নেই জন্ডিস সম্পর্কে।
জন্ডিস নামটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। রোগ হিসেবেই আমরা চিনে থাকি জন্ডিসকে। কেউ এটিকে অনেক হালকা ভাবে নেয়, আবার অনেকেই আছে যারা জন্ডিস হয়েছে শুনলেই ঘাবড়ে যায়। পড়ে যায় নানা দুশ্চিনতায়। এটা করতে হবে, ওটা করা যাবে না, এটা খেতে হবে, ওটা খাওয়া যাবে না এমন অনেক নিয়ম মেনে চলতে বলা হয় আমাদের সমাজ বা পরিবার থেকে। পানি পড়া, চাল পড়া, গুড় পড়া, কাসার থালি লাগানো, ঝার ফুঁ দেওয়া আরও কত ধরণের এক্সপেরিমেন্ট করা হয় জন্ডিসে আক্রান্ত মানুষের দেহে তা গুনে শেষ করা দায়। এই নিয়মগুলো কি আসলেই কি জন্ডিস সাড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখে? বা এসব কি কোন কাজেই আসেন না? আসুন জেনে নেই জন্ডিস কি? এর লক্ষণ, করণীয়, বর্জণীয় কাজগুলো সম্পর্কে।
জন্ডিস কিঃ
জন্ডিস আসলে কোন রোগই নয়।
উপরের লাইনটি পড়ে অবাক হচ্ছেন? বা উপরের লাইনটি পড়ার পরে জন্ডিসকে অবহেলা করে যাচ্ছে তাই ভাবে জীবন-যাপন করা শুরু করবেন?
যদি এমনটা ভেবে থাকেন বা করে থাকেন, তাহলে আপনি আপনার জীবনকে নিয়ে যাবেন মৃত্যুর দিকে। আর মৃত্যু হবে ভুগতে থেকে, কষ্ট পেয়ে।
হ্যাঁ জন্ডিস আসলেই কোন রোগ নয়। তবে বড় রোগের বহিঃপ্রকাশ বা লক্ষণ এই জন্ডিস। আমাদের রক্তে বিলুরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে ত্বক, স্কেলর বা চোখের সাদা অংশ এবং অন্যান্য মিউকাস ঝিল্লি হলুদ হয়ে যায়। আর তখনই বলা হয় এই সকল লক্ষণ দেখা দেওয়া ব্যক্তি জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের রক্তে বিলুরুবিনের মাত্রা 1.2 mg/dL (25 µmol/L এর নিচে) এর নিচে থাকে। বিলুরুবিনের ঘনত্ব এই মাত্রার বেশি হয়ে গেলে তখনই ধরে নিতে হবে ব্যক্তিটি জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছে। জন্ডিস রোগটিকে হাইপারবিলুরুবিনেমিয়া নামেও আখ্যায়িত করা হয়।
রক্তে বিলুরুবিন বেড়ে গেলে কি হয়ঃ
জন্ডিস মূলত লিভারের অসঙ্গতিপূর্ণ কার্যক্রমকে প্রকাশ করে থাকে। শরীরে বিলুরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে বুঝে নিতে হবে, আক্রান্ত ব্যক্তির লিভার সঠিকভাবে বিলুরুবিন পরিষ্কার করতে পারছে না। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তি লিভারের ক্ষতি বা লিভার জনিত কোন রোগের সংকেত দিতে পারে এই জন্ডিস নামক উপসর্গটি। আবার অন্য কোন জটিল সমস্যার কারণেও একজন মানুষের দেখে জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। আর এমনটা হলে এবং সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না নিলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু অবধারিত এটা নিশ্চিত।
জন্ডিস কত প্রকারঃ
আমাদের দেশের অনেকেই ধরে নেয়, জন্ডিস হয়েছে মানেই আক্রান্ত ব্যক্তির লিভার নষ্ট হয়ে গেছে বা আক্রান্ত ব্যক্তির বড় অসুখ হয়েছে। এই ধারণাটি একদমই ভুল। জন্ডিস হলেই লিভার নষ্ট হয়ে গেছে বা বড় রোগে আক্রান্ত হয়েছে এই ধারণাটি একেবারে ঝেড়ে ফেলতে হবে।
জন্ডিস যেমন বিভিন্ন রোগের লক্ষণ, ঠিক তেমনই জন্ডিসের কয়েক ধরণেরও আছে। আর এই ধরণের উপর নির্ভর করেই ডাক্তার বুঝে নেন রোগীর চিকিৎসা ও পরবর্তী করণীয় কি কি। জন্ডিসের ধরনগুলো হচ্ছে-
১. প্রি-হেপার্টিকঃ
কোন কারণে আমাদের রক্তের লোহিত কনিকা বেশি বেশি ভাঙলে বা অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হলে এই ধরণের জন্ডিস দেখা দিতে পারে। হিমোলাইটিক এনিমিয়া, ম্যালেরিয়া এবং থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এই ধরণের জন্ডিসে আক্রান্ত হতে পারে বা হয়ে থাকে। আবার অনেক সময় নারীরা অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে এই ধরণের জন্ডিসে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
২. হেপটিকঃ
লিভারের মধ্যে কোন সমস্যা থাকলে অর্থাৎ লিভার জনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে এই ধরণের জন্ডিসের জন্ডিসের উপসর্গ দেখা দেয়। লিভারের রোগ হেপাটাইটিস এ, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, হেপাটাইটিস ডি, হেপাটাইটিস ই, মদ্যপানের কারণে হতে পারে। আবার লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের দেহেও এই ধরণের জন্ডিসের উপসর্গ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে।
৩. পোস্ট হেপাটিকঃ
পোস্ট হেপাটিক পিত্ত লিভাবে তৈরি হওয়ার পরে লিভার থেকে বের হওয়ার রাস্তায় কোন সমস্যা থাকলে মানুষের দেহে এই ধরণের জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দিয়ে থাকে। পিত্তনালীর রাস্তায় পাথর বা পিত্তনালীর ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের শরীরে এই ধরণের ক্যান্সারের উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে।
জন্ডিস সম্পর্কে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় জানাটা জরুরী।
কি করবেন আর কি করবেন না:
শরীরে জন্ডিসের উপসর্গ দেখা দিলে কিছু কাজ আপনাকে করতেই হবে। এসব না করলে আপনার লিভারে বড় ধরণের ক্ষতি সাধন হতে পারে। কাজগুলো হচ্ছে-
১) জন্ডিসে আক্রান্ত হলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে। পরিপূর্ণ বিশ্রাম না নিলে বিপাক বাড়বে। আর বিপাক বাড়লে লিভারের উপর চাপ পড়বে এবং রক্তে বিলুরুবিনের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। এতে করে লিভার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রক্তে বিলুরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে প্রয়োজনে শয্যাশায়ী হয়ে যেতে হবে নিজেকে। অর্থাৎ আপনাকে বিছাগত হয়ে থাকতে হবে।
২) জন্ডিসে আক্রান্ত হলে রোদ, আগুনের তাপ এসব পরিহার করে চলুন। এসব লিভারের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
৩) স্বাভাবিক মাত্রায় পানি পান করুন। অতিরিক্ত পানি, ডাবের পানি, আখের রস, নানা রকম জুস পান করলে জন্ডিসে সুফল পাবেন এমনটা চিকিৎসা বিজ্ঞান দ্বারা প্রমানিত নয়। চেষ্টা করুন পানি ভালোভাবে ফুটিয়ে তারপর ঠান্ডা করে পান করতে। এতে করে পানিতে থাকা অনেক জীবাণু থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
৪) জন্ডিসে আক্রান্ত হলে অতিরিক্ত হাঁটাহাঁটি, দৌঁড়ানো, খেলাধুলা এসব পরিহার করতে হবে। এসব আপনাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। কারণ এসময় লিভারে চাপ ও তাপ উভয়ই ক্ষতিকর।
৫) অ্যালকোহল, এনার্জি ড্রিংক, সফট ড্রিংক, ধুমপান, তেলে ভাজা খাবার ও অধিক মসলাদার খাবার একদম পরিহার করতে হবে।
৬) নিয়মিত ১ থেকে ২ বার গোসল করতে হবে। সাথে নিজেকে পরিষ্কার রাখুন।
৭) জন্ডিস হলে লিভারের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এসময় কোন ধরনের ঔষধ সেবন না করাই উত্তম। পেট ব্যথা বা বমির জন্য ঔষধ খেতে হলেও তা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তবেই খেতে পারেন। যে সকল রোগী নিয়মিত বা আগে থেকে হাই প্রেসারের এবং হার্টের রোগের ঔষধ খান তারা ঐ সকল ঔষধ খেতে পারবেন। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের এ সময় ঔষধ না খেয়ে ইনসুলিন গ্রহণ করাটাই উত্তম।
জন্ডিস হলে কি খাবেন, কি পরিহার করবেন, আমাদের মাঝে থাকা ভ্রান্ত ধারণা, কি ধরণের চিকিৎসা নিবেন এসকল বিষয়ে পরবর্তী পোস্ট করা হবে আপনাদের আগ্রহের উপর ভিত্তি করে।
আরও জানুন: স্ট্রোক সম্পর্কে কিছু তথ্য