মূত্রনালী বা প্রস্রাবের সংক্রামণ/ইনফেকশনে অনেক নারীই ভুগে থাকেন। নারীদের মাঝে ব্যাকটেরিয়াজনিত ইনফেকশনের মধ্যে ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্তের হার অন্যতম। জানা যায়, প্রায় ৬৫-৮০ শতাংশ নারী তাদের জীবদ্দশায় ইউটিআই অনুভব করেন। নারীদের মাঝে এই ইনফেকশনের প্রবণতা বেশি থাকলেও অনেক পুরুষও ইউরিন ইনফেকশনে ভুগে থাকেন। তবে নারীদের তুলনায় পুরুষের এই ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা কম।সাধারণত ইউরিন ইনফেকশন জনিত সমস্যা জীবন-হুমকিপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি করে না। ইনফেকশনের পরিমাণ ও প্রভাব বেশি হলে শরীরে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। আর এই সমস্যা থেকে সৃষ্টি হতে পারে বেশ কিছু মরণব্যাধি রোগের। ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত হলে মানব দেহে বেশ কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। বারবার প্রস্রাবের চাপ, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, প্রস্রাব হলুদ বা লানচে হয়ে যাওয়া, তীব্র গন্ধ ও ঝাঁজযুক্ত প্রস্রাব, তলপেটে বা পেটে ব্যথা অনুভব করা এর মধ্যে অন্যতম।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসকগণ ইউটিআই রোগীর চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। মূলত এন্টিবায়োটিক ঔষধ অনুজীবের বৃদ্ধিকে বাঁধা দেওয়ার কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে চিকিৎসক ৫ বা ৭ দিনের জন্য এন্টিবায়োটিক কোর্স সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তারপরও ইনফেকশন না সারলে আরও কিছুদিন কোর্স চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। নারীদের থেকে পুরুষের এই ইনফেকশনে আক্রান্তের হার কম হলেও যে সকল পুরুষ এই রোগে আক্রান্ত হয় তাদের জন্য এন্টিবায়োটিক কোর্সগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য নির্ধারিত হয়। যা ক্ষেত্রবিশেষে ১০/১৪ এমনকি ৩০ দিন পর্যন্তও হয়ে থাকে।
যাদের মূত্রনালীতে ইনফেকশনের পরিমাণ বেশি বা খুব বেশি তাদের জন্য সর্বোত্তম দুইটি চিকিৎসা, এন্টিবায়োটিক সেবন আর অপারেশন। তবে যাদের উপসর্গগুলো হালকা বা ইউরিন ইনফেকশনের পরিমাণ সামান্য তারা এন্টিবায়োটিক ছাড়াই ডাক্তারের পরামর্শে বাড়িতেই এন্টিবায়োটিক ব্যতীত চিকিৎসা নিয়ে পরিপূর্ণ সুস্থতা অর্জন করতে পারবেন। তবে ইনফেকশনের পরিমাণ নির্ধারণ করার জন্য আপনাকে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে অবশ্যই কিছু টেস্ট করে নিতে হবে।
যদিও এন্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া বা ইনফেকশন রোধে সাহায্য করে থাকে। কিন্তু এন্টিবায়োটিকের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসিপি) এর গবেষণা অনুসারে এসব এন্টিবায়োটিক সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, ফুসকুড়ি, ডায়রিয়া এবং এলার্জি জনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আপনি যদি এন্টিবায়োটিক সেবন ব্যতীত ঘরোয়া কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে ইউটিআই বা ইউরিন ইনফেকশন থেকে আরোগ্য লাভ করতে চান, তাহলে আপনাকে বেশ কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে।
আসুন তাহলে জেনে নেই এন্টিবায়োটিক ছাড়াই কি কি উপায়ে নির্মূল করা সম্ভব এই ইউরিন ইনফেকশন–
>> প্রচুর ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা প্রতিরোধ, রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ, রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে দেহে অনেক উপকারিতা তৈরি করতে সক্ষম ভিটামিন সি।
এসবের পাশাপাশি ইউটিআই বা ইউরিন ইনফেকশন সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার ক্ষমতাও এই ভিটামিনে রয়েছে। আমলকি, কিউই, এভোকেডো, কমলালেবু, জাম্বুরা, লেবু ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। সুতরাং ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত হলে এসময় প্রচুর পরিমাণে এসব খাবার খেতে হবে।
>> ইউটিআই বা ইউরিন ইনফেকশনসহ সকল প্রকার স্বাস্থ্য সমস্যার মূল সমাধান হচ্ছে পানি। ডিহাইড্রেশন শরীরে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। নিজেকে হাইড্রেটেড রাখার মাধ্যমে ইউরিন ইনফেকশনের সর্বোত্তম চিকিৎসা দিতে পারেন। কারণ, পানি প্রস্রাবকে পাতলা করে দিতে কাজ করে। আর প্রস্রাব পাতলা হয়ে যাওয়ার ফলে অনায়াসে প্রস্রাবের সাথে সকল ব্যাকটেরিয়া বের হয়ে যেতে পারে।
>> ক্র্যানবেরি ইউটিআই প্রতিরোধে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে। কিছু গবেষণার মাধ্যমে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাজা ক্র্যানবেরির জুস ইউটিআই বা ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি কমায়। ক্র্যানবেরিতে প্রচুর প্রোঅ্যান্থোসায়ানিডিনস বিদ্যমান। যা মূত্রনালীর অস্তরণে ব্যাকটেরিয়া জমতে বাঁধা প্রদান করে। এতে করে দ্রুতই ইনফেকশন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তবে চেষ্টা করতে হবে সারাদিন বেশি বেশি পানি পান করার এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার দুই ঘন্টা আগে থেকে পানি পান বন্ধ করে দেওয়ার বা খুবই কম পানি পান করার। কারণ এসময় বেশি পানি পান করলে ঘুমের ভিতর প্রস্রাবের চাপ বেশি হয় এবং কিডনিতে এর খারাপ প্রভাব পড়ে।
>> প্রোবায়োটিক হচ্ছে এক ধরণের অনুজীব, যা হজম ক্ষমতার পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। প্রোবায়োটিক খারাপ ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে ভালো বা উপকারী ব্যাকটেরিয়ার জন্ম দেয়। তাই ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত হলে প্রোবায়োটিক গ্রহণ করে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
>> মধু ও কালোজিরাকে বলা হয় মহা ঔষধ। এসময় পরিমাণমত মধু এবং কালোজিরা খেতে পারেন। আবার চাইলে হালকা কুসুম গরম পানিতে মধু মিশিয়েও পান করতে পারেন। এই পানীয় ইনফেকশন দূর করার পাশাপাশি আপনার অতিরিক্ত মেদ কমাতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।
>> ইউরিন ইনফেকশনে ভুগছেন এমন ব্যক্তি ভুলেও কখনও বেশিক্ষণ প্রস্রাব আটকিয়ে রাখবেন না। এতে করে ব্যাকটেরিয়াগুলো অতি দ্রুত বংশবিস্তার করে শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে। আবার প্রস্রাব করার সময়ও প্রস্রাবকে ধরে রাখবেন না। এতে করেও ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই প্রস্রাবের চাপ অনুভব করলেই মূত্রাশয় খালি করে নেওয়া খুবই জরুরী। শুধু ইউরিন ইনফেকশনে ভুগছেন এমন মানুষই নয়, প্রতিটি মানুষেরই উচিত প্রস্রাব আটকে না রাখা। এতে ইউরিন ইনফেকশনের সাথে কিডনির সমস্যা তৈরি হওয়ার প্রবল ঝুঁকি থাকে।
নোটঃ ইউরিন ইনফেকশনের পরিমাণ বা পর্যায় নির্ণয়ের পরেই আপনি এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করতে পারবেন। আর পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য অবশ্যই আপনাকে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়ে কিছু পরীক্ষা করাতে হবে।
যদি ইউরিন ইনফেকশনের পরিমাণ বেশি হয়, তাহলে এন্টিবায়োটিক বা অপারেশন ব্যতীত অন্য কোন চিকিৎসা আপনার জন্য নয়।
আরও পড়ুনঃ পেরিফিয়াল নিউরোপ্যাথি কি?