ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি বা Insulin Sensitivity কিঃ
ইন্সুলিন হচ্ছে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় এক প্রকার হরমোন। এই হরমোন আমাদের শরীরে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। অর্থাৎ খাবার বা অন্য কোনো মাধ্যমে আমাদের শরীরে গ্লুকোজ প্রবেশ করলে তার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এই ইন্সুলিন। আর যখন আমাদের শরীরের কোষগুলো ইন্সুলিন দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয় বা দেহে ইন্সুলিনের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত হয়ে যায়, সেই অবস্থাকে ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি (Insulin Sensitivity) বলা হয়।
উচ্চহারে ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি থাকার অর্থ হচ্ছে, মানুষের শরীর গ্লুকোজকে অনেক ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারছে। অর্থাৎ ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি এর পরিমাণ যত বেশি, দেহে গ্লুকোজ ব্যবহারের পরিমাণও ততটাই বেশি হবে। যার ফলে রক্তে সুগারের পরিমাণ কমে যাবে। তবে মনে রাখতে হবে এক একজন মানুষের Insulin Sensitivity এক এক ধরণের। প্রতিটি মানুষের ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটির পরিমাণ ও প্রভাব ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক।
★ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি এবং ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্সের মধ্যে পার্থক্যঃ
ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি বলতে কোষের ইন্সুলিন গ্রহণের ক্ষমতাকে বুঝায়,
ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স বলতে কোষের ইনসুলিন গ্রহণের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বুঝায়,
ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি বাড়লে ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্সের মাত্রা কমে যায়,
ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্সের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরে ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি কমে যায়। অর্থাৎ ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি আর রেজিস্ট্যান্স উভয়ের সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক।
ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি বাড়ানোর উপায়:
মানুষের দেহে ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি বৃদ্ধি পেলে তা মানুষের জন্য উপকারী হতে পারে। কারণ এর ফলে মানুষের শরীরে গ্লুকোজের নিয়ন্ত্রণ সঠিকভাবে হতে পারে। যার ফলে রক্তে সুগারের পরিমাণ কমে যাবে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করে। এসকল কারণে মানুষের সবসময় ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সর্বদা সচেষ্টা থাকা প্রয়োজন। ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি ভাড়ানোর কিছু পদ্ধতি সম্পর্কে নিচে কিছু পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলো–
শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণ বাড়ানো:
শারীরিক পরিশ্রম করলে মানুষের শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কেটে যেতে থাকে। এই সময়ে শরীরে প্রচুর শক্তির চাহিদা তৈরি হয়। যে কারণে দেহের ভিতরে গ্লুকোজের ব্যবহার বেড়ে যায় এবং গ্লুকোজ জমিয়ে রাখার প্রবণতা দেহ কমিয়ে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে কোষ সমূহ আরও বেশি ইন্সুলিন গ্রহণের চেষ্টা করতে থাকে। যার ফলে শরীরে Insulin Sensitivity ও বেড়ে যায়।
কায়িক পরিশ্রমের ক্ষেত্রে ভালো একটি পদ্ধতি হতে পারে ব্যায়াম। কিছু ধরণের ব্যায়াম ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি বৃদ্ধি করতে তুলনামূলক বেশি কার্যকর। আবার একজন মানুষের শারীরিক অবস্থার উপরও নির্ভর করে মানুষটি কোন ধরণের এবং এবং কতটুকু ওজন বা সময় নিয়ে ব্যায়াম বা শ্রম দিতে সক্ষম। এক্ষেত্রে মানুষদের ৩ ভাগে ভাগ করে ব্যায়ামের পরিমাণ ও ধরণ নির্ণয় করা যেতে পারে।
ধরণ-১:
যে সকল ব্যক্তি শারীরিকভাবে সুস্থ্য তাদের প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করা জরুরী। শারীরিকভাবে সুস্থ ব্যক্তিদের কঠোর অ্যারোবিক এক্সারসাইজ করা উচিত। এই এক্সারসাইজকে আমরা কার্ডিও এক্সারসাইজ বলেও চিনে থাকি। কার্ডিও এক্সারসাইজের মধ্যে পড়ে: রোড/বীচ রানিং, ট্রেডমিল রানিং, সাঁতার, জাম্পিং, সাইক্লিং, স্কিপিং/রোপিং ইত্যাদি। এই ধরণের ব্যায়াম সপ্তাহে অন্তত ৩ দিন করতে হবে। আর স্ট্রেংথ এবং ওয়েট এক্সারসাইজ সপ্তাহে ২ দিন করতে হবে। এক্ষেত্রে HIIT একটি ভালো উপায় হতে পারে।
ধরণ-২:
যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস আছে তাদেরও উচিত প্রতি সপ্তাহে ৩০ মিনিট করে অন্তত ৫ দিন শারীরিক পরিশ্রম করা। টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের মাঝারি মানের কার্ডিও এক্সারসাইজ করতে হবে। ফুল কার্ডিও এক্সারসাইজ তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে৷ হাফ কার্ডিও এক্সারসাইজ হচ্ছে: বাগান করা, নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করা ( ঘাম ঝরে এমনভাবে হাঁটতে হবে), অল্প পরিমাণ লাফালাফি বা স্কিপিং করা, নাচ করা ইত্যাদি। এগুলো অন্তত ৩ দিন করতে হবে। এর পাশাপাশি অন্তত ২ দিন হাই রেসিস্টেন্স ট্রেনিং (HIRT) চালিয়ে যাওয়া উচিত।
ধরণ-৩:
যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস আছে এবং শারীরিকভাবে খুব বেশি পরিশ্রম করতে সক্ষম নয়, তাদের ক্ষেত্রে শরীর যতটা গ্রহণ করতে পারে সেই পরিমাণ শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। এক্ষেত্রে স্বল্প মাত্রার কার্ডিও ট্রেনিং চালিয়ে যেতে হবে। স্বল্প মাত্রার কার্ডিও ট্রেনিংয়ের মধ্যে রয়েছে: হাঁটা, হাতের ব্যায়াম, খুবই সহজ ও সাধারণ কিছু পেশির ব্যায়ামের পাশাপাশি হালকা কিছু স্ট্রেচিং। নিজের শরীর যত সময় নিতে পারে প্রতিদিন সেই পরিমাণ সময় নিয়ে এই ব্যায়ামগুলো চালিয়ে যেতে হবে।
প্রয়োজন মাফিক ঘুমানো:
ঘুম আমাদের ক্লান্তিকে দূর করে আমাদের শরীর সতেজ করে। পাশাপাশি শরীর, মস্তিষ্ক, শরীরের পেশিসহ সবকিছুকে সুস্থ ও শান্ত রাখতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমালে আমাদের দেহের কোষগুলো পুনর্জীবন লাভ করার পাশাপাশি আমাদের শরীরে ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি বাড়াতে সাহায্য করে। তবে মনে রাখবেন অতিরিক্ত পরিমাণে ঘুমানো বা পরিমাণের তুলনায় কম ঘুমানো আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর। প্রতিদিন প্রাপ্ত বয়ষ্ক মানুষের ৭-৮ ঘন্টা ঘুমানো জরুরী। আর বয়ষ্ক মানুষের কমপক্ষে ৪-৬ ঘন্টা ঘুমানো জরুরী।
পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ:
কথায় বলে ‘খাওয়ার জন্যই জীবন’। তবে এই কথাটি পরিবর্তনের দাবি রাখে। কারণ সকল খাবার মানুষের জন্য উপকারী নয়। অনেক খাবার মানুষের সুস্থতায় বাঁধা প্রদান করে থাকে। বরং বলা প্রয়োজন ‘পুষ্টিকর খাবার মানেই জীবন’। অতিরিক্ত তেল চর্বিযুক্ত খাবার, কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার আমাদের শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে আমাদের দেহে চর্বি জমে নানা ধরণের রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করে। এইসব রোগের মধ্যে হার্টের সমস্যা, হাই প্রেসার, ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স ইত্যাদি অন্যতম। এইজন্য কার্বোহাইড্রেট ও চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে প্রচুর পরিমাণে শাক-সবজি, ফলমূল, কলা, ডিম, দুধ, ছোলা, সামুদ্রিক বা দেশি মাছসহ ডায়েটারি ফাইবারযুক্ত খাবারে গুরুত্ব দিতে হবে। এসব খাবার গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দেহে Insulin Sensitivity বৃদ্ধি পাবে।
ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট:
বেশ কিছু সাপ্লিমেন্ট আমাদের শরীরে Insulin Sensitivit বাড়াতে বেশ ভালো কাজ করে থাকে। এর মধ্যে ম্যাগনেসিয়াম, ওমেগা-৩ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাই শরীরে ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি কমে গেলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে।
যে খাবারগুলো ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি বাড়াতে পারে: বেশ কিছু খাবার মানব দেহে ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি বাড়াতে কাজ করে। এই খাবারগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রতিদিন গ্রহণ করা জরুরী। খাবারগুলো হচ্ছে-
★ ফলমূল ও শাক-সবজি:
বেশ কিছু ফলমূল ও শাক-সবজিতে এন্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যা মানুষের শরীরে Insulin Sensitivity বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এসব ফলমূল ও শাক-সবজির মধ্যে রয়েছে: আপেল, পেয়ারা, আনারস, তরমুজ, পাকা আম, পারসিমন, আঙুর, আতা, পালং শাক, লাল শাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর, শিম, বিটরুট ইত্যাদি।
★ সামুদ্রিক ও তেলযুক্ত মাছ:
OMEGA-3 আমাদের শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। এটি আমাদের হার্ট, চোখ ও ত্বকের জন্য বেশ উপকারী। পাশাপাশি আমাদের শরীরে ইন্সুলিন গ্রহণের ক্ষমতাও বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে এই ওমেগা-৩। বেশ কিছু দেশি ও সামুদ্রিক মাছে ওমেগা-৩ এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। এইসব মাছের মধ্যে পাঙ্গাস মাছ, তেলাপিয়া মাছ, বোয়াল মাছ, শোল মাছ, রিটা মাছ, ভেটকি মাছ, টুনা মাছ, কোরাল মাছ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
★ফার্মেন্টেটেড খাবার:
কিফার, চিজ, টক দই ইত্যাদি শরীরের খারাপ ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে নতুন ব্যাকটেরিয়ে তৈরিতে সহায়তা করে থাকে। এসব খাবার শরীরে ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
★হোল গ্রেইন শস্য:
পূর্ণ দানার গম, বার্লি, ছোলা ইত্যাদিকে বলা হয় হোল গ্রেইন শস্য। এসব খাবার আমাদের শরীরের জন্য বেশ উপকারী।
এসব খাবারের পাশাপাশি খেঁজুর, খাঁটি মধু, কিসমিস, কাঠ বাদাম, কাজু বাসাম, চিনা বাদাম, আখরোট ইত্যাদি শরীরে ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটি বৃদ্ধিতে বেশ ভালো কাজ করে থাকে।
পরিশেষে, Insulin Sensitivity কম থাকলে মানুষের শরীরে টাইপ-২ ডায়াবেটিস খুব সহজে বাসা বাঁধতে পারে। যা মানুষের শরীরকে নানা ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ রোগে আক্রান্ত করতে পারে। ডায়াবেটিস মানুষের জীবনকে কঠোরভাবে আয়ত্ব করে নিজের নিয়ন্ত্রণে পরিচালনা করা শুরু করে। যার ফলে আমাদের দেহ আমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে থাকে। এবং আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়ে নানা রকম রোগে আক্রান্ত করতে থাকে। এমনকি অল্পতেই ইনফেকশন ঘটিয়ে অঙ্গ এমনকি প্রাণ হারানোর পর্যায়ে পর্যন্ত নিয়ে যায় এই ডায়াবেটিস। তাই এমন পরিস্থিতি যেন আমাদের জীবনে না আসে, এজন্য আমাদের আগে থেকেই সতর্ক থাকতে। আমাদের শরীরে যেন ইন্সুলিন সেন্সিটিভিটির মাত্রা স্বাভাবিক থাকে এবং ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স যেন তৈরি না হয় সেই দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপনের মাধ্যমেই আমরা আমাদের ডায়াবেটিসসহ নানা রকমের রোগ আক্রান্ত হওয়া থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম।
আরও পড়ুনঃ ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স কি?