এন্টিবায়োটিক সেবনে সচেতনতাঃ
রোগাক্রান্ত দেহকে জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাহির থেকে ঔষধের মাধ্যমে আমরা যে সহায়তা নেই তার নাম এন্টিবায়োটিক।
এন্টিবায়োটিক সেবনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম আছে। যে কোন রোগে এন্টিবায়োটিক একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে সেবন করতে হয়। এন্টিবায়োটিক সেবনের ফলে রোগ ভালো হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এন্টিবায়োটিক সেবনের ফলে সকল জীবাণু নিষ্ক্রিয় নাও হতে পারে। কারণ জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা ধরে ঔষুধ সেবন করতে হয়। তাই নির্দিষ্ট সময় এবং পরিমাণ এন্টিবায়োটিক সেবন না করলে যে সকল জীবাণু সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয় না, তারা এই এন্টিবায়োটিককে চিনে ফেলে। ফলে এসকল জীবাণু নিজেদের দেহে এমন কিছু পরিবর্তন আনে, যার ফলে ঐ এন্টিবায়োটিকটি পরবর্তীতে সেই মানবদেহে আর কাজ করে না। বরং জীবাণুগুলো সেই এন্টিবায়োটিক থেকে শক্তি গ্রহণ করে আরও শক্তিশালী হয়ে অন্য এন্টিবায়োটিকের উপরেও প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জরিপ করে দেখা গেছে, রোগী এন্টিবায়োটিক সেবন করেছে এমন মাত্র ৮% এন্টিবায়োটিক ঔষধ ডাক্তার কর্তৃক প্রেসক্রিপশনকৃত। ভুল ঔষধ সেবনের ফলে এবং ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে আমাদের অজান্তেই শরীরের কিছু কিছু ক্ষতিকর এবং উপকারী জীবাণু এমনিতেই মরে যায়। কিন্তু বেঁচে থাকা জীবণুগুলো ঐ এন্টিবায়োটিকে ব্যবহৃত উপাদানগুলো চিনে ফেলে। পরবর্তীতে তারা নিজেদের মত প্রতিরোধ দেয়াল তৈরি দেহের মধ্যে করে লুকিয়ে থাকে। আশঙ্কার কথা এই যে, এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় আমাদের শরীরে আর এন্টিবায়োটিক কাজ করে না। ফলে আমাদের দেহে কার্যকারিতা হারাতে শুরু করে। বর্তমানে আমাদের দেশে ৬৫-৮৫ শতাংশ রোগীর শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে এন্টিবায়োটিক কাজ করছে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে স্বাস্থ্য সংস্থা।
কোন ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক কাজ করবে?
এন্টিবায়োটিক একমাত্র ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ বা সংক্রমনের বিরুদ্ধেই কাজ করে। ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণের কিছু উদাহরন হিসেবে বলা যায়– যক্ষা, টাইফয়েড, মেনিনজাইটিস, এনথ্রাক্স, ধনুষ্টংকার, কুষ্ঠ, ডিপথেরিয়া, গনোরিয়া ইত্যাদি।
কোন ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক কাজ করবে না?
ভাইরাসজনিত সকল সমস্যায় এন্টিবায়োটিক কোন কাজে আসবে না। ইনফ্লুয়েঞ্জা, পোলিও, মাম্পস, হার্পিস, জলাতংক, হাম, বসন্ত ইত্যাদি ভাইরাস জনিত রোগ।
যদিও এন্টিবায়োটিক, ভাইরাসজনিত সংক্রমণ বা ইনফেকশানে কোন উপকারে আসে না, কিন্তু অনেকে ধারনা পোষন করেন যে এসময় এন্টিবায়োটিক রোগীর উপকারে আসে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ সকল ক্ষেত্রে যদি আমরা এন্টিবায়োটিক নাও সেবন করি তবুও একটি নির্দিষ্ট সময় ভাইরাসজনিত সমস্যা ভাল হয়ে যাবে। কারণ এ সকল রোগে এন্টিবায়োটিক কোন ভূমিকা নেই। তবে ভাইরাসজনিত রোগ হলে ডাক্তারের স্মরাণাপন্ন হতে হবে অবশ্যই। কারণ ডাক্তারের পরামর্শের কোন বিকল্প নেই। আর অনেক সময় কাশি বা অন্যান্য সমস্যা অভ্যন্তরীণ রোগের কারণেও হতে পারে। যা একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারই নির্ণয় করতে পারেন।
প্রয়োজন ছাড়া এন্টিবায়োটিক সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
১. এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া বা বমি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া এন্টিবায়োটিক অন্ত্রের অনেক উপকারী ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে যার কারণে ভিন্ন ধরনের কিছু ইনফেকশান হবার প্রবণতা দেখা যায়।
২. এন্টিবায়োটিকে এলার্জি হওয়ার প্রবণতা অনেক। এলার্জির কারণে অনেকের ফুসকুড়ি, চুলকানি, জিহ্বা ও ঠোঁট ফুলে যাওয়া বা অন্যান্য মারাত্মক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৩. লিভারের ক্ষতি সাধনের জন্য অন্যান্য ঔষধের চেয়ে এন্টিবায়োটিক সবচেয়ে বেশি দায়ী।
৪. এন্টিবায়োটিক অন্ত্রের অনেক উপকারী ব্যাকটেরিয়াকেও মেরে ফেলে। ফলে অগ্ন্যাশয়ের কার্যক্ষমতা কমে গিয়ে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেড়ে যায়।
৫. দীর্ঘস্থায়ী এন্টিবায়োটিক সেবনে অন্ত্রের প্রাচীরে ঘা সৃষ্টি করতে পারে। যা আলসার নামে পরিচিত।
৬. এন্টিবায়োটিক অ্যাজমা থেকে রক্ষাকারী ব্যাকটেরিয়া নির্মূল করে ফেলে। যার ফলে এন্টিবায়োটিক সেবনকারীর অ্যাজমা হওয়ার সম্ভাবনা
অনেকটাই বেড়ে যায়।
৭. মোটা স্বাস্থ্য ঝুঁকির অন্যতম কারণ এন্টিবায়োটিক। অর্থাৎ এন্টিবায়োটিক সেবনের ফলে শরীরে মেদ বা চর্বি জমে যায়।
কখন এন্টিবায়োটিক খাওয়া যেতে পারে?
এন্টিবায়োটিক অবশ্যই একজন ডাক্তারের প্রেশক্রিপশানের নির্দেশ মোতাবেকই গ্রহণ করা উচিত। এন্টিবায়োটিক কখনই একই লক্ষন বিশিষ্ট অন্য মানুষের প্রেশক্রিপশান দেখে বা নিজের আগের সমস্যার জন্য দেয়া এন্টিবায়োটিক পুনরায় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া সেবন করা উচিত নয়। কারণ একই ব্যাকটেরিয়া যা আগে আক্রমন করেছিল তা পরবর্তীতে আক্রমণ নাও করতে পারে। আবার ব্যাকটেরিয়া একই হলেও তার শক্তি বৃদ্ধি হতে পারে৷ এতে এন্টিবায়োটিকের পাওয়ারও বাড়াতে হতে পারে। ডাক্তার অনেক সতর্কতার সাথে এবং রোগ নির্ণয়ের পরেই নির্দিষ্ট রকমের ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ঔষুধ দিয়ে থাকেন। কারণ সব এন্টিবায়োটিক সব ব্যাবটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে না।
এন্টিবায়োটিকের ক্ষতিকর দিক রোধে আমাদের করনীয়ঃ
আমরা চাইলেই এন্টিবায়োটিকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারি। এজন্য বিশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করাটাই যথেষ্ট। আসুন জেনে নেই কি সেই সতর্কতাসমূহঃ-
১। সাধারন রোগে ভুগলেই এন্টিবায়োটিক সেবন না করা। যতটা সম্ভব দেহের সাধারণ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে ঔষধ সেবন করতে হবে।
২। ডাক্তারের পরামর্শ মত ডোজ ও সময় অনুসারে এন্টিবায়োটিক সেবন করতে হবে। এন্টিবায়োটিক যেন এক বেলাও বাদ না যায় সে বিষয়ে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে৷
৩। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রে দেয়া ঔষধের ব্যাপারে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে হবে। কোন ঔষধ কেন দেয়া হয়েছে সম্পর্কে ধারনা নিতে হবে।
৪। মেয়াদ উত্তীর্ণ ঔষধ সেবন না করা। এটি ক্ষতির পাশাপাশি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
৫। আপনাকে দেয়া এন্টিবায়োটিক অন্য কাউকে খেতে দেওয়া যাবে না। এতে আপনার কোর্সে ঘাটতির পাশাপাশি অন্য ব্যক্তির ক্ষতি করে ফেলবেন।
৬। অনেক সময় গরু মোটাতাজাকরণে খামারিগণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঔষধ প্রয়োগ করে থাকেন৷ গবাদি পশু কিংবা হাঁস মুরগীকে ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত উচ্চমাত্রার টিকা প্রদান করা হয়। পোলট্রি মুরগী বাজারজাত করনের ১৫ দিন পূর্ব হতেই সকল প্রকার ঔষধ প্রয়োগ বন্ধ করার নিয়ম থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই তা মানা হয় না। রোগাক্রান্ত প্রাণী বাজারজাতকরণ ইত্যাদি হতে আমাদের শীঘ্রই সরে আসতে হবে। এমনটা না হলে ক্যান্সার, কিডনী ড্যামেজের মত বড় বড় রোগ মহামারীর মত আমাদের সমাজে ছড়াতেই থাকবে।
আরও পড়ুনঃ কোন ঔষধের সাথে কি খাবেন না। আর কিভাবে কোন ঔষধ খাবেন।
Pingback: প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণে নেই? বিনাইন প্রস্টেটিক হাইপারপ্লাসিয়ায় আক্রান্ত নন তো আপনি - রক্ত বন্ধন - Rokto B